13 November, 2010

লাইক অ্যা ডায়মন্ড ইন দ্য স্কাই

মানুষ কিলবিল করছে ঢাকা শহরে।
কেবলই মানুষের ভীড়। দেশের নানান প্রান্ত থেকে আসা শীর্ণ বিশীর্ণ মানুষ, ছুটে চলা; শুধুই ক্লান্তি জাগায়। ট্রাফিক জ্যামে ঘিরে ধরে হাড্ডিসার জিরজিরে শরীর, এক চোখ নেই, দাঁত ভাঙা, হাত কাটা, পা কাটা, মুখের চামড়া ঝুলে পড়া, রোগাক্রান্ত শিশু – নারী – যুবা – বৃদ্ধ ভিক্ষুক। প্রতিদিন সেই একই দৃশ্য। এরচেয়ে বরং দোকানের সাইনবোর্ড পড়তে ভালো লাগে, সাইনবোর্ডের বানানগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বানান ভুল বের করে সময় কাটে। ফেলে আসা দিন, ফেলে আসা সময়কে স্মৃতি করে রাখি, ভাবি – ওগুলো এরকমই এক সময়। সে সময়ের জন্য হা-হুতাশ করি না। তবুও মনে পড়ে টরন্টো ট্রানজিট কমিশনের ট্রেন। ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ পড়তে পড়তে ইয়াং স্টেশনের বদলে কুইন্সে গিয়ে থামা। ভিক্টোরিয়া পার্ক স্টেশনে নরম রোদেলা দুপুরে রাইজ – ট্রাউটের ‘পজিশনিং ; ব্যাটেল ইন ইয়্যূর মাইন্ড’ পড়া। এখন এসব মনে পড়ে, যখন দেখি গুলশান এক নম্বর মোড়ে এক গাদা বই দুই হাতে চেপে এগিয়ে আসে হতদরিদ্র কিশোর হকার। সব ইন্টারন্যাশনাল পাবলিকেশনস।
দাম জিজ্ঞেস করতেই মনে হলো, এদের টার্গেট গ্রুপ ভিন্ন। আমি হাসি, বলি – পড়ার জন্য বই কিনি, ঘর সাজানোর জন্য না। তারপর দরাদরি শেষে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের মোড়ক খুলে উপন্যাসের পাতা উল্টাই – ‘লাইক অ্যা ডায়মন্ড ইন দ্য স্কাই’, লিখেছেন সাজিয়া ওমর।


গরমাগরম রিভিউ, আলাপ, প্রশংসা সব হয়ে হয়ে গেছে আগে। ডেইলি স্টারে বই নিয়ে আলাপ দেখেছি, অন্য একাধিক বাংলা দৈনিকের নারী পাতায় লেখকের ছবি -সাক্ষাতকার দেখেছি, চোখ বুলিয়েছি। বলা হয়েছে, এ সময়কার ঢাকা শহর, মাদকাসক্ত তারুণ্য, দারিদ্র্য; এসবই উপজীব্য। বইয়ের প্রথম দু’তিন পাতা যখন পড়লাম, টের পেলাম লেখায় গতি আছে বেশ। গল্পের প্রধান দুটো চরিত্র দ্বীন (Deen) এবং এজে (AJ) যখন কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে পৌঁছে, তখন আরো মনোযোগী হই, বছর ছয়েক আগে ফেলে আসা এই আমাকে খুঁজি সাজিয়া ওমরের জনকোলাহলে। হতাশ হতে হলো শুরুতেই, যে আম গাছের নিচে গিয়ে দ্বীন বসে, যে লবিতে মারিয়া হেঁটে আসে, যে ক্যান্টিন বর্ণনা পায়; সেসব আমার অদেখা। এরপর এই ভেবে পাতা উল্টাই যে এটা ডকু ফিকশন নয়, নিছক ফিকশন। আমার শেষ-কৈশোরের ক্যাম্পাসের ধুলো এসব পাতায় না থাকলে ক্ষতি নেই। কিছু বিরতি ছিল পাঠে, ক্লান্তি লাগেনি, চল্লিশ-পঞ্চাশ পৃষ্ঠা শেষ হয়ে গেলে মোট পৃষ্ঠা গুনে দেখি দু’শ বায়ান্ন।


ঢাকার উঠতি অ্যাফ্লুয়েন্ট সোসাইটির সামাজিক শৈথিল্য, বিচ্ছিন্নতা, ভুল তরুণ দল আর প্রেম অপ্রেমের জীবন ছোঁয়ায় সাজিয়া ওমর সফল হয়েছেন, ঠিক। তবে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন ঠিক কোন জায়গায় গিয়ে থামতে হবে, কোন জায়গায় পাঠককে অপেক্ষা করাতে হবে; এসব নির্ধারণে। দ্বীন এবং এজে দুটো প্যারালাল চরিত্র। টঙ্গীর বস্তিতে ফালানির ঘরে এরা ধোঁয়ায় মগ্ন হয়। এদের অসম বন্ধুরা, সাগর – রাহুল – পারভেজ – মুসা – কালা এবং অনেকে, সঙ্গে থাকে। নিজেরা স্বীকার করে এরা খোর, khor2core। ওরা স্বীকার করে সুস্থ জীবনে আর ফেরা যাবে না। তাই ওরা ছোটে আর ছোটে। তাদের নিজস্ব গল্প আছে, ব্যক্তিগত জীবনের ব্যর্থতা, হতাশা আর গ্লানি আছে। দ্বীন যেমন তার বাবার মৃত্যুর জন্য নিজেকে অপরাধী করে, এজে যেমন রাজ গোপালের অপরাধ নেটওয়ার্কে জড়িয়ে পরিবারকে অর্থ ঋণভার থেকে বাঁচায়, তেমন করে বাস্তবতা হয়ে ওঠে অস্থির জীবনের যাত্রা। তাই তারা আশ্রয় খোঁজে।


এজে আশ্রয় খোঁজে রাজ গোপালের কেপ্ট ভারতীয় সুন্দরীর কাছে। দ্বীন আশ্রয় খোঁজে মারিয়ার কাছে। ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে মারিয়া, যাকে এজে ম্যান-ইটার বলে। তবুও দ্বীন মারিয়ার জন্য অপেক্ষা করে। তবে এসব অপেক্ষা-আশ্রয় প্লেটোনিক নয়। রয়েছে, প্রবল শরীরি আকর্ষণ। সুন্দরী-মারিয়া দুজনই নিজেদের মেলে ধরে। বাঙালি লেখকের কলমে সেক্স বিত্তান্তে রূপক থাকে প্রায়শ, এখানে সাজিয়া ওমর ট্রেন্ড ভাঙতে পেরেছেন কিনা সে আলাপ অন্য সময়ে করা যাবে, তবে সাজিয়া সাবলীল ছিলেন বিবরণে। এ বিবরণ আবার নতুন কিছু নয়। অনেক ক্ষেত্রে শিডনী শেলডনের তুমুল প্রভাব কিংবা ছায়া এসেছে সেসব বিবরণে। এক সময় এসে মনে হয়েছে, বড়ো বেশি শরীরি গল্পের কাহিনী হয়ে যাচ্ছে এ উপন্যাস, সেক্স অ্যান্ড সিটির কাহিনী এগুচ্ছে না। মাদকাসক্ত – বিষন্ন মানুষ এমন করে ফ্রয়েড আক্রান্ত হয় কিনা সে প্রশ্নের উত্তর ব্যক্তিগত জীবনে সোশ্যাল সাইকোলজিস্ট সাজিয়া ওমরই ভালো বলতে পারবেন।


গল্পের কাঠামো সাজানোয় কৌশলের কথা বলছিলাম। উপন্যাসটি সরল রৈখিক নয়। দ্বীন, এজে, মারিয়া, ফালানি, সুন্দরী, রাজ গোপাল, পারভেজ, চিঙ্কস, সার্জেন্ট আকবর; এদের সবাই যখন পারস্পরিকভাবে সংযুক্ত হয় – তখন অনেকগুলো গল্পের ভেতরে গল্পের সম্ভবনা জেগে ওঠে। হয়তো পৃষ্ঠা সীমিত ছিল, নইলে লেখক অমনোযোগী অথবা নিতান্তই অবহেলায় এরকম অনেক সম্ভাব্য গল্পের প্লটকে খুন করা হয়েছে।


পারভেজের মৃত্যু এবং এর বিবরণ দূর্দান্ত। মাদকাসক্ত চিঙ্কসের (চিঙ্কু) মৃত্যুতে বাস্তবতা ছিল, করুণ বেদনা ছিল, ভয় ছিল। কিন্তু, পারভেজের মৃত্যু যেন পরাবাস্তবতা। পারভেজের বাবা যিনি মন্ত্রী মিন্টু চাচা নামে উপন্যাসে আগেও এসেছেন তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলে এজে-দ্বীনদের চারপাশে সব কিছু ভেঙে পড়ে। এই মন্ত্রীকে খুব চেনা চেনা লাগে, যেমন চেনা লাগে রাজ গোপালকে। সাজিয়া ওমর অবশ্য রাজ গোপালকে আরো আড়াল দিতে পারতেন চাইলে, অন্ততঃ সেটাই ভালো হতো। ফিকশনকে ফিকশন রাখা ভালো। পারভেজের বাসায় পার্টিতে অর্থমন্ত্রীর ছেলে কিংবা কৃষি মন্ত্রীর তিনকন্যা; এদের না চিনলেও চলে। কিন্তু রাজ গোপাল, হয়তো আমাদের মিডিয়া গসিপের কারণেই, চেনা হয়ে যায়। সার্জেন্ট আকবর আরেকটি দারুণ চরিত্র। কামকাতুর-ধর্মভীরু মধ্যবিত্ত লোক, যে কিনা শুধু মেয়ের টিউশনের জন্য ঘুষ খায়। ভেতরে ভেতরে হিরো হওয়ার স্বপ্ন দেখে, খুশি হয়ে সবজি সমুচার বদলে গরু মাংসের সমুচা খায়। আকবরকে নিয়ে কম বেশি করা হয়নি। তবে অযত্ন ছিল, ফালানি এবং সুন্দরীকে নিয়ে। এ দুটো সম্ভবনাময় চরিত্র অবহেলায় থেকে গেছে শেষ পর্যন্ত।


উপন্যাসের অন্তত দুটো জায়গায় র্যা বকে ফোর্সেস উইথ লাইসেন্স টু কিল বলা হয়েছে। Government of Bangladesh কে GOB ডেকে বিষেদাগার করা হয়েছে। হয়তো রটেন অ্যাফ্লুয়েন্ট সোসাইটি এসব বলেই সান্ত্বনা পায়। জীবন জীবিকার সংগ্রাম যেখানে অনুপস্থিত, পড়ালেখাও যখন স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে ওঠে তখন দ্বীনের যৌক্তিক ব্যাখ্যাকে অহেতুক লাগে – “He didn’t want to be part of this system. BBA, MBA, fast track to the grand life where you spend your precious hours like a greedy bastard salivating over balance sheets for some foreign firm that rips resources off your land and degrade your people to poverty.” শুনতে ভাল লাগে, কিন্তু যখন কে এই কথাটা বললো সেটা সামনে আসে – তখন দ্বীনের এই দার্শনিকতা ভন্ডামি হয়ে যায়।


