নিষিদ্ধ লোবান, গেরিলা ও মেহেরজান
“আমি তোমায় সন্তান দিতে পারব। উত্তম বীজ উত্তম ফসল। তোমার সন্তান খাঁটি মুসলমান হবে, খোদার ওপর ঈমাণ রাখবে, আন্তরিক পাকিস্তানী হবে, চাওনা সেই সন্তান? আমরা সেই সন্তান তোমাদের দেব, তোমাকে দেব, তোমার বোনকে দেব, তোমার মাকে দেব, যারা হিন্দু নয়, বিশ্বাসঘাতক নয়, অবাধ্য নয়, আন্দোলন করে না, শ্লোগান দেয় না, কমিউনিস্ট হয় না। জাতির এই খেদমত আমরা করতে এসেছি। তোমাদের রক্ত শুদ্ধ করে দিয়ে যাব, তোমাদের গর্ভে খাঁটি পাকিস্তানী রেখে যাব, ইসলামের নিশানা উড়িয়ে যাব। তোমরা কৃতজ্ঞ থাকবে, তোমরা আমাদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তোমরা আমাদের সুললিত গান শোনাবে।”
(নিষিদ্ধ লোবান, সৈয়দ শামসুল হক)
সীট ছিল একেবারে শেষ সারির আগে সারিতে।
সিনেমা শেষের পরে ধাক্কাধাক্কি এড়ানোর জন্য বসে থাকা নয়, একরকম বিমোহিত অনুভূতি নিয়ে বসেছিলাম আরো কিছুক্ষণ। সম্ভবতঃ গতবছর রেডিওতে শুনছিলাম ‘গেরিলা’ ছবির শ্যুটিং নিয়ে আলোচনা, ফোনে কথা বলছিলেন – জয়া আহসান, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুসহ আরো ক’জন কুশলী। শুনেছিলাম, সৈয়দ শামসুল হকের “নিষিদ্ধ লোবান” অবলম্বনে কাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের ছবি, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু এবং সৈয়দ হক; এই তিনের সংমিশ্রণ আছে বলেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম – গেরিলা দেখতে যাবো।
অনেকদিন ধরে পড়বো পড়বো করেও পড়া হচ্ছিলো না – সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস “নিষিদ্ধ লোবান”। আজ সকালে প্রস্তুতি নিয়ে পড়া শুরু করলাম। কাহিনী খুব দীর্ঘ নয়, সম্ভবতঃ দুই কি তিনদিনের গল্প, কিন্তু সৈয়দ হকের সম্মোহনী গদ্য একটানে নিয়ে যায় চৌষট্টি পৃষ্ঠার উপন্যাসের শেষে। বিশাল অংশ জুড়ে আছে লাশ সরানোর, মাটি চাপা দেয়ার গল্প। টানটান বিবরণ।
পর্দায় গেরিলার কাহিনী অবশ্য অন্যরকম।
শুরুতে আছে শহুরে জীবন। একেবারে বিরতির আগে পর্যন্ত। এরপরে বিলকিস গ্রামে ফিরে গেলে ‘নিষিদ্ধ লোবান’এর গল্প শুরু হয়। অবশ্য ছবি শুরুতে দেখেছিলাম, কাহিনী - একজন মুক্তিযোদ্ধার অভিজ্ঞতা ও সৈয়দ শামসুল হকের “নিষিদ্ধ লোবান” অবলম্বনে। ছবির গল্পটুকু থাক না দেখা দর্শকের জন্য। ছবি নির্মাণ, শিল্পের বিদগ্ধ সমালোচকের ‘ক্যামেরার কাজ’ও বাকী থাক। শুধু বলি -পুরো ছবিটির দৃশ্য, জীবন, ধারণ – সবকিছু ছিল ৭১এর। রাস্তা, বাড়িঘর, পোশাক – সবকিছুতে সে সময়ের ছায়া ছিল।
গেরিলা কোনো ফ্যান্টাসি ফিকশন নয়। গেরিলা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের একদল গেরিলার অপারেশন, সাধারণ মানুষের শংকা, প্রাণের অনিশ্চয়তা, পাকি হানাদারদের নৃশংসতা, ধর্মের নামে হত্যা, খুন, লুটপাট, ধর্ষণ, সংখ্যালঘু নিধন – এর অনবদ্য আখ্যান। দেয়াল লিখন ও ব্যানারগুলো অসাধারণ। ম্যুভি রিভিউ বা দর্শক প্রতিক্রিয়া লেখা চেষ্টা করলাম না। বরং রায়হান আবীরের পোস্টের বক্তব্যের সাথে সহমত জানালাম।
২০১১ সালের এপ্রিলে এসে “গেরিলা” সিনেমাটি গুরুত্বপূর্ণ কেন?
