ফিরে যাও নির্বাসন
আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে।
মধ্য রাতের রানওয়েতে মিটিমিটি আলো জ্বলছে। কিছু কাক কিংবা শালিক অথবা অন্য কোনো পাখি অহেতূক উড়ছে এলোমেলো। অনুভূতিগুলো কীভাবে বদলে যায় তা ভাবছিলাম। প্রথম যেবার দেশ ছাড়ি সেবার ঠিক এই সময়ে কষ্ট হচ্ছিলো খুব। প্লেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে নিজেকে ভীষণ দুর্বল মনে হচ্ছিলো। অথচ পালিয়ে যাওয়ার অমন সুযোগ পেয়ে কেনো পিছু ফিরবো - এ ভাবনা আমাকে থামিয়েছিলো। এবার পুরো অন্যরকম। এয়ার-ক্রু’দের যাত্রা শুরুর এ প্রস্তুতি বড়ো দীর্ঘ মনে হয়। মনে হয়, অনেকদিন আমি এভাবে এখানেই বসে আছি অপেক্ষায়। তখন আমার বাম পাশের সীটে এসে বসে সে-ই বুড়ো, মিটিমিটি হাসছে। এ বুড়ো আমার ছায়া ছাড়ে না। অকারণে এসে যন্ত্রণা দিয়ে যায়। অথচ সামিরার সঙ্গে এবার যখন প্রথম দেখা হলো, বিকেলে আমি অপেক্ষায় ছিলাম, সামিরা আসবে কি আসবে না দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম, তখন বুড়োকে মনে পড়ছিলো।
আমি জানতাম সময়টা আসবে একদিন। আমি অপেক্ষা করবো, ঘড়ি দেখবো – কখন সামিরা সুলতানা আমার সামনে এসে বসবে। পাঁচ বছর খুব লম্বা সময় নয়। দেশে ফিরে এক সপ্তাহেই টের পেয়েছি ঢাকা শহর বদলে গেছে অনেক। পালটে গেছে মানুষ। ট্যাক্সি চড়ে বনানী মাঠ পার হওয়ার সময় আমেরিকান বার্গারের দোকানটি চোখে পড়লো না। চোখে পড়লো না আরও অনেক কিছু। কাঁচঘেরা এ তাপ-শীত নিয়ন্ত্রিত ফাস্টফুডের দোকানে বসে আমি সামিরা সুলতানাকে ভাবি। স্মৃতি হাতড়াই, ঠিক এই মুহূর্তটিকে আমি কতোবার কতোভাবে ভেবেছি। কখনো মনে হয়েছে – সামিরা এসে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করবে - কেমন আছো, কখনো মনে হয়েছে – বলবে, জরুরী কাজ আছে, উঠতে হবে এখন। কিংবা আমাকে আসতে বলেও সামিরা সুলতানা আসবে না। বিকেল সাড়ে চারটার পরে ঘড়ির কাঁটা যখন আরও পনেরো মিনিট এগিয়ে যায়, তখন আমার মনে হয় সামিরা আজ আর আসবে না। তাহলে কি বুড়ো আসবে? এসে বলে দেবে - সামিরা আসবে নাকি আসবে না!
বুড়োর সঙ্গে প্রথম দেখা অনেক আগে। টরন্টো পৌঁছে উঠেছিলাম নাসিম ভাইয়ের বাসায়। আমার সারা জীবনের ধারণা ছিলো – বিদেশে মানুষ কষ্ট করে থাকে। কিন্তু, নাসিম ভাইদের অ্যাপার্টমেন্টে যে পাঁচজন বাংলাদেশী তরুণ থাকে, প্রথম তিন রাতে তাদের দেখে মনে হয়নি তারা কেউ কষ্টে আছে। কাজ থেকে ফিরে এক সঙ্গে সিনেমা দেখছে, এনটিভি’তে সকালের খবর দেখে রাজনীতির গুষ্টি উদ্ধার করছে, কল সেন্টার থেকে আসা বিজ্ঞাপনী ফোনের জবাবে ইংরেজীর তুফান ছোটাচ্ছে। সবাই হাসছে, রান্না করছে। এসব দেখে আমার মনে হয়, আমি অনায়াসেই বিদেশে থাকতে পারবো। যে কলেজের অফার লেটারে টরন্টো এসেছিলাম, নাসিম ভাইয়ের পরামর্শে, ১ম সেমিস্টার ড্রপ করলাম সেখানে। আরও সপ্তাহ খানেক পরে, কাজের খোঁজে এখানে ওখানে ঘুরে, শেষে ডাক পেলাম জমজম হালাল শপে মাংস কাটার কাজে। ইন্টারনেট থেকে নেয়া লোকেশনের প্রিন্ট আউট ধরে ডানে বামে যাই। কুইন্স স্ট্রীটে এপাশ ওপাশ ঘুরি, চক্কর দিই বারবার, কিন্তু জমজম হালাল শপ খুঁজে পাই না। ‘জেন্টেলম্যান, ডু ইয়্যূ হ্যাভ এ চেইঞ্জ প্লিজ’ – ডাক শুনে পাশ ফিরে তাকাই। অগাস্টের শেষ সপ্তায় রোদেলা সকাল। এরপরও জ্যাকেট চাপানো দাড়িমুখো বুড়ো। হাতে খালি কফির মগ, ভেতরে কিছু কয়েন। সে কি জানতো যে আমি তারচেয়ে ভালো অবস্থায় নেই! ম্যাপ হাতে জিজ্ঞেস করি, এখানে কোন পথে যাবো…। বুড়ো আমাকে পথ ধরে নিয়ে চলে। জিজ্ঞেস করে - কবে এসেছি, কতোদিন থাকবো; এইসব। এরপরে একটু শব্দ করে হাসে, বলে – ‘তুমি আর কখনো ফিরে যাবে না’। আমার মনে হয় এ যেনো বনবাসে যাওয়া রাজপুত্রের প্রতি নিঝুম অরণ্যে সাধু বাবার ভবিষ্যৎবাণী। জমজম হালাল শপের সামনে এসে বুড়ো আঙুল দিয়ে ভেতর দেখায়। এরপর আমি ধন্যবাদ দিয়ে ভেতরে যাচ্ছি এমন সময় সে আমার শার্টের হাতা ধরে টান দেয়, বলে – ‘পুশকিন স্কয়ার তো ভেঙে গেছে, সেখানে এখন ম্যাকডোনাল্ডস’!