ব্যক্তিগত শুন্যতায় মারিয়া বলে, “I feel so alone,”…”Disconnected. And it’s not just my life I hate. Everyone seems pathetic. No one is happy. No one’s found deeper bliss or any reason for living. People like to dwell in their shitty little lives out of habit. Even you, Deen, your life is a waste of time.”
যদিও এই ঋণাত্বক ভাবনা বিলাসীতা নয়, কিন্তু এই যদি হয় জীবনবোধ, এই যদি হয় জীবনাচরণ – তখন ওয়েটিং ফর গডো ছাড়া আর উপায় নেই। গডো আসে না, আসে মৃত্যু। ক্ষমতা ও সম্পর্কের সমস্ত আশ্রয় তখন ভেঙে পড়ে।


ফিকশন তো ফিকশনই থাকবে। কোথায় যেন পড়েছিলাম - Fiction is not reality but fiction should reflect reality and reality is that what exists in our life. পড়তে গিয়ে অনেকবার মনে হয়েছে, বড্ডো বেশি কল্পনা হয়ে যাচ্ছে, এ আমাদের শহর নয়, এ আমাদের মানুষ নয়। এসব অন্য শহরের কাহিনী। শেষের দিকে পারভেজ যখন চিৎকার করে, “everything happens in Bangladesh, behind closed doors” তখন দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু থাকে না। দরজার ওপাশে সাজিয়া ওমর গিয়েছেন, দেখেছেন-শুনেছেন-বলেছেন। তাই অভিনন্দন।
ডেব্যু ইনিংস বলে কিছু ভুল শটের চেষ্টাগুলো ক্ষমা করে দেয়া যায়। সাজিয়া ওমরের পরবর্তী বইটি পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।


‘লাইক অ্যা ডায়মন্ড ইন দ্য স্কাই’ শেষ করার পরে এক ধরণের মন খারাপ চেপে বসেছে। শেষ আট পৃষ্ঠা, সমাপ্তি, আমাকে বিষন্ন করেছে। দ্বীনের জন্য সমবেদনা নাকি করুণা থাকবে সেটি বলতে পারছি না। তবে দ্বীনের সংখ্যা বাড়ছে, অসংখ্যা এজে মোটরবাইকে ছুটছে, মারিয়ারা আরো বিভ্রান্ত হচ্ছে, পারভেজ ডুবে যাচ্ছে মেঘনা নদীতে, নতুন কোনো রাজ গোপাল আরো শীতল হাসি হাসছে। আশুলিয়ার জলে ভেসে যাওয়া জোছনা নয়, আমাদের শহরের নিয়ন আলো ম্লান করে ডিজে নাইটের শীৎকারে ধোঁয়া বাড়ে, স্বপ্নরা হারিয়ে যায় আকাশে। লাইক অ্যা ডায়মন্ড ইন দ্য স্কাই।
.
.
.

Read more...

31 August, 2010

তারপর সেবা রোমান্টিক

হঠাৎ করে আম্মার জ্বর আবার ফিরে এলো বুধবার রাতে। সাথে সেই পুরনো লক্ষণগুলো। আম্মা এমনিতে হসপিটালে যেতে চায় না। তবে এবার না করলো না। ক্যালেন্ডার মিলিয়ে দেখলাম, ঠিক এক মাস। এক মাস আগে হসপিটালে ভর্তি করিয়েছিলাম। সেইবার ডেঙ্গুর লক্ষণ, রেস্ট দরকার, হালকা কিছু অসুদ দিয়ে ছেড়ে দিলো। সমস্যাটা বোধ হয় এখানে যে আম্মা রেস্ট নিতে জানেন না। পানি খাওয়ানোটাও বিরাট হ্যাপা। এবার আবার ভর্তি করালাম ইমার্জেন্সিতে। ডাক্তার দেখেই বললো, ট্রাভেল করেছিলেন নাকি? আবারও সেই একই রকম মন্তব্য। নেক্সট কয়েকদিন প্ল্যাটিলেট চেক করাতে হবে, ব্লাড কালচারও করতে হবে...। অন্য কিছু করার নেই।


গত দু’সপ্তাহ ছুটি ছিলো।
চোখের ভাইরাল ইনফেকশন এক সপ্তাহ নিয়ে নিলো। অনেক কিছু লিখে রেখেছিলাম, এই সময়ে করার – দেখার। কিছুই হলো না। শনিবার সকালের দিকে ডায়াগনিস্টিক সেন্টারে যাচ্ছিলাম রিপোর্ট আনতে। রিক্সা নিলাম। সমস্যা হলো, ট্রাফিক পুলিস মোড়ের পরে রিক্সা বামে যেতে দিবে না। অন্য একটা রাস্তা ছিলো, সেদিক দিয়ে গেলেই ভালো হতো, এসব ভেবে ভেবে হাঁটা শুরু করি। রোদের তেজ বাড়ছে, পিঠে শার্ট লেপ্টে যাচ্ছে ঘামে। পথ লম্বা নয় – পাঁচ থেকে সাত মিনিট। ফুটপাথ দখল করে নিয়েছে হকার। এ পাশটায় বইয়ের দোকান আছে ফুটপাথে। আরেকদিন দেখে গিয়েছিলাম। নিউমার্কেটের কাছাকাছি দাম। সিডনী শেলডনের বইগুলো নীলক্ষেত প্রিন্ট, ১০০ টাকা দাম। নিউমার্কেটের ওদিকেও ১০০/১২০ এরকম দাম দেখেছিলাম। হাঁটার গতি কমিয়ে চোখ বুলাই বইয়ে। এক স্তুপ সেবা রোমান্টিকের দিকে চোখ গেলো। হিসেব করে দেখেছি, অনেক কিছু পড়তে দেরি হয়ে যায় কেবল। প্রথম মাসুদ রানা পড়েছি বিশ বছর বয়সে! ছোটোকাকা সেই কবে তিন গোয়েন্দা ছুড়ে ফেলে দিলো, হাতে দিলো জিম করবেটের কুমায়ুনের মানুষখেকো, এইচ জি ওয়েলসের টাইম মেশিন। আশেপাশের কোনো এক সপ্তায় বিটিভিতে দেখালো আজাদ আবুল কালাম অভিনীত নাটক। যেখানে তুষার খান থ্রিলার রাইটার। আবুল হায়াতের ছেলে আজাদ আবুল কালাম এ-লেভেল দিয়েছে। কিন্তু, ঐ থ্রিলারের নায়কের মতো একদিন মানুষ খুন করে ফেলে সে, বিচারে ফাঁসি হয়। আবুল হায়াত মামলা করে লেখক তুষার খানের বিরুদ্ধে। লেখকের কোনো শাস্তি হয় না। শেষ দৃশ্যে, আজাদ আবুল কালাম জেলের গ্রিল ধরে কাঁদতে থাকে- টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটল স্টার...। নাটকের নাম ভুলে গিয়েছি। কলেজের প্রথম সপ্তায়, আহসান হাবীব স্যার যারা মাসুদ রানা পড়ে তাদের জন্য কী এক বিশাল ওয়াজ করে দিলেন। আশরাফ ভাই বললেন, দুই ধরনের ছেলের সাথে মিশবিনা – যারা সিগারেট খায় – যারা মাসুদ রানা পড়ে। মাসুদ রানা পড়া মানে – পরীক্ষায় নিশ্চিত ফেইল। সুবোধ সময়ে তাই হুমায়ূন পড়ি, মিলন পড়ি, শীর্ষেন্দু পড়ি, হুমায়ূন আজাদ পড়ি। পরে সমরেশও পড়ি। কিন্তু, মাসুদ রানা পড়তে দেরি হয়ে গেলো অনেক। এর পরে বেশ কিছু মাসুদ রানা পড়েছি, এখনো পড়ি, বিরক্তি লাগে না। তবে বন্ধুদের মুখে শুনেছি আরেক নিষিদ্ধ সেবা রোমান্টিক। সেবা রোমান্টিকও পড়া হয়নি আমার, এর অন্যতম কারণ - সম্ভবত হাতের কাছে পাইনি কখনো। এবারের বইমেলায় সেবার স্টলেও পাইনি, রোমান্টিক সিরিজের কোনো বই-ই প্রিন্টে নাই। জানার আগ্রহ ছিলো – বইগুলো কেমন হয়, কী নিয়ে লিখে। রাজশাহী ট্রেন স্টেশনে ট্রেনের সময় যখন মিললো না, বইয়ের স্টলে বই দেখছি, কিনলামও কয়েকটা অনুবাদ, অয়ন বললো – সেবা রোমান্টিক হলো অমিত আহমেদের গন্দমের মতো। প্রেমের আখ্যান।


শনিবার সকালে রাস্তার পাশে এতগুলো সেবা রোমান্টিক দেখে হাতে নিলাম। বেশিরভাগের অবস্থা ভয়াবহ, অনেক পুরনো। একটার কভারই নেই। সন্দেহ জাগলো, ভেতরের পাতা ঠিকমতো আছে কিনা। আরো খানিক উলটে পালটে পাঁচটা সেবা রোমান্টিক কিনলাম – রোকসানা নাজনীনের ‘এ মণিহার’, খন্দকার মজহারুল করিমের ‘কঙ্কাবতী’, ‘ময়ূরী রাত’, ‘সব মানুষের পৃথিবী’, শেখ আবদুল হাকিমের ‘অন্তরা’। সঙ্গে একটা গল্পগ্রন্থ কাজী মায়মুর হোসেনের ‘ওস্তাদের মার’। গল্পগ্রন্থটার অবস্থা বেশ ভালো, দেখতে নতুনের মতোই লাগে। বাকীগুলোর একটু টেপ-টুপ লাগাতে হবে। সব মিলিয়ে ছয়টা বইয়ের দাম, দরাদরি শেষে, ৬৫ টাকা। বাসায় ফিরে ‘ওস্তাদের মার’ বইয়ের ভূমিকায় পড়লাম হেলেন নিলসের লেখা দ্য মাস্টার্স টাচ অবলম্বনে লেখা ‘ওস্তাদের মার’ গল্পটি। মোট চৌদ্দটা গল্পের দুইটা মৌলিক, বাকী বারোটা অনুবাদ বা রূপান্তর। মৌলিক গল্প ‘স্মৃতি’ পড়লাম প্রথমে। নয় পৃষ্ঠার গল্প। হতাশ হলাম। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত গল্প আরো স্মার্ট হওয়া উচিত ছিলো। এমনকি গত চার বছরে ব্লগের আনকোরা অনেক লেখকও এরচেয়ে ভালো গল্প লিখেছেন। অন্য গল্প পড়তে আগ্রহ পেলাম না। বাকী বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখলাম। এই প্রথম চোখে পড়লো, সেবা’র বেশিরভাগ বইগুলো কাউকে উৎসর্গ করা হয় না।


গল্প/উপন্যাস পড়তে গেলে যেটা প্রথমেই দেখে নিই – কতো সালের লেখা। সঙ্গে, গল্পের প্লটের সময়টাও অনুমান করার চেষ্টা করি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লেখক নিজেই সময় বলে দেন। আবার কোনো ক্ষেত্রে অনুমান করে নিতে হয়। কিছু কিছু প্লটের সময় খুব জরুরী কিছু নয়। শুরু করেছিলাম রোকসানা নাজনীনের ‘এ মণিহার’ দিয়ে। ১৯২ পৃষ্ঠা, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৫। সেবা প্রকাশনীর বইগুলোর কাগজের মান খারাপ, সেজন্য হয়তো দাম কম। কিন্তু, অনন্য দিকটা হলো ব্যাক-কভারে লেখা সার সংক্ষেপগুলো। ভীষণ আকর্ষণীয় হয় পেছনের লেখাটুকু, বই পড়তে আগ্রহ জাগায়। ‘এ মণিহার’এ লেখা আছে –


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আরশি আমিন
শয়নে-স্বপনে মজে থাকে ওর মায়ের জন্মভূমি স্পেনের
কল্পনায়।
সে সূত্রেই বন্ধুত্ব হলো স্প্যানিশ ভিজিটিং প্রোফেসার এমিলিও
সিয়েরার সঙ্গে। কিন্তু তিনি বিয়ের প্রস্তাব দিতেই তেলে-
বেগুনে জ্বলে উঠল আরশি, নিষ্ঠুরের মত ফিরিয়ে দিল তাঁকে।
সেরাতেই আরিচা রোডে সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলেন
সিয়েরা। পুলিশের ধারণা সেটা আত্মহত্যা।
বিবেকের দংশনে জ্বলছিল আরশি, তখনই জানতে পারল
জীবনবীমার পুরো টাকাটা ওকেই দিয়ে গেছেন সিয়েরা।
এত টাকা গ্রহণ করতে বাধল ওর, বাবার সঙ্গে পরামর্শের পর
ঠিক করল স্পেনে গিয়ে এমিলিও সিয়েরার পরিবারকে
খুঁজে বের করবে – ওদের হাতেই তুলে দেবে টাকাটা।
তারপর? ও কি ভাবতে পেরেছিল, এত আচমকা, এমন
অপ্রস্তুত অবস্থায় এসে হাজির হবে প্রথম প্রেম!