গুরুত্বপূর্ণ একারণে যে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার নামে এখন “মেহেরজান” বানানো হচ্ছে। বাঙালি নারীর সঙ্গে পাকি সৈন্যের সঙ্গম-প্রেম কাহিনী দেখানো হচ্ছে। বিদেশী সেলিব্রিটি সেখানে অভিনয় করছে। “মেহেরজান” বানাচ্ছে কোনো ঝন্টু-মন্টু-মোহাম্মদ হোসেন না। মেহেরজান বানাচ্ছে - বিদেশে পড়ালেখা করা একদল জ্ঞানপাপী। দু’লক্ষ উনসত্তর হাজার নারী নিপীড়নের সত্যতাকে মিথ্যে প্রমাণ করতে শর্মিলা বসুরা যখন তৎপর তখন আমাদেরই মন্ত্রীকন্যা নির্মাণ করে “মেহেরজান” নামক এক অশ্লীল ছবি। এ অশ্লীলতা মুনমুন-ময়ুরী-ঝুমকার স্বল্পবসনা স্থুলকায়া সুড়সুড়ির চেয়ে অশ্লীল, ডিপজলের গালির চেয়েও অশ্লীল, মালেক আফসারীর রাজা’র চেয়েও অশ্লীল। “মেহেরজান” আমাদের ইতিহাসকে বিকৃত করে, “মেহেরজান” একাত্তর সালে আমার কিশোরী মায়ের পালিয়ের বেড়ানোর অনিশ্চিত দিন, মাইলের পর মাইল রাতে হাঁটাকে অপমান করে। “মেহেরজান” বিদ্রুপ করে গুরুদাসীকে। তাই দর্শক মেহেরজানকে বয়কট করে।
কিন্তু হায়, ঈশ্বর!
নষ্টেরও বুঝি পরিতোষক থাকে? সেটাই দেখলাম। একদল নষ্ট অধ্যাপক, স্থুল সৌন্দর্য্যধারক, ভন্ড সমালোচক মেহেরজানকে হালাল করতে এগিয়ে আসে। এরা কাউন্টার ন্যারেটিভ, আউট অফ ফ্রেম, ডিসকোর্স - এজাতীয় জার্গনে মায়ের ধর্ষণকে জায়েজ করতে খাটুনি দেয় ব্লগে, পত্রিকায়, ফেসবুক নোটে। পৃথিবীর কুৎসিততম জিনিশটিকেও এইসব নষ্ট-ভ্রষ্টদল অ্যাকাডেমিক আলোচনার তকমায়, বাহারী মোড়কে সুন্দর করে পরিবেশন করবে। আমি নিশ্চিত – একাত্তরের নিপীড়িত নারীদের নিয়ে অনলাইনেই যেসব লিখিত ডকুমেন্ট – ভিডিও পাওয়া যায় এগুলো এই অসভ্য অধ্যাপকদের চোখে পানি আনে না, আনবে না। তলানীর শরাবের লোভ, লেনাদেনার খুদ-কুটা, মিডিয়ায় ফোকাস; এসবের লোভে এই নিজের জন্মকে অস্বীকার করবে, নিজের মা’কে বিক্রি করে দেবে, এটুকুও কুন্ঠা করবে না।
নিন্দিত “মেহেরজান” যখন তার মিশনে ব্যর্থ, নষ্ট অধ্যাপক-সাংবাদিক-বিজ্ঞের দল যখন মেহেরজানের পক্ষে আরো ‘অ্যাকাডেমিক” পেপার লেখায় ব্যস্ত, তখন “গেরিলা” যেন এক সত্যালোকিত সকাল। গেরিলা’য় আমরা দেখি – পাকি কুত্তার বাচ্চা সেনাগুলো এদেশে প্রেম করতে আসেনি। আমাদের মায়েরা পাকিদের প্রেমে পড়ে নিজেদের বিকিয়ে দেয়নি। পাকি হানাদার ও এদেশীয় জামাত ইসলামের রাজাকারগুলো একাত্তরে কী করেছে, নারী ও সংখ্যালঘুকে কোন দৃষ্টিতে দেখেছে – তার এক ঝলক আছে গেরিলায়। কাউন্টার ন্যারেটিভের কুৎসিত ডিসকোর্সের গালে এক প্রচন্ড চড়-আঘাত। স্যালুট - নাসির উদ্দীন ইউসুফ, জয়া আহসান, এবং অন্যসব কুশলীব।