ঢাকায় ম্যাকডোনাল্ডস আসেনি এখনো। হয়তো চলে আসবে। শুনেছি কেএফসি জমেছে বেশ। সামিরার সঙ্গে বাইরে কোনো রেস্টুরেন্টে, শেষবার পিজা হাটেই, খেয়েছিলাম বলে মনে পড়ে। কিন্তু, চেনাজানা দোকান বাদ দিয়ে গুলশানের ভেতরের এমন নীরব গলির মুখের এ ফাস্টফুড দোকানে কেনো সামিরা আমাকে আসতে বললো - তার উত্তর ভেবে পাই না। সাড়ে চারটার পরে পনেরো এবং আরও পরে বিশ মিনিট পার হলে আমার মনে হয় সামিরা আর আসবে না। সামিরার সঙ্গে সাক্ষাতের এ দীর্ঘ প্রস্তুতি ব্যর্থ হলো। কতো কতো সম্ভাব্য প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর নিয়ে যে প্রস্তুতি, নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করা, কিংবা প্রয়োজনে সামিরার কাছে ক্ষমা চাওয়া। কিছুই হলো না। উঠে বেরিয়ে যাবো, এমন সময় – কালো বোরখা ঢাকা একজন আমাকে পাশ থেকে বলে, ‘যাচ্ছো কোথায়, ভেতরে চলো’। গলার আওয়াজে বুঝি – সামিরা। সামিরা সুলতানা। আমার অপেক্ষার সামিরা সুলতানা। দীর্ঘ প্রবাসে, কতো কতো বিষন্ন সকালে, ক্লান্ত দুপুরে, পথ হারানো বিকেলে বা ঘুম ভাঙা রাতে আমি সামিরাকে ভেবে গেছি। অসংখ্য ভাবনার শেষ গন্তব্য-বিন্দু ছিলো – আবার কি আমাদের দেখা হবে! যদি দেখা হয় তবে আলাপ শুরু হবে কী করে, কিংবা কী নিয়ে কথা বলবো আমরা! অনেকবার অনুশীলন করা নাটকের সংলাপ ভুলে গেলে সমবেত দর্শকের সামনে যেমন হয় – আমারও তেমন মনে হচ্ছিলো। সামিরা মাথার স্কার্ফ সরিয়ে আলাপ সহজ করে, ‘তুমি বেশ শুকিয়ে গেছো’। এর জবাবে আমারও এরকম কিছু বলা উচিত। কিন্তু, কালো পোশাক ঢেকে দিয়েছে সামিরার শরীর। আমি দেখতে পাই না, তাই বলতেও পারি না সামিরা শুকিয়েছে নাকি মোটা হয়েছে…। আমার চোখ বারবার সামিরার ঘাড়ে চলে যায়। সরানো স্কার্ফ পেঁচিয়ে আছে ঘাড়ে, ছয় বছর আগে আমার জীবনের প্রথম চুমু ছিলো সেখানে।
নেলী প্রথমবারই আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলো। হাত দিয়ে তার ঘাড় থেকে আমার তৃষ্ণার্ত মুখ সরিয়ে বলেছিলো – ওখানে নয়, ওভাবে নয়। বুলগেরিয়ার মেয়ে নেলী নিকোলোভার সঙ্গে পরিচয় জমজম হালাল শপে। বিশাল মাংসের স্তুপের সামনে প্রথম ছুরি হাতে আমি বুঝে গিয়েছিলাম, এ অনেক কঠিন কাজ। বারবার আমার নিশানা ভুল হয়। কখনো প্রয়োজনের চেয়ে জোরে কোপ মারি। হাড্ডিগুলো এবড়োথেবড়ো হয়ে যায়। তবুও আমি হাল ছাড়ি না। প্রতিদিন নতুন নতুন করে কায়দা শিখি। গরুর পেছনের রানের মাংস কাটার সময় লম্বালম্বি আর সামনের রানের সময় পাশাপাশি করে ধরতে হবে, এসব আমাকে নেলীই শিখিয়ে দেয়। আগ্রহের কমতি নেই দেখে নেলী নিজে এগিয়ে আসে, বলে – ওখানে নয়, ওভাবে নয়। তারপর নিজে ছুরি হাতে দেখায় কোন জায়গাটায় কীভাবে কাটতে হবে...। বুড়োর কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। এক সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফেরার পথে বুড়ো আমার পথ আগলে দাঁড়ায়, বলে – পুশকিন স্কয়ারের চায়ের দোকান আর নেই, সেখানে এখন ম্যাকডোনাল্ডস। আমার চোখে তখন ভীষণ ক্লান্তি, ঘরে ফেরার তাড়া। তবুও বলি – ‘পুশকিন স্কয়ার ভেঙে গেলে তোমার কী?’ বুড়ো আমার চোখে চোখে খেলা করে, ‘আমার কিছু নেই, তবে তোমার আর দেশে ফেরা হবে না’। এবার বুড়োকে আর সাধুবাবা মনে হয় না। মনে হয় – সেদিন আমার টেনশন ছিলো, চাকরি খোঁজার তাড়া ছিলো, তাই বুড়োর কথাকে ভবিষ্যৎবাণী মনে হয়েছিলো। আসলে, এ বুড়ো নিতান্তই পাগল – ভবঘুরে ভিক্ষুক, আমাকে ভড়কে দেয়ার চেষ্টা করছে...।
খুব আশ্চর্যজনকভাবে খেয়াল করি, সামিরা আমাকে ভড়কাচ্ছে না। অথচ এর আগে যতোবার সামিরার সঙ্গে সাক্ষাতের কল্পদৃশ্য ভেবেছি, মনে হয়েছে – সামিরা আমাকে নার্ভাস করে দেবে। আমাকে চমকে দেয়ার, তুচ্ছ করার, কাছে টানার কিংবা ছুঁড়ে ফেলার একটি কঠিন অস্ত্র তার হাতে আছে। এ ভয়াল অস্ত্রটি কারও বানানো ছিলো না। একদিন এক দুপুরে খেয়াল করেছিলাম সামিরা এ অস্ত্র হাতে আমার দিকে চেয়ে আছে, আর আমি মুষড়ে যাচ্ছি ক্রমশ। সেই থেকে শুরু - সামিরা আমাকে প্রভাবিত করে, আমি ভীত হই, পালাই। প্রথম প্রথম কেবল সামিরার কাছ থেকে পালানো। কিন্তু, এরপরে যখন, উপায় থাকে না, নিজের কাছ থেকে পালাতে ইচ্ছে করে, তখন আমি নাসিম ভাইকে ফোন করি। ভিসা পেয়ে ঢাকা-দুবাই-টরন্টোর এয়ার টিকিট কিনতে তিন মাস সময় লেগেছিলো। ঠিক যেদিন দেশ ছাড়ি সেদিন থেকে শুরু করে গত পাঁচ বছরের সব গল্প সামিরার জন্য জমা। অসংখ্য দিনের, স্মৃতির, কষ্টের, কিংবা অনুতাপের গল্প আমি করতে পারি – যদি সামিরা সুলতানা মনোযোগী শ্রোতা হয়, যদি বলে তার তাড়া নেই। এই আকাঙ্খা কিংবা অনুমান আমার প্রকাশ করা হয় না। ভেজিট্যাবল রোলে কামড় দিয়ে লেমন জুসে চুমুক দিচ্ছি, তখন মুখোমুখি সামিরা – তার হাতে অরেঞ্জ জুস। নীরবতা ভেঙে সামিরা জিজ্ঞেস করে, ‘ক’দিন থাকবে দেশে?’ আমি বলি, ‘ঠিক নেই। হয়তো একমাস কিংবা তিনমাস, অথবা আগামী সপ্তাহ’। সামিরা মাথা নাড়ে। আমার তীব্র আশা ছিলো, সামিরা জিজ্ঞেস করবে, ‘আগামী সপ্তাহ কেনো’; অথচ জিজ্ঞেস করে না। আমি টের পাই, সে-ই পুরনো অস্ত্র এখনো তার হাতে। অনেক সময় নীরব থেকে এ অস্ত্রের কারিশমা সে প্রকাশ করতে পারে। কথা চালু রাখতে আমি স্বাভাবিক থাকি, জিজ্ঞেস করি – ‘বাসার সবাই ভালো আছে?’ সামিরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। আমার এ প্রশ্নের ভেতরে আরও যে প্রশ্নটি লুকিয়ে আছে, যে প্রশ্নের উত্তর জানতে আমি নিজের সঙ্গে নিজে অবিরাম হুটোপুটি খেলেছি দুঃস্বপ্নে তা কি সামিরার জানা আছে? আমি ঐ প্রসঙ্গে আর যাই না, মনে কেবল একটিই ভয় - সেই পুরনো অস্ত্র। নীরবতা। সামিরা যেমন নীরব হয়ে গিয়েছিলো, আর আমি টের পেয়েছিলাম – ভয়াল এক অস্ত্রের মালিক সে হয়ে গেছে। ঐ অস্থির ঘুঘু ডাকা দুপুরে, যখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – ‘তুমি রাগ করেছো?’ এর উত্তরে সামিরা কিছুই বলেনি। ভেবেছিলাম, হয়তো সে হাসবে, লজ্জা পাবে, কিংবা অনুতপ্ত হবে; যার স্পষ্ট প্রকাশ আমি তার চেহারায় দেখতে পাবো। কিন্তু ওসব কিছুই হয় নি। ‘তুমি রাগ করেছো?’ প্রশ্নের উত্তরে সে হু হু করে কেঁদেছে। আমি অপেক্ষায় ছিলাম আরও কিছুক্ষণ। কান্না থেমেছিল এক সময়। কিন্তু, এরপর ভয়ানক নীরব ছিলো সামিরা। মধ্য দুপুরের বিরান মাঠের মতো নীরব। আদালতে খুনের আসামীর বিচারের রায় ঘোষণার আগ মুহূর্তের মতো নীরব।
নেলীর ধারণা ছিলো – ভীষণ গোপন কষ্ট না থাকলে, আমার বয়েসী কোনো ছেলে এমন নীরব থাকে না। তুষার পড়া দিনে বরফ মাড়িয়ে আমরা কফি শপে বসি। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি, আমার নিজস্ব জগতে নেলী প্রবেশের সুক্ষ্ম চেষ্টা করছে। এ চেষ্টার শুরু কবে কোনদিন থেকে তা আমার জানা নেই। তবে, যেবার আমি বেখেয়ালে ছুরির কোপ নিজের কব্জিতে বসিয়ে দিলাম, রক্তে মাখামাখি হয়ে গেলো আমার হাত আর খাসির শিনার মাংস - সেবার নেলীর উৎকন্ঠা দেখে আমি টের পেয়েছিলাম, আরও একটি ভুল আরও একটি মেয়ে করতে যাচ্ছে। এই সম্ভাব্য ভুলের চিন্তা আমার মাথায় কিরকির আওয়াজ তোলে, হয়তো এ কারণেই কেটে যাওয়া কব্জির ব্যথা খুব ক্ষীণ মনে হয়। মনের ভেতর এ সিদ্ধান্ত জাঁকিয়ে বসে, আর যা-ই হোক নেলীকে এ ভুল করতে দেয়া যাবে না। নেলী নিকোলোভাকে ভুল থেকে বাঁচাতে আমার অতি সতর্কতা আরও নীরবতা নামায় আমার মধ্যে। নেলী জিজ্ঞেস করে, কী এমন গোপন কষ্ট আমার! আমি নেলীর কাছে মিথ্যে বলি, বলি – প্রকাশ্য কিংবা গোপন বলে কিছু নেই - আমি এমনই - বলতে নয় কথা শুনতে ভালোবাসি। সে আমাকে বুলগেরিয়ান গোলাপ কাজানলাস্কা রোজার গল্প বলে। ছয় বছর বয়সে পাশের বাড়ির ছেলেটি তাকে কাজানলাস্কা রোজা বলেছিলো, এ স্মৃতিকাতরতায় বিহবল হয় সে। আমি আরও আগ্রহী হই, বলি – তারপর? নেলীর আর কিছু বলার নেই, ঐ একটি গল্পই সে বলে বারবার। সাত বছর বয়সে কানাডায় পাড়ি জমায় তার পরিবার, তাই বুলগেরিয়ার স্মৃতি বেশি নেই। মূলতঃ দুজনের গল্পহীনতার কারণেই আমরা অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসি। আমাদের কফিশপ মহূর্তগুলো প্রলম্বিত হয় শেষ ট্রেনের অপেক্ষায়। সারাদিন কাজ করে, বরফ জমানো দিনে কফি চুমুক শেষে, আমরা উলটো পথে বাড়ি ফিরি প্রতিদিন। দিনে দিনে বরফ গলে, আকাঙ্খিত গ্রীষ্মের রোদ শেষে আরও এক শীতের শুরুতে ঝড় নামে এক শনিবার রাতে। নেলী আমার হাত ধরে বলে, ‘আজ আমার বাসায় চলো’।