এই হলো কাহিনী। মাঝপথে কাহিনী কিছুটা ঝুলে গেছে, নইলে মোটামুটি গতিময় কাহিনী। স্পেনে গিয়ে এমিলিওর পরিবার খুঁজে বের করতে খানিক চক্করে পড়তে হয় আরশিকে। তবে তার আগেই প্রেম করে বিয়ে করেছে এমিলিওর ছোটো ভাই লরেন্সকে। সেখানে কিছু দ্বন্দ্ব কিছু সন্দেহ আসে যখন পরিচয় প্রকাশিত হয় আর তারও আগে ঢাকা থেকে লরেন্সের প্রাইভেট ডিটেকটিভ রিপোর্ট পাঠায় এমিলিওর খুনের জন্য দায়ী আরশি নামের মেয়েটি। এর বাইরে অন্য কোনো চমক নেই, অপেক্ষা নেই, একটানা সরল গতিতে কাহিনী এগিয়ে গেছে। পড়তে পড়তে ভাবছিলাম এটি কোনো মৌলিক কাহিনী নাকি বিদেশী কোনো কাহিনীর রূপান্তর। বইতে কোনো ইংগিত পেলাম না। কারণ, স্পেনের প্রত্যন্ত গ্রাম বাস্ক কিংবা যুবিলিয়ায় যাওয়ার যে বিবরণ, দূর্বোধ্য এসকুয়ারা ভাষার অনুবাদ গান, সামাজিক আচার, এগুলো কি না দেখে লেখা সম্ভব? আরেকটা হতে পারে লেখক নিজেই ঘুরে এসেছেন, জানেন ওসব ভাষা কিংবা প্রচুর স্টাডি করেছেন...। তবে অমনটি হওয়ার সম্ভবনা কেমন সেটাই বড় প্রশ্ন। এই উপন্যাসের চোখে লাগার মতো একটা ভুল হলো – শুরুতেই বলা আছে, আরশির মা (স্প্যানিশ মহিলা) মারা গিয়েছিল আরশির জন্মের সময়। কিন্তু, এরপরে পুরো উপন্যাসে বিবরণ এসেছে কীভাবে আরশিকে তার মা স্প্যানিশ ভাষা শেখাতো, এসকুয়ারা গান শেখাতো, এসেছে মায়ের অনেক স্মৃতি। নিজের খটকা কাটাতে আবার দেখেছি, কোথাও ভুল হচ্ছে কিনা। দেখলাম, নাহ! ঠিকই পড়েছি। ব্যক্তিগত রেটিং দেবো – পাঁচে আড়াই।


পরদিন পড়লাম ‘কঙ্কাবতী’।
রচনাকাল ১৯৯৫, পৃষ্ঠা ১৫২।
পেছনে লেখা সংক্ষেপ পড়ি-
হৃদয়-উষ্ণ-করে-দেয়া আরও একটি রোমান্টিক উপন্যাস
লিখেছেন আধুনিক পাঠকের প্রিয় লেখক।
কাহিনী?
এক মধুর লগ্নে রেজার সঙ্গে কঙ্কাবতীর আলাপ। তার মধ্যে
রেজা খুঁজে পায় রাজকন্যেকে আর কঙ্কাবতী রেজার
মুখে আবিষ্কার করে বীর রাজকুমারের প্রতিচ্ছায়া – যে কীনা
যুদ্ধে জিতে দেশ শত্রুমুক্ত করে ফিরে এসেছে।


ওদের মিলন হবার কথা, কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মুখে বোমার
মত ফেটে পড়ে একটি সংবাদঃ
কঙ্কাবতীর বিয়ে হয়েছিল কৈশোরে।
কারুর ষড়যন্ত্র নয়, সত্যি সত্যি, অনেক সাক্ষীও আছে।
এখন কী করবে রাজপুত্র আর রাজকন্যা?
চলুন, ওদেরই জিজ্ঞেস করি।
ভাল কথা, হাতে কিন্তু সময় থাকা চাই, কারণ
একবার শুরু করলে তো...




‘কঙ্কাবতী’ উপন্যাসের কাহিনী ‘এ মণিহার’এর চেয়েও সরল। যেনো উডেন ফ্লোরের উপরে মার্বেল ছেড়ে দিলে যেমন গড়গড়িয়ে চলে যাবে সেরকম। সময় ধরার চেষ্টা করছিলাম। বলা আছে, উপন্যাসে বর্তমানের কঙ্কাবতীর বয়স বিশ, আর যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ৭। যোগ করলে কাহিনী দাঁড়ায় ১৯৮৪ সালের। সময় নিয়ে খাপছাড়া কিছু নেই। কিন্তু, পাঠক হিসেবে বিরক্ত লেগেছে ৮৪ সালের প্রেমের গল্প বলতে গিয়ে পাতার পরে পাতা একাত্তুরের যুদ্ধকে নিয়ে আসা। আমাদের গৌরব মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আসা সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, কাহিনীর যে প্রেক্ষিতে নিয়ে আসা হয়েছে, তার তুলনায় যুদ্ধের গোলাগুলি অ্যাকশনের যে বিস্তার দেয়া হয়েছে সেটা কঙ্কাবতীর পাঠককে বিরক্ত করে। মনে হয়েছে, এতো অধ্যায়ের পরে অধ্যায় না লিখে বরং এক পৃষ্ঠায় একাত্তুরের কঙ্কাবতী গল্প বলা যেতো। আবার এমনও হয়েছে উপন্যাসের বর্তমান সময় বলতে যুদ্ধের পনের-ষোল বছর বলা হয়েছে। আরেকটি প্রশ্ন হলো, ব্যাক-কভারে কঙ্কাবতীর কৈশোরে বিয়ের কথা বলা আছে। সাত বছর বয়স কি কৈশোর না শিশুকাল? ব্যক্তিগত রেটিং দেব – পাঁচে দেড়।


একদিন বিরতি দিয়ে শুরু করলাম খন্দকার মজহারুল করিমেরই ‘ময়ূরী রাত’।
প্রকাশকাল ১৯৯৩, পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৯২।
এটার প্রচ্ছদ পাতা নেই, ছিড়ে গেছে। তবুও পড়া শুরু করলাম –


ঐতিহাসিক নীলকুঠি দেখতে এসে সাংবাদিক
আনিসের প্রেমে পড়ল নীলা।
দিগন্ত-ছোঁয়া দিঘি আর প্রাচীন জমিদার বাড়ির মায়াবী
হাতছানিতে দুটো স্বপ্ন মিলেমিশে একাকার হল।


পরিপার্শ্বের বাধা ছিল অনেক, তবুও নীলা
নিজের সিদ্ধান্তে অটল।
আনিসের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল ওর।


কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা গেল মায়াবী
স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে গেছে।
গভীর রাতে ওদের ঘুম ভেঙে যায় কার পায়ের শব্দে।
জানালার কাচ ভেঙে চুরমার হয়, এগিয়ে আসে
একখানা কালো হাত...


অনন্ত দুঃখনিশায় পরিণত হয় ময়ূরী রাত।




এ পর্যন্ত পড়া তিনটি উপন্যাসের মধ্যে এটাই স্মার্টলি লেখা। গদ্য এবং কাহিনীর বুনটে কৌশল আছে। বিবরণে লেখক ছিমছাম থেকেছেন। লায়লা বানুর সংলাপ বিবরণে ভয় ধরাতে পেরেছেন। এজন্য স্যালুট। ১৯২ পৃষ্ঠার উপন্যাসের চার ভাগের তিনভাগ না পেরুতেই নায়িকাকে মেরে ফেলে লেখক চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। এ চ্যালেঞ্জ পাঠককে ধরে রাখার। বাকী পৃষ্ঠাগুলোয় কেবল খুনের রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। আমি অবশ্য পড়তে গিয়ে টের পাচ্ছিলাম বদরুল কী কী ঘটাতে যাচ্ছে। বদরুল এর চরিত্রটিও ব্যতিক্রম। ঠান্ডা মাথার ভিলেন। টানা আড়াই ঘন্টায় পড়ে শেষ করলাম ‘ময়ূরী রাত’। খন্দকার মজহারুল করিমের দুটো বই পরপর পড়লাম বলেই চোখে পড়লো, নায়িকা তার প্রেম প্রত্যাশী ছেলেটিকে প্রত্যাখান করবে, তার বিবরণে বলা আছে “...সুডৌল পিঠ কখনো ওর দিকে ফেরাতে পারে না”। একজন লেখকের একাধিক বইয়ে একই রকম বিবরণ, সংলাপ, রসিকতা থাকলে পাঠক হিসেবে বিরক্ত হই। এর পরেও স্মার্ট উপন্যাসটিকে পাঁচে চার নম্বর দেবো।


সেবা প্রকাশনীর বইগুলোর নিজস্ব কিছু ভাষা আছে। যেমন ‘শ্রাগ করল’। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাবজেক্ট থাকে বাক্যের শেষে। মাসুদ রানার জন্য এটা মনে হয় স্ট্যান্ডার্ড; যেমন- ঘুরলো রানা, দেখলো ওর দিকে তাকিয়ে আছে সোহানা। ওর/ওঁ/উনি এগুলোও সেবার বইয়ে থাকে। সেবা রোমান্টিকে সাবজেক্টকে বাক্যের শেষে দেয়ার প্রবণতা চোখে পড়লো না। গতমাসে যখন হ্যানরি রাইডার হ্যাগার্ডের ‘এলিসা’ পড়ছিলাম সেবার রূপান্তরে সেখানেও এই একই প্রবণতা দেখেছি।


মাত্র তিনটি বই পড়ে সেবা রোমান্টিক নিয়ে কোনো উপসংহারে যেতে পারছি না।
প্রেমের এ উপন্যাসগুলোকে কেনো ‘রোমান্টিক’ ট্যাগ দেয়া হয় সেটা ভাবছিলাম। হয়তো নায়ক নায়িকার খানিক ঘনিষ্ঠতার বিবরণ থাকে, কোমরে হাত দেয়, ঘাঁড়ে ঠোঁট রাখে, ঠোঁটে চুমু দেয়, বিছানায় নায়িকার পিঠে নায়ক নাক ঘষে, নায়িকা চুল আঁচড়ানোর সময় পিঠে কেমন ঢেউ উঠে তার বিবরণ থাকে – বলেই রোমান্টিক ট্যাগ থাকে। কিন্তু, আমার কাছে মনে হলো এরচেয়ে আরো শরীরি বর্ণনার বই লেখা হয়েছে সাদামাটা উপন্যাস হিসাবে। বইগুলো লেখার সময় ১৯৯৩/৯৫ বলেই হয়তো এমন। এখানকার সেবা রোমান্টিক কেমন হয় সেটাও দেখার দরকার। আরেকটি ব্যাপার হতে পারে পাঠকের বয়স। ক্লাস সেভেনে খন্দকার মজহারুল করিমের (সম্ভবত) লেখা ‘হৃদয়ের কথা’ উপন্যাসে নায়ক নায়িকার ঘনিষ্ঠতার বিবরণ পড়ে যে নিষিদ্ধ আনন্দ পেয়েছিলাম, তা কি এখন সম্ভব! হাহাহা! “নদী বয়ে যায়, তরঙ্গ জানে না সমুদ্র সে কোথায়!”