পুনশ্চঃ
একাত্তরের মতো একটি মীমাসিংত বিষয় নিয়ে এখনো কেন তর্ক হয়, এখনো কেন মিরপুর স্টেডিয়ামে তেইশে মার্চের খেলায় পাকি পতাকা ওড়ে, পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান উচ্চকিত হয়, জার্সি বদল হয়, কেন সমালোচকের বেশে একদল সুশীল ‘মেহেরজান’ তও্বকে লেহন করে – সে প্রশ্নের খানিক উত্তর পেলাম “নিষিদ্ধ লোবান”এ শেষের অংশে। জলেশ্বরী হাইস্কুল ক্যাম্পে বিলকিসকে উদ্দেশ্য করে পাকি মেজরের সংলাপ –
“আমি তোমায় সন্তান দিতে পারব। উত্তম বীজ উত্তম ফসল। তোমার সন্তান খাঁটি মুসলমান হবে, খোদার ওপর ঈমাণ রাখবে, আন্তরিক পাকিস্তানী হবে, চাওনা সেই সন্তান? আমরা সেই সন্তান তোমাদের দেব, তোমাকে দেব, তোমার বোনকে দেব, তোমার মাকে দেব, যারা হিন্দু নয়, বিশ্বাসঘাতক নয়, অবাধ্য নয়, আন্দোলন করে না, শ্লোগান দেয় না, কমিউনিস্ট হয় না। জাতির এই খেদমত আমরা করতে এসেছি। তোমাদের রক্ত শুদ্ধ করে দিয়ে যাব, তোমাদের গর্ভে খাঁটি পাকিস্তানী রেখে যাব, ইসলামের নিশানা উড়িয়ে যাব। তোমরা কৃতজ্ঞ থাকবে, তোমরা আমাদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তোমরা আমাদের সুললিত গান শোনাবে।”
নিষিদ্ধ লোবানে বিলকিস সে সুযোগ দেয়নি। কিন্তু পাকি মেজরের স্বপ্ন কিছুটা হলেও সত্যি হয়ে গেছে দূর্ভাগ্যজনকভাবে। মেহেরজানের পক্ষে ক্যানভাসার সুশীল সন্তানগুলো মূলত পাকি মেজরের বর্ণিত উত্তম বীজের উত্তম সন্তান। শুক্রাণু ডিম্বানুর বিচারে না হলেও আত্মাগতভাবে এরা পাকিস্তানী। এরা পাকিস্তানের নিশানা উড়িয়ে যাবে, কৃতজ্ঞ থাকবে, পাকিস্তানের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে। আর সুললিত গান? সেটা তাদের নির্মোহ অ্যাকাডেমিক ডিসকোর্সের কুৎসিত শব্দমালা ছাড়া আর কিছু নয়।
5 মন্তব্য::
ফাটাফাটি হয়েছে শিমুল...ফেসবুকে শেয়ার দিচ্ছি।
ভিনটেজ শিমুল! সচলে দিও।
শিমুল, অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়লাম।
যথারীতি ক্ষুরধার!
আমি এই ব্লগজগতে নাই বহুদিন হলো।
তবু অন্ততঃ এই লেখায় ভালোলাগাটা না জানায়ে গেলে পাপ হবে!
ভালো থাকবেন।
-চাহানিমা
sir, khbbbbb valo hoese lekha ta....
Post a Comment