রিন্টুরা আমাকে নিতে চায়নি। শেষ মুহূর্তেও নাফিজ ‘আয়্যাম শিউর – দিস ফাকিং লুজার উইল মেস এভরিথিং...’ বলে আমাকে রেখে যেতে চেয়েছিলো। আমি নীরব ছিলাম। কারণ, আমি চোখে দেখতে চেয়েছিলাম – রিন্টুদের গল্পগুলো কতোটুকু সত্য। এরা আমার বন্ধু, এবং বন্ধুর বন্ধু - সবাই গুলশানে থাকে, বনানীতে ক্লাস শেষে উত্তরায় লাঞ্চ করে, ধানমন্ডিতে জিমে যায়, আর বারিধারায় প্রেম করে। এরা পড়ালেখার কোর্সকে ক্রেডিট বলে, ভার্সিটির টিচারকে বলে ফ্যাকাল্টি। আমাদের খিলগাঁও মডেল কলেজ কিংবা তিলপাপাড়া মহল্লায় এসব ভাষার প্রচলন নেই। তাই সুন্দরী মেয়ে মানে কুল নাকি হট এ বিভ্রমে চক্কর খাই আমি, নীরব থাকি। সেদিন শেষ মুহূর্তে রিন্টু আমাকে নেয়, জিজ্ঞেস করে – ‘ভয় পাবি না তো?’ প্রবল আগ্রহে আমি সাহসী হই, বলি – ‘না, ভয় পাবো না’। ঘুষখোর বাবার কেনা লেক্সাস-জিএস থ্রি-হান্ড্রেডে নাফিজ আমাকে সামনে বসায়। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলে – কিপ কুল, বি কোআয়েট। রিন্টু-লিটন অন্য গাড়িতে, অন্যপথে। আমি চুপচাপ বসে থাকি। সিডি প্লেয়ারে – ইয়েলো ব্রিক রোড, দ্য ওয়ে আই এম; এমিনেম চিৎকার। মুখে চুইংগাম চিবিয়ে নাফিজ মাথা দুলাচ্ছে। এয়ারপোর্ট রোড ধরে গাড়ি ছুটছে...। আরও পরে বামে এবং ডানে, তারপরে আবার বামে ও কিছুটা সামনে গিয়ে মোড় ফিরতেই সাদা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে এসে নাফিজ গাড়ি থামিয়ে ফোন দেয়। হালকা ক্রীম কালারের টপস আর কালো স্কার্ট পরা কিশোরী বেরিয়ে আসে। আমি সীট বদলে পেছনে গিয়ে বসি। কিশোরী সামনে, নাফিজের পাশে। এরপর গাড়ি আরও চক্কর দেয়, উত্তরা দুই অথবা তিন, পাঁচ অথবা ছয় নম্বর সেক্টর পার হয়। এসব জায়গা আমার অচেনা, তাই কোন গলি পেরিয়ে গাড়ি আবার এয়ারপোর্ট রোডে ওঠে তা আমি বুঝি না। রিন্টু বলেছিলো, এমনই হয় – একজন গিয়ে নিয়ে আসে, বাকীরা অপেক্ষায় থাকে। এই প্রথম আমি রিন্টুর গল্পগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করি। আমার মনে পড়ে – কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় রিন্টুরা যখন খিলগাঁও ছেড়ে গুলশানে চলে আসে, আমাকে বলেছিলো – ঐদিকে লাইফের একটা ক্লাস আছে, স্ট্যান্ডার্ড আছে। নাফিজের গাড়ি বনানীর নিরিবিলি গেস্ট হাউজের পার্কিং লটে এসে থামলে আমার মনে হয় – রিন্টুদের জীবনে সত্যি উল্লাস আছে, স্বাধীনতা আছে। লিফটের বাটন টিপে তিন অথবা চার তলার রুমে যাওয়ার আগ মুহূর্তে আমি আবার ভীরু হয়ে উঠি। আমার জ্বর জ্বর লাগে, গায়ে কাঁপুনি আসে। তারপর এক রুমে দরজা খুললে ভেতরে রিন্টু এবং লিটনকে দেখতে পাই। টেবিলে চিভাস রিগ্যাল আর বিদেশি চিপস। নাফিজ পরিচয় করায় – ‘শী ইজ ফারিহা, আওয়ার হোস্ট টুডে’। আমি এই প্রথম নাম জানি তার – ফারিহা। ওরা হ্যান্ডশেক করছে, পরিচিত হচ্ছে। আমি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। কার্ণিশে পড়ন্ত বিকেল। ফারিহা অবাক হয় – ‘ইয়্যু গাইজ ওয়্যার সাপোসড টু বি টু। হোয়াই ফোর?’ নাফিজ বোঝানোর চেষ্টা করে, আঙুল তুলে আমাকে দেখায় – ‘দ্যাট বয় ইজ গন্যা লীভ আস সুন’। ফারিহা চিৎকার করে – ‘আমাকে দু’জনের কথা বলা হয়েছে, নট থ্রি!’ লিটন এবার উঠে আসে, ফারিহার কাঁধে হাত রাখে – ‘ইয়্যূ আর সো হট, সুইটি’। এরপরও ফারিহার চিৎকার থামে না। নাফিজ পথ আঁটকায়, উঁচুস্বরে ধমক দেয় – ‘একদম চুপ, একটাও শব্দ নয়’। তখন আমার কী হয় জানি না, সবাইকে সরিয়ে হুট করে দরজা খুলে দিই, বলি – ‘ওকে যেতে দাও’। আমার কথা শুনে উঠে আসে রিন্টু। ভীষণ ভারী ঘুষি বসিয়ে দেয় আমার চোয়ালে – ‘ইয়্যূ মাদা-ফাকা, শাট আপ’! ওপাশ থেকে লিটন এসে দুমদুম লাত্থি দেয় আমার বুকে-তলপেটে, তারপর রিন্টু সজোরে চিভাসের বোতল ছুঁড়ে মারে আমার গায়ে। আমি প্রবল ব্যথায় মেঝেতে এক কোণায় দেয়ালে মুখ করে গুটি মেরে শুয়ে থাকি। ক্রমশ বন্ধ হওয়া চোখে দেখি – মেঝেতে আমারই আশেপাশে ফারিহার কালো স্কার্ট। ততক্ষণে নাফিজ হারিয়েছে ফারিহাকে, জিততে চলেছে রিন্টু এবং লিটন। আমার উঠতে ইচ্ছে করে, কিন্তু উঠতে পারি না। মনে হয় – এক ডুব সাঁতারে নেমেছি আমি, পানির নিচে শুনতে পাচ্ছি উপরের মানুষের সমবেত চিৎকার - করতালি। তখন আমার অমন ঘুম পেলো কেনো...!