উপহার হিসেবে বইয়ের কদর সম্ভবত কমছে দিনদিন। সিডি-ডিভিডির দিন এখন। রোকসানা নাজনীনের ‘এ মণিহার’ উলটে দেখলাম বলপয়েন্ট কলমে লেখা, “Rahee জন্মদিনের শুভেচ্ছা Sampa”। এতদিন ধরে এই বই কার কাছে ছিল, কোথায় ছিলো, কে কে পড়েছে? সঙ্গে এ’ও মনে প্রশ্ন জাগলো রাহী সম্পা তারা কারা? ভাই-বোন, বন্ধু, নাকি প্রেমিক প্রেমিকা? কোথায় আছে তারা, কেমন আছে?


.
.
.

Read more...

01 July, 2010

ফিরে যাও নির্বাসন

আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে।
মধ্য রাতের রানওয়েতে মিটিমিটি আলো জ্বলছে। কিছু কাক কিংবা শালিক অথবা অন্য কোনো পাখি অহেতূক উড়ছে এলোমেলো। অনুভূতিগুলো কীভাবে বদলে যায় তা ভাবছিলাম। প্রথম যেবার দেশ ছাড়ি সেবার ঠিক এই সময়ে কষ্ট হচ্ছিলো খুব। প্লেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে নিজেকে ভীষণ দুর্বল মনে হচ্ছিলো। অথচ পালিয়ে যাওয়ার অমন সুযোগ পেয়ে কেনো পিছু ফিরবো - এ ভাবনা আমাকে থামিয়েছিলো। এবার পুরো অন্যরকম। এয়ার-ক্রু’দের যাত্রা শুরুর এ প্রস্তুতি বড়ো দীর্ঘ মনে হয়। মনে হয়, অনেকদিন আমি এভাবে এখানেই বসে আছি অপেক্ষায়। তখন আমার বাম পাশের সীটে এসে বসে সে-ই বুড়ো, মিটিমিটি হাসছে। এ বুড়ো আমার ছায়া ছাড়ে না। অকারণে এসে যন্ত্রণা দিয়ে যায়। অথচ সামিরার সঙ্গে এবার যখন প্রথম দেখা হলো, বিকেলে আমি অপেক্ষায় ছিলাম, সামিরা আসবে কি আসবে না দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম, তখন বুড়োকে মনে পড়ছিলো।

আমি জানতাম সময়টা আসবে একদিন। আমি অপেক্ষা করবো, ঘড়ি দেখবো – কখন সামিরা সুলতানা আমার সামনে এসে বসবে। পাঁচ বছর খুব লম্বা সময় নয়। দেশে ফিরে এক সপ্তাহেই টের পেয়েছি ঢাকা শহর বদলে গেছে অনেক। পালটে গেছে মানুষ। ট্যাক্সি চড়ে বনানী মাঠ পার হওয়ার সময় আমেরিকান বার্গারের দোকানটি চোখে পড়লো না। চোখে পড়লো না আরও অনেক কিছু। কাঁচঘেরা এ তাপ-শীত নিয়ন্ত্রিত ফাস্টফুডের দোকানে বসে আমি সামিরা সুলতানাকে ভাবি। স্মৃতি হাতড়াই, ঠিক এই মুহূর্তটিকে আমি কতোবার কতোভাবে ভেবেছি। কখনো মনে হয়েছে – সামিরা এসে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করবে - কেমন আছো, কখনো মনে হয়েছে – বলবে, জরুরী কাজ আছে, উঠতে হবে এখন। কিংবা আমাকে আসতে বলেও সামিরা সুলতানা আসবে না। বিকেল সাড়ে চারটার পরে ঘড়ির কাঁটা যখন আরও পনেরো মিনিট এগিয়ে যায়, তখন আমার মনে হয় সামিরা আজ আর আসবে না। তাহলে কি বুড়ো আসবে? এসে বলে দেবে - সামিরা আসবে নাকি আসবে না!

বুড়োর সঙ্গে প্রথম দেখা অনেক আগে। টরন্টো পৌঁছে উঠেছিলাম নাসিম ভাইয়ের বাসায়। আমার সারা জীবনের ধারণা ছিলো – বিদেশে মানুষ কষ্ট করে থাকে। কিন্তু, নাসিম ভাইদের অ্যাপার্টমেন্টে যে পাঁচজন বাংলাদেশী তরুণ থাকে, প্রথম তিন রাতে তাদের দেখে মনে হয়নি তারা কেউ কষ্টে আছে। কাজ থেকে ফিরে এক সঙ্গে সিনেমা দেখছে, এনটিভি’তে সকালের খবর দেখে রাজনীতির গুষ্টি উদ্ধার করছে, কল সেন্টার থেকে আসা বিজ্ঞাপনী ফোনের জবাবে ইংরেজীর তুফান ছোটাচ্ছে। সবাই হাসছে, রান্না করছে। এসব দেখে আমার মনে হয়, আমি অনায়াসেই বিদেশে থাকতে পারবো। যে কলেজের অফার লেটারে টরন্টো এসেছিলাম, নাসিম ভাইয়ের পরামর্শে, ১ম সেমিস্টার ড্রপ করলাম সেখানে। আরও সপ্তাহ খানেক পরে, কাজের খোঁজে এখানে ওখানে ঘুরে, শেষে ডাক পেলাম জমজম হালাল শপে মাংস কাটার কাজে। ইন্টারনেট থেকে নেয়া লোকেশনের প্রিন্ট আউট ধরে ডানে বামে যাই। কুইন্স স্ট্রীটে এপাশ ওপাশ ঘুরি, চক্কর দিই বারবার, কিন্তু জমজম হালাল শপ খুঁজে পাই না। ‘জেন্টেলম্যান, ডু ইয়্যূ হ্যাভ এ চেইঞ্জ প্লিজ’ – ডাক শুনে পাশ ফিরে তাকাই। অগাস্টের শেষ সপ্তায় রোদেলা সকাল। এরপরও জ্যাকেট চাপানো দাড়িমুখো বুড়ো। হাতে খালি কফির মগ, ভেতরে কিছু কয়েন। সে কি জানতো যে আমি তারচেয়ে ভালো অবস্থায় নেই! ম্যাপ হাতে জিজ্ঞেস করি, এখানে কোন পথে যাবো…। বুড়ো আমাকে পথ ধরে নিয়ে চলে। জিজ্ঞেস করে - কবে এসেছি, কতোদিন থাকবো; এইসব। এরপরে একটু শব্দ করে হাসে, বলে – ‘তুমি আর কখনো ফিরে যাবে না’। আমার মনে হয় এ যেনো বনবাসে যাওয়া রাজপুত্রের প্রতি নিঝুম অরণ্যে সাধু বাবার ভবিষ্যৎবাণী। জমজম হালাল শপের সামনে এসে বুড়ো আঙুল দিয়ে ভেতর দেখায়। এরপর আমি ধন্যবাদ দিয়ে ভেতরে যাচ্ছি এমন সময় সে আমার শার্টের হাতা ধরে টান দেয়, বলে – ‘পুশকিন স্কয়ার তো ভেঙে গেছে, সেখানে এখন ম্যাকডোনাল্ডস’!

ঢাকায় ম্যাকডোনাল্ডস আসেনি এখনো। হয়তো চলে আসবে। শুনেছি কেএফসি জমেছে বেশ। সামিরার সঙ্গে বাইরে কোনো রেস্টুরেন্টে, শেষবার পিজা হাটেই, খেয়েছিলাম বলে মনে পড়ে। কিন্তু, চেনাজানা দোকান বাদ দিয়ে গুলশানের ভেতরের এমন নীরব গলির মুখের এ ফাস্টফুড দোকানে কেনো সামিরা আমাকে আসতে বললো - তার উত্তর ভেবে পাই না। সাড়ে চারটার পরে পনেরো এবং আরও পরে বিশ মিনিট পার হলে আমার মনে হয় সামিরা আর আসবে না। সামিরার সঙ্গে সাক্ষাতের এ দীর্ঘ প্রস্তুতি ব্যর্থ হলো। কতো কতো সম্ভাব্য প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর নিয়ে যে প্রস্তুতি, নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করা, কিংবা প্রয়োজনে সামিরার কাছে ক্ষমা চাওয়া। কিছুই হলো না। উঠে বেরিয়ে যাবো, এমন সময় – কালো বোরখা ঢাকা একজন আমাকে পাশ থেকে বলে, ‘যাচ্ছো কোথায়, ভেতরে চলো’। গলার আওয়াজে বুঝি – সামিরা। সামিরা সুলতানা। আমার অপেক্ষার সামিরা সুলতানা। দীর্ঘ প্রবাসে, কতো কতো বিষন্ন সকালে, ক্লান্ত দুপুরে, পথ হারানো বিকেলে বা ঘুম ভাঙা রাতে আমি সামিরাকে ভেবে গেছি। অসংখ্য ভাবনার শেষ গন্তব্য-বিন্দু ছিলো – আবার কি আমাদের দেখা হবে! যদি দেখা হয় তবে আলাপ শুরু হবে কী করে, কিংবা কী নিয়ে কথা বলবো আমরা! অনেকবার অনুশীলন করা নাটকের সংলাপ ভুলে গেলে সমবেত দর্শকের সামনে যেমন হয় – আমারও তেমন মনে হচ্ছিলো। সামিরা মাথার স্কার্ফ সরিয়ে আলাপ সহজ করে, ‘তুমি বেশ শুকিয়ে গেছো’। এর জবাবে আমারও এরকম কিছু বলা উচিত। কিন্তু, কালো পোশাক ঢেকে দিয়েছে সামিরার শরীর। আমি দেখতে পাই না, তাই বলতেও পারি না সামিরা শুকিয়েছে নাকি মোটা হয়েছে…। আমার চোখ বারবার সামিরার ঘাড়ে চলে যায়। সরানো স্কার্ফ পেঁচিয়ে আছে ঘাড়ে, ছয় বছর আগে আমার জীবনের প্রথম চুমু ছিলো সেখানে।