ঘরে তৈরি ডিনার শেষে নেলী আমাকে জিজ্ঞেস করে – ‘এখনই ঘুমোবে?’ আমি হাই তুলি, বলি – ‘হুম ঘুম পাচ্ছে’। গায়ে গাউন চাপিয়ে নেলী আমার পাশে এসে বসে। আমি সে-ই বুড়োর গল্প বলি, জিজ্ঞেস করি – পুশকিন স্কয়ারের চায়ের দোকান ভেঙে ম্যাকডোনাল্ডস হওয়া মানে কী? নেলী হাসতে থাকে, আমার হাতের আঙুল নিয়ে খেলা করে। বলে - ঐ বুড়ো রাশিয়ান, মস্কো থেকে এসেছিলো রিফিউজি হয়ে, এখনো কম্যুনিজমের স্বপ্ন দেখে আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিক্ষা করে। আমি নেলীকে বলি, মাংসের দোকানের কাজ আমার আর ভালো লাগে না, আমিও ঐ বুড়োর মতো – ভিক্ষা করবো। নেলী অবাক হয় কিনা জানি না, তবে মুহূর্তেই ‘আমাকেও নিয়ো সঙ্গে’ বলে আমার কপালে চুমু বসিয়ে দেয় সে। এ ঘটনার আকষ্মিকতায় আমি চুপ মেরে যাই। এরপর নেলী আমার চুলে বিলি কাটে। বুলগেরিয়ান গান শুনবো কিনা জিজ্ঞেস করে। এমন শরীরি ঘনিষ্ঠতা অসহ্য লাগে আমার। বুক ধুকধুক করে। গায়ে প্রবল কাঁপুনি আসে। আমি নেলীকে বলি, ‘ঘরের হিটারটা বাড়িয়ে দাও, আমার শীত করছে’। এপার্টমেন্টের অটো কন্ট্রোলড হিটার বাড়ানোর বা কমানোর সাধ্য তার নেই। তাই আমার কাঁপাকাঁপা গায়ে নেলী চাদর চাপিয়ে দেয়, সাথে নিজেকেও। এমন উষ্ণতায় আমার দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। কিন্তু তুষার ঝড়ের রাতে এ উষ্ণতা ছেড়ে রাস্তায় বেরুতে ইচ্ছে করে না। বরং টের পাই – কখন আমার হাত দুটোও দ্রুত চঞ্চল হয়ে উঠেছে। খুলে নিচ্ছে লাইট-পিংক ভিক্টোরিয়াস সিক্রেট। আরও পরে আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁট নেলীর ঘাড়ে গেলে সে হাত দিয়ে সরিয়ে দেয় – বলে, ওখানে নয়, ওভাবে নয়...।
ঘুম নয়, আমি অজ্ঞান হয়েছিলাম। সম্বিৎ ফিরে এলে, অনেক কষ্টে দাঁড়িয়ে দেখি বিছানায় কাত হয়ে পড়ে আছে ফারিহা। আর কেউ নেই। বাইরে রাত নেমেছে। আমি ফারিহার গায়ে ধাক্কা দিই, ডাকি। সাড়া নেই। রিন্টুকে ফোন করি, তার মোবাইল বন্ধ। কী করবো ভেবে পাই না। আরও পরে ফারিহা চোখ খোলে, বিড়বিড় শব্দ করে, খাটের ওপাশে পড়ে থাকা মোবাইল ফোন দেখিয়ে, বলে - সামিরা আপু। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘সামিরা আপুকে ফোন দেবো?’ বিধ্বস্ত ফারিহা কী বলে বুঝি না, তবে আমি ফোনবুক সার্চ করে সামিরা আপুকে ফোন দিই। সংক্ষেপে বলি – ফারিহা এখানে, নিরিবিলি গেস্ট হাউজ বনানী, রুম নম্বর...। আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সামিরা আপু বুঝে নেয় অনেক কিছু। মিনিট চল্লিশেক পরে পরিপাটি সালোয়ার কামিজ – মাথা ঢাকা ওড়নায় সামিরা নামের এক তরুণী এসে কড়া নাড়ে। ফারিহাকে দুপাশে দুজন ধরে গাড়িতে তুলি। সামিরার বাসার গেটে পৌঁছলে আমাকে বিদায় জানানো হয়। গাড়ী থেকে নামার মুহুর্তে সামিরা আমার ফোন নম্বর চেয়ে নেয়। সে রাতে আমার ঘুম হয়নি। মাঝরাতে কোথাও সাইরেন বাজিয়ে এম্বুলেন্স চলে গেলে আমার মনে হয় – একদল পুলিশ আমাদের তিলপাপাড়া মহল্লা ঘিরে রেখেছে, আমাকে এরেস্ট করে নিয়ে যাবে – আর শতশত মানুষ দেখবে সে দৃশ্য। এরকম দুঃশ্চিন্তায় আমার ঘুম ভেঙে গেছে পরের আরও তিন রাত। চতুর্থ রাতে সাইরেন কিংবা হুইসেলের শব্দে ঘুম ভাঙলে দেখি আমার মোবাইলে রিং হচ্ছে। সামিরা সুলতানা। আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় সে। আমি ভয় পাই, সকাতরে জানাই – আমি ফারিহাকে হেল্প করতেই চেয়েছিলাম। সামিরা অভয় দেয়, ফারিহা বলেছে সব, আমার কোনো দোষ নেই। এরকম আরও কয়েকবার ফোন আলাপ শেষে আমি সামিরা সুলতানার সঙ্গে দেখা করি। ফারিহার কাজিন সামিরা সুলতানা, সাত মসজিদ রোডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্রী। এরপরে আরও বেশ কয়েকবার দেখা হলে, আল-বাইকে বসে চিকেন উইংয়ে কামড় দিতে দিতে সামিরা জিজ্ঞেস করে – আমি কেনো নিরিবিলি গেস্ট হাউজে গিয়েছিলাম। এ প্রশ্নের উত্তর যতোটা সহজভাবে জানি, ততটা কঠিন লাগে প্রকাশে। আমার এ দ্বিধা – প্রকাশ্য অস্পষ্টতা ও ভীরু চাহনিতে সামিরা হয়তো বুঝে গেছে – আমি নির্বিষ প্রকৃতির ছেলে, আমার ওপর নানা কারণে আস্থা রাখা যায়। তাই আমার সঙ্গে যোগাযোগে এক রকম নিরাপদ বোধ করে সে। আমিও সামিরাকে সঙ্গ দিই – রাপা প্লাজায়, মেট্রো শপিংয়ে কিংবা আড়ং-এর শো পিস সেকশনে। এমন চার অথবা পাঁচ মাস গেলে আমি একদিন ভয়ে ভয়ে সামিরাকে জিজ্ঞেস করি – ‘ফারিহা কেমন আছে?’ জবাবে সামিরা জানায় – লন্ডন চলে গেছে সে, মায়ের কাছে। এ সংক্ষিপ্ত উত্তর আমার জানার আগ্রহ মেটায় না। তবে অনুমান করে নিই, ফারিহা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে, এতদিন বাবার কাছে থাকতো। ইংরেজী স্কুলে পড়ার কারণে নিয়ন্ত্রণহীন জীবন ছিলো তার, যেমন ছিলো এবং আছে নাফিজ-লিটন-রিন্টুদের। এখন মায়ের কাছে ফিরে গেছে ফারিহা। আবার এমনও মনে হয় – ফারিহা এ শহরেই আছে, সামিরা আমাকে মিথ্যে বলেছে। তবে আমি এই সত্য-মিথ্যা উদ্ঘাটনে যাই না। বরং ভালো লাগে, সামিরার সঙ্গে আমার একরকম বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে আমি তখন সামিরাদের ধানমন্ডির বাড়িতেও যাই। হিন্দি সিনেমা এবং ক্রিকেট নিয়ে আলাপ করি। কয়েক মাসে আপনি থেকে তুমিতে নেমে – সামিরা আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কখনোই কোনো মেয়ের হাত ধরোনি?’ আমি উত্তরে বলি, ‘এখনো না’। সামিরা কোনো ছেলের হাত ধরেছে কিনা সে প্রশ্ন আর করা হয় না। ততক্ষণে নিজের হাতে আমার হাত তুলে নিয়েছে সামিরা।
বুড়ো আমার পথ আগলে রাখে। বলে, উত্তর তোমাকে দিতেই হবে, বলো – কেনো পুশকিন স্কয়ার ভেঙে গেলো। আমি বুড়োকে ধাক্কা দিই, পথ ছাড়তে বলি। কিন্তু না, বুড়ো পথ ছাড়বে না। আমার কারণেই নাকি পুশকিন স্কয়ারের চায়ের দোকান ভেঙে গেছে, সেখানে এখন জমজমাট ম্যাকডোনাল্ডস। অতএব শাস্তি আমাকে পেতেই হবে। হাত ধরে আমাকে বুড়ো নিয়ে যায় ট্রেন স্টেশনে। অন্ধকার সে আন্ডারগ্রাউন্ড। বুড়ো আমাকে নির্দেশ দেয়, রেল লাইনে শুয়ে থাকতে হবে। আমি উঠতে চাই, কিন্তু পারি না, বুড়ো লাঠি হাতে আমাকে ভয় দেখায়। দূর থেকে ট্রেন আসছে, আমার গায়ের ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাবে, এমন সময় মনে হয় আরও দূর থেকে করুণ স্বরে কে যেনো ডাকছে আমাকে, তাই আমি সরে যাই। গা ঘেঁষে ট্রেন চলে গেলে বুড়ো আমাকে ধমক দেয় - কেনো সরলাম আমি। আমাকে মারতে চায় সে। আমি ভয়ে হাসফাঁস করি। নেলী আমাকে জড়িয়ে ধরে হাল্কা ঝাঁকুনি দেয়, জিজ্ঞেস করে – ‘দুঃস্বপ্ন দেখছিলে?’ আমি উঠে বসি। জানালার পর্দায় সফেদ আলো। বাইরে সকাল হয়ে গেছে। বলি – বাসায় ফিরবো, ভালো লাগছে না। নেলী কফি করতে চায়, কিন্তু আমার ইচ্ছে করে না। দ্রুত নেলীর বাসা থেকে বেরিয়ে আসি। পথে সেই বুড়ো এবার সত্যি সত্যি আমার পথ আঁটকায়। রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে – ‘তোমার আর কখনোই দেশে ফেরা হবে না’। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কেনো?’ বুড়ো আর জবাব দেয় না। পুশকিন স্কয়ার নিয়েও কিছু বলে না। রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে রাখে মুখে, চোখের ভুরু ওঠানামা করায়। যেনো আমাকে জিজ্ঞেস করছে – ‘নেলীকে তুমি ভালোবাসো?’ এই প্রথম আমি গত রাতের জন্য অপরাধবোধে ভুগি। আমার মনে পড়ে সামিরার নীরবতার কথা। সেই এক মৃত দুপুরে সামিরার বাসায় আমাদের হঠাৎ জেগে ওঠার কথা। এপ্রিলের প্রচন্ড গরমের সে দুপুরে হঠাৎ কোত্থেকে এক ঘুঘু এসে সামিরার জানালায় বসেছিলো। আমাদের দিকে তাকিয়ে ডেকে চলেছিল বিরামহীন। মুহূর্তগুলো আরোপিত ছিলো না বলে, কোনো পক্ষ থেকে অসম্মতি ছিলো না বলে – অনায়াসে আমি সামিরার ঘাড়ে চুমু দিয়েছিলাম তখন। সাদামাটা একটি মৃত দুপুর এভাবে আমাদের জীবনে অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠে, তাই এতদিন পরেও মনে পড়ে সেই ঘুঘুর ডাক। আর ঘুঘু-ডাকা দুপুরে আমার সমাপনী জিজ্ঞাসা - ‘তুমি রাগ করেছো?’ যার উত্তরে সামিরা কিছুই বলেনি। হু হু কান্না শেষে অস্বাভাবিক নীরবতায় ডুব দিয়েছিলো সে। ঐ নীরবতায় সামিরার ব্যক্তিগত আদালতে আমার মৃত্যুদন্ড ঘোষিত হয় সেদিন।