নেলী প্রথমবারই আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলো। হাত দিয়ে তার ঘাড় থেকে আমার তৃষ্ণার্ত মুখ সরিয়ে বলেছিলো – ওখানে নয়, ওভাবে নয়। বুলগেরিয়ার মেয়ে নেলী নিকোলোভার সঙ্গে পরিচয় জমজম হালাল শপে। বিশাল মাংসের স্তুপের সামনে প্রথম ছুরি হাতে আমি বুঝে গিয়েছিলাম, এ অনেক কঠিন কাজ। বারবার আমার নিশানা ভুল হয়। কখনো প্রয়োজনের চেয়ে জোরে কোপ মারি। হাড্ডিগুলো এবড়োথেবড়ো হয়ে যায়। তবুও আমি হাল ছাড়ি না। প্রতিদিন নতুন নতুন করে কায়দা শিখি। গরুর পেছনের রানের মাংস কাটার সময় লম্বালম্বি আর সামনের রানের সময় পাশাপাশি করে ধরতে হবে, এসব আমাকে নেলীই শিখিয়ে দেয়। আগ্রহের কমতি নেই দেখে নেলী নিজে এগিয়ে আসে, বলে – ওখানে নয়, ওভাবে নয়। তারপর নিজে ছুরি হাতে দেখায় কোন জায়গাটায় কীভাবে কাটতে হবে...। বুড়োর কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। এক সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফেরার পথে বুড়ো আমার পথ আগলে দাঁড়ায়, বলে – পুশকিন স্কয়ারের চায়ের দোকান আর নেই, সেখানে এখন ম্যাকডোনাল্ডস। আমার চোখে তখন ভীষণ ক্লান্তি, ঘরে ফেরার তাড়া। তবুও বলি – ‘পুশকিন স্কয়ার ভেঙে গেলে তোমার কী?’ বুড়ো আমার চোখে চোখে খেলা করে, ‘আমার কিছু নেই, তবে তোমার আর দেশে ফেরা হবে না’। এবার বুড়োকে আর সাধুবাবা মনে হয় না। মনে হয় – সেদিন আমার টেনশন ছিলো, চাকরি খোঁজার তাড়া ছিলো, তাই বুড়োর কথাকে ভবিষ্যৎবাণী মনে হয়েছিলো। আসলে, এ বুড়ো নিতান্তই পাগল – ভবঘুরে ভিক্ষুক, আমাকে ভড়কে দেয়ার চেষ্টা করছে...।

খুব আশ্চর্যজনকভাবে খেয়াল করি, সামিরা আমাকে ভড়কাচ্ছে না। অথচ এর আগে যতোবার সামিরার সঙ্গে সাক্ষাতের কল্পদৃশ্য ভেবেছি, মনে হয়েছে – সামিরা আমাকে নার্ভাস করে দেবে। আমাকে চমকে দেয়ার, তুচ্ছ করার, কাছে টানার কিংবা ছুঁড়ে ফেলার একটি কঠিন অস্ত্র তার হাতে আছে। এ ভয়াল অস্ত্রটি কারও বানানো ছিলো না। একদিন এক দুপুরে খেয়াল করেছিলাম সামিরা এ অস্ত্র হাতে আমার দিকে চেয়ে আছে, আর আমি মুষড়ে যাচ্ছি ক্রমশ। সেই থেকে শুরু - সামিরা আমাকে প্রভাবিত করে, আমি ভীত হই, পালাই। প্রথম প্রথম কেবল সামিরার কাছ থেকে পালানো। কিন্তু, এরপরে যখন, উপায় থাকে না, নিজের কাছ থেকে পালাতে ইচ্ছে করে, তখন আমি নাসিম ভাইকে ফোন করি। ভিসা পেয়ে ঢাকা-দুবাই-টরন্টোর এয়ার টিকিট কিনতে তিন মাস সময় লেগেছিলো। ঠিক যেদিন দেশ ছাড়ি সেদিন থেকে শুরু করে গত পাঁচ বছরের সব গল্প সামিরার জন্য জমা। অসংখ্য দিনের, স্মৃতির, কষ্টের, কিংবা অনুতাপের গল্প আমি করতে পারি – যদি সামিরা সুলতানা মনোযোগী শ্রোতা হয়, যদি বলে তার তাড়া নেই। এই আকাঙ্খা কিংবা অনুমান আমার প্রকাশ করা হয় না। ভেজিট্যাবল রোলে কামড় দিয়ে লেমন জুসে চুমুক দিচ্ছি, তখন মুখোমুখি সামিরা – তার হাতে অরেঞ্জ জুস। নীরবতা ভেঙে সামিরা জিজ্ঞেস করে, ‘ক’দিন থাকবে দেশে?’ আমি বলি, ‘ঠিক নেই। হয়তো একমাস কিংবা তিনমাস, অথবা আগামী সপ্তাহ’। সামিরা মাথা নাড়ে। আমার তীব্র আশা ছিলো, সামিরা জিজ্ঞেস করবে, ‘আগামী সপ্তাহ কেনো’; অথচ জিজ্ঞেস করে না। আমি টের পাই, সে-ই পুরনো অস্ত্র এখনো তার হাতে। অনেক সময় নীরব থেকে এ অস্ত্রের কারিশমা সে প্রকাশ করতে পারে। কথা চালু রাখতে আমি স্বাভাবিক থাকি, জিজ্ঞেস করি – ‘বাসার সবাই ভালো আছে?’ সামিরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। আমার এ প্রশ্নের ভেতরে আরও যে প্রশ্নটি লুকিয়ে আছে, যে প্রশ্নের উত্তর জানতে আমি নিজের সঙ্গে নিজে অবিরাম হুটোপুটি খেলেছি দুঃস্বপ্নে তা কি সামিরার জানা আছে? আমি ঐ প্রসঙ্গে আর যাই না, মনে কেবল একটিই ভয় - সেই পুরনো অস্ত্র। নীরবতা। সামিরা যেমন নীরব হয়ে গিয়েছিলো, আর আমি টের পেয়েছিলাম – ভয়াল এক অস্ত্রের মালিক সে হয়ে গেছে। ঐ অস্থির ঘুঘু ডাকা দুপুরে, যখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – ‘তুমি রাগ করেছো?’ এর উত্তরে সামিরা কিছুই বলেনি। ভেবেছিলাম, হয়তো সে হাসবে, লজ্জা পাবে, কিংবা অনুতপ্ত হবে; যার স্পষ্ট প্রকাশ আমি তার চেহারায় দেখতে পাবো। কিন্তু ওসব কিছুই হয় নি। ‘তুমি রাগ করেছো?’ প্রশ্নের উত্তরে সে হু হু করে কেঁদেছে। আমি অপেক্ষায় ছিলাম আরও কিছুক্ষণ। কান্না থেমেছিল এক সময়। কিন্তু, এরপর ভয়ানক নীরব ছিলো সামিরা। মধ্য দুপুরের বিরান মাঠের মতো নীরব। আদালতে খুনের আসামীর বিচারের রায় ঘোষণার আগ মুহূর্তের মতো নীরব।

নেলীর ধারণা ছিলো – ভীষণ গোপন কষ্ট না থাকলে, আমার বয়েসী কোনো ছেলে এমন নীরব থাকে না। তুষার পড়া দিনে বরফ মাড়িয়ে আমরা কফি শপে বসি। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি, আমার নিজস্ব জগতে নেলী প্রবেশের সুক্ষ্ম চেষ্টা করছে। এ চেষ্টার শুরু কবে কোনদিন থেকে তা আমার জানা নেই। তবে, যেবার আমি বেখেয়ালে ছুরির কোপ নিজের কব্জিতে বসিয়ে দিলাম, রক্তে মাখামাখি হয়ে গেলো আমার হাত আর খাসির শিনার মাংস - সেবার নেলীর উৎকন্ঠা দেখে আমি টের পেয়েছিলাম, আরও একটি ভুল আরও একটি মেয়ে করতে যাচ্ছে। এই সম্ভাব্য ভুলের চিন্তা আমার মাথায় কিরকির আওয়াজ তোলে, হয়তো এ কারণেই কেটে যাওয়া কব্জির ব্যথা খুব ক্ষীণ মনে হয়। মনের ভেতর এ সিদ্ধান্ত জাঁকিয়ে বসে, আর যা-ই হোক নেলীকে এ ভুল করতে দেয়া যাবে না। নেলী নিকোলোভাকে ভুল থেকে বাঁচাতে আমার অতি সতর্কতা আরও নীরবতা নামায় আমার মধ্যে। নেলী জিজ্ঞেস করে, কী এমন গোপন কষ্ট আমার! আমি নেলীর কাছে মিথ্যে বলি, বলি – প্রকাশ্য কিংবা গোপন বলে কিছু নেই - আমি এমনই - বলতে নয় কথা শুনতে ভালোবাসি। সে আমাকে বুলগেরিয়ান গোলাপ কাজানলাস্কা রোজার গল্প বলে। ছয় বছর বয়সে পাশের বাড়ির ছেলেটি তাকে কাজানলাস্কা রোজা বলেছিলো, এ স্মৃতিকাতরতায় বিহবল হয় সে। আমি আরও আগ্রহী হই, বলি – তারপর? নেলীর আর কিছু বলার নেই, ঐ একটি গল্পই সে বলে বারবার। সাত বছর বয়সে কানাডায় পাড়ি জমায় তার পরিবার, তাই বুলগেরিয়ার স্মৃতি বেশি নেই। মূলতঃ দুজনের গল্পহীনতার কারণেই আমরা অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসি। আমাদের কফিশপ মহূর্তগুলো প্রলম্বিত হয় শেষ ট্রেনের অপেক্ষায়। সারাদিন কাজ করে, বরফ জমানো দিনে কফি চুমুক শেষে, আমরা উলটো পথে বাড়ি ফিরি প্রতিদিন। দিনে দিনে বরফ গলে, আকাঙ্খিত গ্রীষ্মের রোদ শেষে আরও এক শীতের শুরুতে ঝড় নামে এক শনিবার রাতে। নেলী আমার হাত ধরে বলে, ‘আজ আমার বাসায় চলো’।

রিন্টুরা আমাকে নিতে চায়নি। শেষ মুহূর্তেও নাফিজ ‘আয়্যাম শিউর – দিস ফাকিং লুজার উইল মেস এভরিথিং...’ বলে আমাকে রেখে যেতে চেয়েছিলো। আমি নীরব ছিলাম। কারণ, আমি চোখে দেখতে চেয়েছিলাম – রিন্টুদের গল্পগুলো কতোটুকু সত্য। এরা আমার বন্ধু, এবং বন্ধুর বন্ধু - সবাই গুলশানে থাকে, বনানীতে ক্লাস শেষে উত্তরায় লাঞ্চ করে, ধানমন্ডিতে জিমে যায়, আর বারিধারায় প্রেম করে। এরা পড়ালেখার কোর্সকে ক্রেডিট বলে, ভার্সিটির টিচারকে বলে ফ্যাকাল্টি। আমাদের খিলগাঁও মডেল কলেজ কিংবা তিলপাপাড়া মহল্লায় এসব ভাষার প্রচলন নেই। তাই সুন্দরী মেয়ে মানে কুল নাকি হট এ বিভ্রমে চক্কর খাই আমি, নীরব থাকি। সেদিন শেষ মুহূর্তে রিন্টু আমাকে নেয়, জিজ্ঞেস করে – ‘ভয় পাবি না তো?’ প্রবল আগ্রহে আমি সাহসী হই, বলি – ‘না, ভয় পাবো না’। ঘুষখোর বাবার কেনা লেক্সাস-জিএস থ্রি-হান্ড্রেডে নাফিজ আমাকে সামনে বসায়। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলে – কিপ কুল, বি কোআয়েট। রিন্টু-লিটন অন্য গাড়িতে, অন্যপথে। আমি চুপচাপ বসে থাকি। সিডি প্লেয়ারে – ইয়েলো ব্রিক রোড, দ্য ওয়ে আই এম; এমিনেম চিৎকার। মুখে চুইংগাম চিবিয়ে নাফিজ মাথা দুলাচ্ছে। এয়ারপোর্ট রোড ধরে গাড়ি ছুটছে...। আরও পরে বামে এবং ডানে, তারপরে আবার বামে ও কিছুটা সামনে গিয়ে মোড় ফিরতেই সাদা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে এসে নাফিজ গাড়ি থামিয়ে ফোন দেয়। হালকা ক্রীম কালারের টপস আর কালো স্কার্ট পরা কিশোরী বেরিয়ে আসে। আমি সীট বদলে পেছনে গিয়ে বসি। কিশোরী সামনে, নাফিজের পাশে। এরপর গাড়ি আরও চক্কর দেয়, উত্তরা দুই অথবা তিন, পাঁচ অথবা ছয় নম্বর সেক্টর পার হয়। এসব জায়গা আমার অচেনা, তাই কোন গলি পেরিয়ে গাড়ি আবার এয়ারপোর্ট রোডে ওঠে তা আমি বুঝি না। রিন্টু বলেছিলো, এমনই হয় – একজন গিয়ে নিয়ে আসে, বাকীরা অপেক্ষায় থাকে। এই প্রথম আমি রিন্টুর গল্পগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করি। আমার মনে পড়ে – কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় রিন্টুরা যখন খিলগাঁও ছেড়ে গুলশানে চলে আসে, আমাকে বলেছিলো – ঐদিকে লাইফের একটা ক্লাস আছে, স্ট্যান্ডার্ড আছে। নাফিজের গাড়ি বনানীর নিরিবিলি গেস্ট হাউজের পার্কিং লটে এসে থামলে আমার মনে হয় – রিন্টুদের জীবনে সত্যি উল্লাস আছে, স্বাধীনতা আছে। লিফটের বাটন টিপে তিন অথবা চার তলার রুমে যাওয়ার আগ মুহূর্তে আমি আবার ভীরু হয়ে উঠি। আমার জ্বর জ্বর লাগে, গায়ে কাঁপুনি আসে। তারপর এক রুমে দরজা খুললে ভেতরে রিন্টু এবং লিটনকে দেখতে পাই। টেবিলে চিভাস রিগ্যাল আর বিদেশি চিপস। নাফিজ পরিচয় করায় – ‘শী ইজ ফারিহা, আওয়ার হোস্ট টুডে’। আমি এই প্রথম নাম জানি তার – ফারিহা। ওরা হ্যান্ডশেক করছে, পরিচিত হচ্ছে। আমি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। কার্ণিশে পড়ন্ত বিকেল। ফারিহা অবাক হয় – ‘ইয়্যু গাইজ ওয়্যার সাপোসড টু বি টু। হোয়াই ফোর?’ নাফিজ বোঝানোর চেষ্টা করে, আঙুল তুলে আমাকে দেখায় – ‘দ্যাট বয় ইজ গন্যা লীভ আস সুন’। ফারিহা চিৎকার করে – ‘আমাকে দু’জনের কথা বলা হয়েছে, নট থ্রি!’ লিটন এবার উঠে আসে, ফারিহার কাঁধে হাত রাখে – ‘ইয়্যূ আর সো হট, সুইটি’। এরপরও ফারিহার চিৎকার থামে না। নাফিজ পথ আঁটকায়, উঁচুস্বরে ধমক দেয় – ‘একদম চুপ, একটাও শব্দ নয়’। তখন আমার কী হয় জানি না, সবাইকে সরিয়ে হুট করে দরজা খুলে দিই, বলি – ‘ওকে যেতে দাও’। আমার কথা শুনে উঠে আসে রিন্টু। ভীষণ ভারী ঘুষি বসিয়ে দেয় আমার চোয়ালে – ‘ইয়্যূ মাদা-ফাকা, শাট আপ’! ওপাশ থেকে লিটন এসে দুমদুম লাত্থি দেয় আমার বুকে-তলপেটে, তারপর রিন্টু সজোরে চিভাসের বোতল ছুঁড়ে মারে আমার গায়ে। আমি প্রবল ব্যথায় মেঝেতে এক কোণায় দেয়ালে মুখ করে গুটি মেরে শুয়ে থাকি। ক্রমশ বন্ধ হওয়া চোখে দেখি – মেঝেতে আমারই আশেপাশে ফারিহার কালো স্কার্ট। ততক্ষণে নাফিজ হারিয়েছে ফারিহাকে, জিততে চলেছে রিন্টু এবং লিটন। আমার উঠতে ইচ্ছে করে, কিন্তু উঠতে পারি না। মনে হয় – এক ডুব সাঁতারে নেমেছি আমি, পানির নিচে শুনতে পাচ্ছি উপরের মানুষের সমবেত চিৎকার - করতালি। তখন আমার অমন ঘুম পেলো কেনো...!

ঘরে তৈরি ডিনার শেষে নেলী আমাকে জিজ্ঞেস করে – ‘এখনই ঘুমোবে?’ আমি হাই তুলি, বলি – ‘হুম ঘুম পাচ্ছে’। গায়ে গাউন চাপিয়ে নেলী আমার পাশে এসে বসে। আমি সে-ই বুড়োর গল্প বলি, জিজ্ঞেস করি – পুশকিন স্কয়ারের চায়ের দোকান ভেঙে ম্যাকডোনাল্ডস হওয়া মানে কী? নেলী হাসতে থাকে, আমার হাতের আঙুল নিয়ে খেলা করে। বলে - ঐ বুড়ো রাশিয়ান, মস্কো থেকে এসেছিলো রিফিউজি হয়ে, এখনো কম্যুনিজমের স্বপ্ন দেখে আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিক্ষা করে। আমি নেলীকে বলি, মাংসের দোকানের কাজ আমার আর ভালো লাগে না, আমিও ঐ বুড়োর মতো – ভিক্ষা করবো। নেলী অবাক হয় কিনা জানি না, তবে মুহূর্তেই ‘আমাকেও নিয়ো সঙ্গে’ বলে আমার কপালে চুমু বসিয়ে দেয় সে। এ ঘটনার আকষ্মিকতায় আমি চুপ মেরে যাই। এরপর নেলী আমার চুলে বিলি কাটে। বুলগেরিয়ান গান শুনবো কিনা জিজ্ঞেস করে। এমন শরীরি ঘনিষ্ঠতা অসহ্য লাগে আমার। বুক ধুকধুক করে। গায়ে প্রবল কাঁপুনি আসে। আমি নেলীকে বলি, ‘ঘরের হিটারটা বাড়িয়ে দাও, আমার শীত করছে’। এপার্টমেন্টের অটো কন্ট্রোলড হিটার বাড়ানোর বা কমানোর সাধ্য তার নেই। তাই আমার কাঁপাকাঁপা গায়ে নেলী চাদর চাপিয়ে দেয়, সাথে নিজেকেও। এমন উষ্ণতায় আমার দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। কিন্তু তুষার ঝড়ের রাতে এ উষ্ণতা ছেড়ে রাস্তায় বেরুতে ইচ্ছে করে না। বরং টের পাই – কখন আমার হাত দুটোও দ্রুত চঞ্চল হয়ে উঠেছে। খুলে নিচ্ছে লাইট-পিংক ভিক্টোরিয়াস সিক্রেট। আরও পরে আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁট নেলীর ঘাড়ে গেলে সে হাত দিয়ে সরিয়ে দেয় – বলে, ওখানে নয়, ওভাবে নয়...।

ঘুম নয়, আমি অজ্ঞান হয়েছিলাম। সম্বিৎ ফিরে এলে, অনেক কষ্টে দাঁড়িয়ে দেখি বিছানায় কাত হয়ে পড়ে আছে ফারিহা। আর কেউ নেই। বাইরে রাত নেমেছে। আমি ফারিহার গায়ে ধাক্কা দিই, ডাকি। সাড়া নেই। রিন্টুকে ফোন করি, তার মোবাইল বন্ধ। কী করবো ভেবে পাই না। আরও পরে ফারিহা চোখ খোলে, বিড়বিড় শব্দ করে, খাটের ওপাশে পড়ে থাকা মোবাইল ফোন দেখিয়ে, বলে - সামিরা আপু। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘সামিরা আপুকে ফোন দেবো?’ বিধ্বস্ত ফারিহা কী বলে বুঝি না, তবে আমি ফোনবুক সার্চ করে সামিরা আপুকে ফোন দিই। সংক্ষেপে বলি – ফারিহা এখানে, নিরিবিলি গেস্ট হাউজ বনানী, রুম নম্বর...। আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সামিরা আপু বুঝে নেয় অনেক কিছু। মিনিট চল্লিশেক পরে পরিপাটি সালোয়ার কামিজ – মাথা ঢাকা ওড়নায় সামিরা নামের এক তরুণী এসে কড়া নাড়ে। ফারিহাকে দুপাশে দুজন ধরে গাড়িতে তুলি। সামিরার বাসার গেটে পৌঁছলে আমাকে বিদায় জানানো হয়। গাড়ী থেকে নামার মুহুর্তে সামিরা আমার ফোন নম্বর চেয়ে নেয়। সে রাতে আমার ঘুম হয়নি। মাঝরাতে কোথাও সাইরেন বাজিয়ে এম্বুলেন্স চলে গেলে আমার মনে হয় – একদল পুলিশ আমাদের তিলপাপাড়া মহল্লা ঘিরে রেখেছে, আমাকে এরেস্ট করে নিয়ে যাবে – আর শতশত মানুষ দেখবে সে দৃশ্য। এরকম দুঃশ্চিন্তায় আমার ঘুম ভেঙে গেছে পরের আরও তিন রাত। চতুর্থ রাতে সাইরেন কিংবা হুইসেলের শব্দে ঘুম ভাঙলে দেখি আমার মোবাইলে রিং হচ্ছে। সামিরা সুলতানা। আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় সে। আমি ভয় পাই, সকাতরে জানাই – আমি ফারিহাকে হেল্প করতেই চেয়েছিলাম। সামিরা অভয় দেয়, ফারিহা বলেছে সব, আমার কোনো দোষ নেই। এরকম আরও কয়েকবার ফোন আলাপ শেষে আমি সামিরা সুলতানার সঙ্গে দেখা করি। ফারিহার কাজিন সামিরা সুলতানা, সাত মসজিদ রোডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্রী। এরপরে আরও বেশ কয়েকবার দেখা হলে, আল-বাইকে বসে চিকেন উইংয়ে কামড় দিতে দিতে সামিরা জিজ্ঞেস করে – আমি কেনো নিরিবিলি গেস্ট হাউজে গিয়েছিলাম। এ প্রশ্নের উত্তর যতোটা সহজভাবে জানি, ততটা কঠিন লাগে প্রকাশে। আমার এ দ্বিধা – প্রকাশ্য অস্পষ্টতা ও ভীরু চাহনিতে সামিরা হয়তো বুঝে গেছে – আমি নির্বিষ প্রকৃতির ছেলে, আমার ওপর নানা কারণে আস্থা রাখা যায়। তাই আমার সঙ্গে যোগাযোগে এক রকম নিরাপদ বোধ করে সে। আমিও সামিরাকে সঙ্গ দিই – রাপা প্লাজায়, মেট্রো শপিংয়ে কিংবা আড়ং-এর শো পিস সেকশনে। এমন চার অথবা পাঁচ মাস গেলে আমি একদিন ভয়ে ভয়ে সামিরাকে জিজ্ঞেস করি – ‘ফারিহা কেমন আছে?’ জবাবে সামিরা জানায় – লন্ডন চলে গেছে সে, মায়ের কাছে। এ সংক্ষিপ্ত উত্তর আমার জানার আগ্রহ মেটায় না। তবে অনুমান করে নিই, ফারিহা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে, এতদিন বাবার কাছে থাকতো। ইংরেজী স্কুলে পড়ার কারণে নিয়ন্ত্রণহীন জীবন ছিলো তার, যেমন ছিলো এবং আছে নাফিজ-লিটন-রিন্টুদের। এখন মায়ের কাছে ফিরে গেছে ফারিহা। আবার এমনও মনে হয় – ফারিহা এ শহরেই আছে, সামিরা আমাকে মিথ্যে বলেছে। তবে আমি এই সত্য-মিথ্যা উদ্ঘাটনে যাই না। বরং ভালো লাগে, সামিরার সঙ্গে আমার একরকম বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে আমি তখন সামিরাদের ধানমন্ডির বাড়িতেও যাই। হিন্দি সিনেমা এবং ক্রিকেট নিয়ে আলাপ করি। কয়েক মাসে আপনি থেকে তুমিতে নেমে – সামিরা আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কখনোই কোনো মেয়ের হাত ধরোনি?’ আমি উত্তরে বলি, ‘এখনো না’। সামিরা কোনো ছেলের হাত ধরেছে কিনা সে প্রশ্ন আর করা হয় না। ততক্ষণে নিজের হাতে আমার হাত তুলে নিয়েছে সামিরা।