সামিরার নীরবতার মধ্যেও পারষ্পরিক যোগাযোগ এবং যাতায়াত ছিলো অনিয়মিত। কেবল সাক্ষাতের উষ্ণতাটুকু ছিলো না। ঘুঘু-ডাকা দুপুরের পরে, হয়তো মাস দেড় দুই পরে, এক বিকেলে সামিরা ফোন করে বলে – ‘আয়্যাম এক্সপেক্টিং’। এ দুটো শব্দ আমাকে বিহবল করে তোলে। অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত সময়ের সামনে আমি দাঁড়িয়ে। মাথার ভেতর হাজারো শব্দে বিচরণ করেও আমি বলার মতো কোনো বাক্য খুঁজে পাই না। সামিরার নীরবতা এবার আমাকে গ্রাস করে। আমাকে দু’দিন ভাবার সময় দেয় সে – ‘বিয়ে করবে কি করবে না বলো’। পরীক্ষার খাতায় জটিল ক্যালকুলাস মেলানো আমার একুশে মাথায় এ বড্ডো ধাঁধাময় মনে হয়। আমার চারপাশ কেবলই শুন্যতায় ভরে ওঠে। পরামর্শের জন্য ছুটি রিন্টুর বাসায়। সেখানে নাফিজ এবং নীল শার্ট পরা অচেনা এক তরুণ আমার কথা শুনে হো হো শব্দে হেসে ওঠে। নাফিজ খ্যাসখ্যাস গলায় বলে – ‘দ্যাট স্লাট হ্যাজ মেইড ইয়্যূ এ ভিক্টিম’। পাশের নীল শার্ট পরা অচেনা তরুণ সম্মতি দেয়, সামিরা তার অনেক দিনের চেনা। আমার ভীরুতা, মানসিক দূর্বলতা এবং সামগ্রিক অক্ষমতা আমাকে সাহস জোগায় নাফিজের কথায় বিশ্বাসী হতে। পরদিন সামিরার প্রশ্নের জবাবে ফোনে চিৎকার করি, ‘ইয়্যূ ব্লাডি ফ্রীক প্রস, গো টু হেল – ডোন্ট ট্রাই টু রুইন মাই লাইফ’। এ কথা শুনে সামিরা নিঃশব্দে ফোন রেখে দেয়। আমি তখন বিড়বিড় করি, না – এ কথা আমি বলতে চাইনি। আমি অন্য কিছু বলতে চেয়েছিলাম। অথচ কী বলতে চেয়েছিলাম তা আমার জানা নেই। সামিরাকে আর ফোন করিনি, কারণ আমি তার থেকে আড়ালে থাকতে চেয়েছি। কিন্তু, এভাবে আরো দিন গেলে টের পাই – আমি আসলে আমার নিজের কাছ থেকে পালাতে চাইছি। এ চেনা শহর, শহরের খিলগাঁও তিলপাপাড়া মহল্লা, এই কোলাহল, এই মুখরতা আমার ভালো লাগে না। আমি দেশ ছাড়ার প্ল্যান করি, কানাডায় নাসিম ভাইকে ফোন করি।
জমজম হালাল শপে কাজ করে প্রথম মাসে যেদিন বেতন পেলাম, সেদিন দেশ থেকে রিন্টুর মেইল পাই – সামিরা তার বাবার বন্ধুর ছেলেকে বিয়ে করেছে। এলিফ্যান্ট রোডে কম্পিউটার এক্সেসরিসের ইম্পোর্টার ব্যবসায়ী পাত্র। কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্রী সামিরা সুলতানার কম্পিউটার ব্যবসায়ী বর এবং তাদের সুখী জীবন কামনা করে সেই সন্ধ্যায় আমি কিছুটা নির্ভার হই। কিন্তু, একটি প্রশ্নের উত্তর আমার জানা হয় না। গত সপ্তায় দেশে নেমে তিনদিনের মাথায় সামিরাকে যে প্রশ্ন করতে ফোন করেছিলাম, কিন্তু সাহসের অভাবে করতে পারিনি, সে প্রশ্ন এবার আমি সামিরাকে করবো কিনা ভাবি। গুলশানের এ নীরব ফাস্টফুড দোকানের কোণার টেবিলে তখন কেবল আমরা দুজন মুখোমুখি। অনেক নীরবতা শেষে সামিরা যখন বলে – ‘এবার আমাকে যেতে হবে’ তখন আমি কাঁপাকাপা গলায় জিজ্ঞেস করি, ‘বাচ্চাটি কেমন আছে?’ এ প্রশ্ন শুনে সামিরা ভীষণ সরাসরি আমার চোখে চোখ রাখে। হয়তো রাগের তীব্রতায় সে নিজের ঠোঁটে কামড় দেয়। কয়েক মুহুর্ত নীরবতায় স্থির থাকে। তারপর ভারী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে বলে – ‘দ্যাট বাস্টার্ড ওয়াজ এবর্টেড’। এ উত্তর আমার কাছে চমকের কিছু মনে হয় না। কারণ, গত পাঁচ বছরের অনেক অনেক সম্ভাব্য অনুমানে এ উত্তরটিও ছিলো। তাই আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি। এক সময় ‘ভালো থেকো’ বলে সামিরা বিদায় নেয়। এরপর আরও সময় যায় সে সন্ধ্যায় এবং রাতে। আমি কেবলই অনুভব করি – কঠিন এক প্রশ্নের উত্তর আমি জেনে গেছি। আমার আর কিছু জানার নেই, সামিরার এ উত্তরের পরে আমি এক অন্যরকম ছুটি পেয়ে গেছি। এবার বরং গত পাঁচ বছরে আপন হয়ে ওঠা অচেনা শহরটিতেই ফেরা যাক। নেলী নিকোলোভার কাছে কাজানলাস্কা রোজার গান শোনা যাক। তাই আমি আবার দেশ ছাড়ার দিনক্ষণ ঠিক করি...।