বুড়ো আমার পথ আগলে রাখে। বলে, উত্তর তোমাকে দিতেই হবে, বলো – কেনো পুশকিন স্কয়ার ভেঙে গেলো। আমি বুড়োকে ধাক্কা দিই, পথ ছাড়তে বলি। কিন্তু না, বুড়ো পথ ছাড়বে না। আমার কারণেই নাকি পুশকিন স্কয়ারের চায়ের দোকান ভেঙে গেছে, সেখানে এখন জমজমাট ম্যাকডোনাল্ডস। অতএব শাস্তি আমাকে পেতেই হবে। হাত ধরে আমাকে বুড়ো নিয়ে যায় ট্রেন স্টেশনে। অন্ধকার সে আন্ডারগ্রাউন্ড। বুড়ো আমাকে নির্দেশ দেয়, রেল লাইনে শুয়ে থাকতে হবে। আমি উঠতে চাই, কিন্তু পারি না, বুড়ো লাঠি হাতে আমাকে ভয় দেখায়। দূর থেকে ট্রেন আসছে, আমার গায়ের ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাবে, এমন সময় মনে হয় আরও দূর থেকে করুণ স্বরে কে যেনো ডাকছে আমাকে, তাই আমি সরে যাই। গা ঘেঁষে ট্রেন চলে গেলে বুড়ো আমাকে ধমক দেয় - কেনো সরলাম আমি। আমাকে মারতে চায় সে। আমি ভয়ে হাসফাঁস করি। নেলী আমাকে জড়িয়ে ধরে হাল্কা ঝাঁকুনি দেয়, জিজ্ঞেস করে – ‘দুঃস্বপ্ন দেখছিলে?’ আমি উঠে বসি। জানালার পর্দায় সফেদ আলো। বাইরে সকাল হয়ে গেছে। বলি – বাসায় ফিরবো, ভালো লাগছে না। নেলী কফি করতে চায়, কিন্তু আমার ইচ্ছে করে না। দ্রুত নেলীর বাসা থেকে বেরিয়ে আসি। পথে সেই বুড়ো এবার সত্যি সত্যি আমার পথ আঁটকায়। রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে – ‘তোমার আর কখনোই দেশে ফেরা হবে না’। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কেনো?’ বুড়ো আর জবাব দেয় না। পুশকিন স্কয়ার নিয়েও কিছু বলে না। রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে রাখে মুখে, চোখের ভুরু ওঠানামা করায়। যেনো আমাকে জিজ্ঞেস করছে – ‘নেলীকে তুমি ভালোবাসো?’ এই প্রথম আমি গত রাতের জন্য অপরাধবোধে ভুগি। আমার মনে পড়ে সামিরার নীরবতার কথা। সেই এক মৃত দুপুরে সামিরার বাসায় আমাদের হঠাৎ জেগে ওঠার কথা। এপ্রিলের প্রচন্ড গরমের সে দুপুরে হঠাৎ কোত্থেকে এক ঘুঘু এসে সামিরার জানালায় বসেছিলো। আমাদের দিকে তাকিয়ে ডেকে চলেছিল বিরামহীন। মুহূর্তগুলো আরোপিত ছিলো না বলে, কোনো পক্ষ থেকে অসম্মতি ছিলো না বলে – অনায়াসে আমি সামিরার ঘাড়ে চুমু দিয়েছিলাম তখন। সাদামাটা একটি মৃত দুপুর এভাবে আমাদের জীবনে অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠে, তাই এতদিন পরেও মনে পড়ে সেই ঘুঘুর ডাক। আর ঘুঘু-ডাকা দুপুরে আমার সমাপনী জিজ্ঞাসা - ‘তুমি রাগ করেছো?’ যার উত্তরে সামিরা কিছুই বলেনি। হু হু কান্না শেষে অস্বাভাবিক নীরবতায় ডুব দিয়েছিলো সে। ঐ নীরবতায় সামিরার ব্যক্তিগত আদালতে আমার মৃত্যুদন্ড ঘোষিত হয় সেদিন।

সামিরার নীরবতার মধ্যেও পারষ্পরিক যোগাযোগ এবং যাতায়াত ছিলো অনিয়মিত। কেবল সাক্ষাতের উষ্ণতাটুকু ছিলো না। ঘুঘু-ডাকা দুপুরের পরে, হয়তো মাস দেড় দুই পরে, এক বিকেলে সামিরা ফোন করে বলে – ‘আয়্যাম এক্সপেক্টিং’। এ দুটো শব্দ আমাকে বিহবল করে তোলে। অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত সময়ের সামনে আমি দাঁড়িয়ে। মাথার ভেতর হাজারো শব্দে বিচরণ করেও আমি বলার মতো কোনো বাক্য খুঁজে পাই না। সামিরার নীরবতা এবার আমাকে গ্রাস করে। আমাকে দু’দিন ভাবার সময় দেয় সে – ‘বিয়ে করবে কি করবে না বলো’। পরীক্ষার খাতায় জটিল ক্যালকুলাস মেলানো আমার একুশে মাথায় এ বড্ডো ধাঁধাময় মনে হয়। আমার চারপাশ কেবলই শুন্যতায় ভরে ওঠে। পরামর্শের জন্য ছুটি রিন্টুর বাসায়। সেখানে নাফিজ এবং নীল শার্ট পরা অচেনা এক তরুণ আমার কথা শুনে হো হো শব্দে হেসে ওঠে। নাফিজ খ্যাসখ্যাস গলায় বলে – ‘দ্যাট স্লাট হ্যাজ মেইড ইয়্যূ এ ভিক্টিম’। পাশের নীল শার্ট পরা অচেনা তরুণ সম্মতি দেয়, সামিরা তার অনেক দিনের চেনা। আমার ভীরুতা, মানসিক দূর্বলতা এবং সামগ্রিক অক্ষমতা আমাকে সাহস জোগায় নাফিজের কথায় বিশ্বাসী হতে। পরদিন সামিরার প্রশ্নের জবাবে ফোনে চিৎকার করি, ‘ইয়্যূ ব্লাডি ফ্রীক প্রস, গো টু হেল – ডোন্ট ট্রাই টু রুইন মাই লাইফ’। এ কথা শুনে সামিরা নিঃশব্দে ফোন রেখে দেয়। আমি তখন বিড়বিড় করি, না – এ কথা আমি বলতে চাইনি। আমি অন্য কিছু বলতে চেয়েছিলাম। অথচ কী বলতে চেয়েছিলাম তা আমার জানা নেই। সামিরাকে আর ফোন করিনি, কারণ আমি তার থেকে আড়ালে থাকতে চেয়েছি। কিন্তু, এভাবে আরো দিন গেলে টের পাই – আমি আসলে আমার নিজের কাছ থেকে পালাতে চাইছি। এ চেনা শহর, শহরের খিলগাঁও তিলপাপাড়া মহল্লা, এই কোলাহল, এই মুখরতা আমার ভালো লাগে না। আমি দেশ ছাড়ার প্ল্যান করি, কানাডায় নাসিম ভাইকে ফোন করি।

জমজম হালাল শপে কাজ করে প্রথম মাসে যেদিন বেতন পেলাম, সেদিন দেশ থেকে রিন্টুর মেইল পাই – সামিরা তার বাবার বন্ধুর ছেলেকে বিয়ে করেছে। এলিফ্যান্ট রোডে কম্পিউটার এক্সেসরিসের ইম্পোর্টার ব্যবসায়ী পাত্র। কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্রী সামিরা সুলতানার কম্পিউটার ব্যবসায়ী বর এবং তাদের সুখী জীবন কামনা করে সেই সন্ধ্যায় আমি কিছুটা নির্ভার হই। কিন্তু, একটি প্রশ্নের উত্তর আমার জানা হয় না। গত সপ্তায় দেশে নেমে তিনদিনের মাথায় সামিরাকে যে প্রশ্ন করতে ফোন করেছিলাম, কিন্তু সাহসের অভাবে করতে পারিনি, সে প্রশ্ন এবার আমি সামিরাকে করবো কিনা ভাবি। গুলশানের এ নীরব ফাস্টফুড দোকানের কোণার টেবিলে তখন কেবল আমরা দুজন মুখোমুখি। অনেক নীরবতা শেষে সামিরা যখন বলে – ‘এবার আমাকে যেতে হবে’ তখন আমি কাঁপাকাপা গলায় জিজ্ঞেস করি, ‘বাচ্চাটি কেমন আছে?’ এ প্রশ্ন শুনে সামিরা ভীষণ সরাসরি আমার চোখে চোখ রাখে। হয়তো রাগের তীব্রতায় সে নিজের ঠোঁটে কামড় দেয়। কয়েক মুহুর্ত নীরবতায় স্থির থাকে। তারপর ভারী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে বলে – ‘দ্যাট বাস্টার্ড ওয়াজ এবর্টেড’। এ উত্তর আমার কাছে চমকের কিছু মনে হয় না। কারণ, গত পাঁচ বছরের অনেক অনেক সম্ভাব্য অনুমানে এ উত্তরটিও ছিলো। তাই আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি। এক সময় ‘ভালো থেকো’ বলে সামিরা বিদায় নেয়। এরপর আরও সময় যায় সে সন্ধ্যায় এবং রাতে। আমি কেবলই অনুভব করি – কঠিন এক প্রশ্নের উত্তর আমি জেনে গেছি। আমার আর কিছু জানার নেই, সামিরার এ উত্তরের পরে আমি এক অন্যরকম ছুটি পেয়ে গেছি। এবার বরং গত পাঁচ বছরে আপন হয়ে ওঠা অচেনা শহরটিতেই ফেরা যাক। নেলী নিকোলোভার কাছে কাজানলাস্কা রোজার গান শোনা যাক। তাই আমি আবার দেশ ছাড়ার দিনক্ষণ ঠিক করি...।

ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্রপেলার যখন চালু হচ্ছে, যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি শেষের দিকে। আমি রানওয়ের কাক-শালিক কিংবা অন্য কোনো পাখি দেখছি, প্রথমবার দেশ ছাড়ার অনুভূতিগুলো ভাবছি, তখন সেই বুড়ো আমার কাঁধে ধাক্কা দেয়। মিটিমিটি হেসে বাংলায় বলে – ‘বাচ্চাটি বেঁচে আছে এখনো’। শুনে আমার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে। মনে হয় – প্লেনের সমূহ ইঞ্জিন আমার মাথায় ঢুকে যাচ্ছে। যেনো আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেছে, পা নাড়তে পারছি না। ঘাড় পিঠ টানটান শক্ত হয়ে আছে, আবার মনে হয় - কিরকির শব্দে মাথা ছিঁড়ে আলাদা হয়ে ওপরের দিকে উড়াল দেবে এক্ষুণি। এরকম অসহ্য যন্ত্রণায় নিজেকে খানিক সামলে কিছু একটা বলতে পাশ ফিরলে দেখি – সেখানে কেউ নেই। সৌম্য স্মিত চেহারার এয়ার-ক্রু আমার সামনে দাঁড়িয়ে -‘স্যার, সীট বেল্ট বেঁধে নিন- প্লিজ’ । আমি তার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করি – পুশকিন স্কয়ার ভেঙে গেছে, সেখানে এখন ম্যাকডোনাল্ডস।

Read more...

05 May, 2010

পাঠ প্রতিক্রিয়া - ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প


গল্পকার নামে আমরা যাদের চিনি তারা কতোটা গল্প লেখেন আর কতোটা গল্প বলেন – এ প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত পাঠকের দরবারেই ছেড়ে দিতে হবে। পাঠকই নির্ধারণ করবেন - কতোটা পথ সঙ্গী হতে পেরেছে লেখকের গল্পবয়ান, কতোটা চেনাজানা হয়ে উঠেছে গল্পের ভেতরের মানুষগুলো। আর গল্পকার যখন তার কিছু গল্প মলাট বন্দী করে পাঠকের হাতে তুলে দেন, তখন তার অবস্থা হয় সেই তীরন্দাজের মতো যে কিনা তাকিয়ে থাকে, ছুঁড়ে দেয়া তীরে নয়, ঘিরে থাকা দর্শকের স্থির হওয়া চোখের ভাষা সন্ধানে। বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখক মাহবুব আজাদ তাই বলেছেন – “পাঠকের আয়নায় নিজের বিম্ব দেখতে চাইছি, তাই পাঠকের পাঠপ্রতিক্রিয়ার প্রত্যাশী হয়ে থাকবো।” আলোচ্য বইটির নাম – ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প।

বাংলা ছোটগল্পের ছাপিত মাধ্যমে মাহবুব আজাদ নামটি একেবারে নতুন হলেও বিগত কয়েক বছরে সাহিত্য চর্চার নতুন মাধ্যম অনলাইন সমাবেশে লেখক বেশ পরিচিত। বলা হয়েছে – “বাংলা ব্লগের ঊষাকালেই সেখানে লেখালেখি শুরু মাহবুব আজাদের। এ মাধ্যমটি কৌলিন্য লাভ করার আগে সেখানে যেহেতু রচনার মান সাধারণভাবে সুউচ্চ ছিলো না, অনেক পাঠকেরই খেদ ছিলো তাঁর লেখার এমন অপচয় নিয়ে। অনামী লেখকের লেখা নিয়ে এমন ভালোবাসা সাধারণ পাঠক যখন দেখান তখন সে লেখার মান কতোটা ভালো হতে হয় সে কথা বলাই বাহুল্য।” 

প্রশ্ন জাগে, মাহবুব আজাদ কোন বিষয়ে গল্প লেখেন বা কেমন করে লেখেন?
ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প বইয়ে গল্পের সংখ্যা ছয়। আকৃতি বিচারে হয়তো কৃষ এবং বৃহদাকার এমন ভাগে গল্পগুলোকে গোত্রীয় করা যায়, কিন্তু – বিষয়বস্তু বিবেচনায়? ঠিক এ জায়গায় এসে একটু থমকে যেতে হয়। কারণ, গল্পগুলোকে পাশাপাশি রেখে নিক্তিতে মাপার উপায় নেই। ‘পুরনো বাড়ি’ গল্পটির কথাই ধরি। হাসান নামের যুবকটি তার পরিবারের পুরনো আবাসে যায় কেবলই স্মৃতি হাতড়াতে? ক্রমশ নেই হয়ে যাওয়া নীল আকাশ, লাল শিমুল আর বুড়ো কৃষ্ণচূড়ার জন্য বিষাদগ্রস্ত হতে? অথবা যদি উত্তর দিই - “এখানে তো কিছু নেই! কিচ্ছু নেই!” বলে হু হু কাঁদতে যদি গিয়ে থাকে হাসান, তবে কি তা কেবলই অহেতূক? নাকি শেষে এই অনুধাবন প্রকাশ পায় যে বালকবেলা এবং তার শত্রু কাকেরা হারায় না কখনো? গল্প পাঠের শেষে জীবনানন্দের লাইনটিই মাথায় চক্কর দেয় – “পাবে নাকো কোনোদিন,/ পাবে নাকো কোনোদিন/ পাবে নাকো কোনোদিন আর”। 

অতীত স্মৃতির বালিশে মুখ গুঁজে ঘ্রাণ নেয়ার মাদকতা কেটে যায় ‘নিদপিশাচ’ নামের অতিপ্রাকৃত গল্পটি পড়লে। পরিতোষবাবুর মেয়ে স্বাগতার প্রতি মোহ এবং ঘনিষ্ঠতার আকাঙ্ক্ষা বাস্তব-অবাস্তবের জালে যখন বন্দী হয়, গল্পকথক উঠতি বয়সের নাসিম তখন স্বপ্ন এবং বাস্তবের চক্করে পড়ে। এ দুয়ের মাঝে প্রোথিত দেয়াল সে ভাঙতে পেরেছিলো কিনা তা জানতে গল্পের শেষ লাইন পর্যন্ত পড়ে যেতে হবে। গল্পকারের ছুঁড়ে দেয়া তীরে, শেষ অবধি, এমন তীক্ষ্মই চোখ থাকে পাঠকের।
অসহ্য লজ্জার এবং হতাশার কল্পনা-জগত যদি বাস্তব হয়ে উঠে! এমন শংকা জাগায় ‘বিলুপ্তি’ গল্পটি। বাংলাদেশের শেষ জীবিত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে লেখা এ গল্প পড়ে পাঠক বলবেন – অতিকল্পনা নয়, রাষ্ট্রের সামগ্রিক ব্যর্থতার সম্ভাব্য বাস্তবতা এই গল্প! 

বইয়ের শেষ গল্প ‘ম্যাগনাম ওপাস’ আসলে কার মহত্তম কীর্তির বয়ান? গল্পের ভেতরের গল্পকার আনিস চৌধুরীর রেখে যাওয়া অনুপস্থিতি নাকি সংগোপনে লেখা অন্য কোনো গল্প? ম্যাগনাম ওপাসের সন্ধানে থাকা রকিব এবং রমা যখন শরীরি ঘনিষ্ঠতায় ক্লান্ত এবং উদ্দীপ্ত, তখন কি গল্পকার মাহবুব আজাদ নিজেই রচনা করেন অন্য কোনো মহত্তম কীর্তি? অবশ্য দূর্বল পাঠকের শংকা থাকে - ফ্রয়েড এসে অদৃশ্য করে দেবে দৈনন্দিনের মুখোশ? পাঠকের চোখ যখন ছুঁড়ে দেয়া তীরের দিকে, সমবেত হাত যখন অপেক্ষায় নন্দিত কিংবা নিন্দিত অভিধা যোগের, তখন মূলতঃ ম্যাগনাম ওপাস মাহবুব আজাদেরই অনন্য সৃষ্টি হয়ে ওঠে। 

শুরুতে বলছিলাম, গল্পগুলোর বিষয় বৈচিত্র্যের কথা। বাকী গল্প দুটি, এই পাঠকের মতে ‘বনসাই অ-গল্প’, ‘সেতু সংকট’ আর ‘তোমার ঘরে বসত করে কারা’ ধার ও ভার বিবেচনায় খানিক তলানীতে পড়ে যাবে। কিন্তু পিয়াসী পাঠকের চুমুক বিস্বাদ জন্ম দেবে না, এ সম্ভাবনা থেকে যায় প্রবল। এর পেছনের কারণ ঐ একটিই – লেখকের বৈচিত্র্য প্রয়াস এবং বর্ণনায় পরিমিতবোধ।
সাম্প্রতিক সাহিত্য আলোচনায় এ সময়ের বাংলা ছোটোগল্প নিয়ে এক ধরনের শ্লেষ শোনা যায় প্রায়শ। কাল/দশকের মানদন্ডে স্বর্ণযুগকে অতীত করে দেয়া উত্তরাধুনিকতার মোড়কে গল্প সৃষ্টিকে অযুত বিশেষণে ফেনায়িত করা হয় হরহামেশা। কিন্তু, পরীক্ষণের সে সুতিকাঘরে যতো গল্প খুন হচ্ছে অথবা দারিদ্র্যের অগম-দুর্গম পুষ্টিহীনতায় গল্পগুলো যে জায়গা পাচ্ছে না পাঠকের মনে - সে দিকটিতে কি তাকাচ্ছেন সুধীজন? মূলধারার বাইরে অনলাইন মাধ্যমে হাজার পাঠকের মুখোমুখি দাঁড়ানো গল্পকারের সে ভয় নেই। গল্পের তুমুল ময়নাতদন্ত সেখানে লেখককে ঋদ্ধ করছে প্রতিদিন। তাই নীরিক্ষণের মোড়ক নয়, বরং পাঠকের মুখোমুখি দাঁড়ানো কিছু গল্পের সংকলন ‘ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প’। প্রথম প্রকাশিত বইটির জন্য মাহবুব আজাদকে যখন ‘সিটি-আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার’ দেয়া হয়, তখন লেখককে স্বীকৃতি নয় – স্পষ্টভাবেই পাঠককে জানান দেয়া হয় এক সম্ভাবনাময় লেখকের আগমন সংবাদ।
_____


বইয়ের নামঃ ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প
লেখকঃ মাহবুব আজাদ
ধরনঃ ছোটগল্প সংকলন
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারী ২০১০
প্রকাশকঃ শস্যপর্ব
পরিবেশকঃ পাঠসুত্র
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৮০
মূল্যঃ ১০০ টাকা।

Read more...

  © Blogger templates The Professional Template by Ourblogtemplates.com 2008

Back to TOP