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্রপেলার যখন চালু হচ্ছে, যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি শেষের দিকে। আমি রানওয়ের কাক-শালিক কিংবা অন্য কোনো পাখি দেখছি, প্রথমবার দেশ ছাড়ার অনুভূতিগুলো ভাবছি, তখন সেই বুড়ো আমার কাঁধে ধাক্কা দেয়। মিটিমিটি হেসে বাংলায় বলে – ‘বাচ্চাটি বেঁচে আছে এখনো’। শুনে আমার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে। মনে হয় – প্লেনের সমূহ ইঞ্জিন আমার মাথায় ঢুকে যাচ্ছে। যেনো আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেছে, পা নাড়তে পারছি না। ঘাড় পিঠ টানটান শক্ত হয়ে আছে, আবার মনে হয় - কিরকির শব্দে মাথা ছিঁড়ে আলাদা হয়ে ওপরের দিকে উড়াল দেবে এক্ষুণি। এরকম অসহ্য যন্ত্রণায় নিজেকে খানিক সামলে কিছু একটা বলতে পাশ ফিরলে দেখি – সেখানে কেউ নেই। সৌম্য স্মিত চেহারার এয়ার-ক্রু আমার সামনে দাঁড়িয়ে -‘স্যার, সীট বেল্ট বেঁধে নিন- প্লিজ’ । আমি তার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করি – পুশকিন স্কয়ার ভেঙে গেছে, সেখানে এখন ম্যাকডোনাল্ডস।
মধ্য রাতের রানওয়েতে মিটিমিটি আলো জ্বলছে। কিছু কাক কিংবা শালিক অথবা অন্য কোনো পাখি অহেতূক উড়ছে এলোমেলো। অনুভূতিগুলো কীভাবে বদলে যায় তা ভাবছিলাম। প্রথম যেবার দেশ ছাড়ি সেবার ঠিক এই সময়ে কষ্ট হচ্ছিলো খুব। প্লেন ছাড়ার আগ মুহূর্তে নিজেকে ভীষণ দুর্বল মনে হচ্ছিলো। অথচ পালিয়ে যাওয়ার অমন সুযোগ পেয়ে কেনো পিছু ফিরবো - এ ভাবনা আমাকে থামিয়েছিলো। এবার পুরো অন্যরকম। এয়ার-ক্রু’দের যাত্রা শুরুর এ প্রস্তুতি বড়ো দীর্ঘ মনে হয়। মনে হয়, অনেকদিন আমি এভাবে এখানেই বসে আছি অপেক্ষায়। তখন আমার বাম পাশের সীটে এসে বসে সে-ই বুড়ো, মিটিমিটি হাসছে। এ বুড়ো আমার ছায়া ছাড়ে না। অকারণে এসে যন্ত্রণা দিয়ে যায়। অথচ সামিরার সঙ্গে এবার যখন প্রথম দেখা হলো, বিকেলে আমি অপেক্ষায় ছিলাম, সামিরা আসবে কি আসবে না দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম, তখন বুড়োকে মনে পড়ছিলো।
আমি জানতাম সময়টা আসবে একদিন। আমি অপেক্ষা করবো, ঘড়ি দেখবো – কখন সামিরা সুলতানা আমার সামনে এসে বসবে। পাঁচ বছর খুব লম্বা সময় নয়। দেশে ফিরে এক সপ্তাহেই টের পেয়েছি ঢাকা শহর বদলে গেছে অনেক। পালটে গেছে মানুষ। ট্যাক্সি চড়ে বনানী মাঠ পার হওয়ার সময় আমেরিকান বার্গারের দোকানটি চোখে পড়লো না। চোখে পড়লো না আরও অনেক কিছু। কাঁচঘেরা এ তাপ-শীত নিয়ন্ত্রিত ফাস্টফুডের দোকানে বসে আমি সামিরা সুলতানাকে ভাবি। স্মৃতি হাতড়াই, ঠিক এই মুহূর্তটিকে আমি কতোবার কতোভাবে ভেবেছি। কখনো মনে হয়েছে – সামিরা এসে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করবে - কেমন আছো, কখনো মনে হয়েছে – বলবে, জরুরী কাজ আছে, উঠতে হবে এখন। কিংবা আমাকে আসতে বলেও সামিরা সুলতানা আসবে না। বিকেল সাড়ে চারটার পরে ঘড়ির কাঁটা যখন আরও পনেরো মিনিট এগিয়ে যায়, তখন আমার মনে হয় সামিরা আজ আর আসবে না। তাহলে কি বুড়ো আসবে? এসে বলে দেবে - সামিরা আসবে নাকি আসবে না!
বুড়োর সঙ্গে প্রথম দেখা অনেক আগে। টরন্টো পৌঁছে উঠেছিলাম নাসিম ভাইয়ের বাসায়। আমার সারা জীবনের ধারণা ছিলো – বিদেশে মানুষ কষ্ট করে থাকে। কিন্তু, নাসিম ভাইদের অ্যাপার্টমেন্টে যে পাঁচজন বাংলাদেশী তরুণ থাকে, প্রথম তিন রাতে তাদের দেখে মনে হয়নি তারা কেউ কষ্টে আছে। কাজ থেকে ফিরে এক সঙ্গে সিনেমা দেখছে, এনটিভি’তে সকালের খবর দেখে রাজনীতির গুষ্টি উদ্ধার করছে, কল সেন্টার থেকে আসা বিজ্ঞাপনী ফোনের জবাবে ইংরেজীর তুফান ছোটাচ্ছে। সবাই হাসছে, রান্না করছে। এসব দেখে আমার মনে হয়, আমি অনায়াসেই বিদেশে থাকতে পারবো। যে কলেজের অফার লেটারে টরন্টো এসেছিলাম, নাসিম ভাইয়ের পরামর্শে, ১ম সেমিস্টার ড্রপ করলাম সেখানে। আরও সপ্তাহ খানেক পরে, কাজের খোঁজে এখানে ওখানে ঘুরে, শেষে ডাক পেলাম জমজম হালাল শপে মাংস কাটার কাজে। ইন্টারনেট থেকে নেয়া লোকেশনের প্রিন্ট আউট ধরে ডানে বামে যাই। কুইন্স স্ট্রীটে এপাশ ওপাশ ঘুরি, চক্কর দিই বারবার, কিন্তু জমজম হালাল শপ খুঁজে পাই না। ‘জেন্টেলম্যান, ডু ইয়্যূ হ্যাভ এ চেইঞ্জ প্লিজ’ – ডাক শুনে পাশ ফিরে তাকাই। অগাস্টের শেষ সপ্তায় রোদেলা সকাল। এরপরও জ্যাকেট চাপানো দাড়িমুখো বুড়ো। হাতে খালি কফির মগ, ভেতরে কিছু কয়েন। সে কি জানতো যে আমি তারচেয়ে ভালো অবস্থায় নেই! ম্যাপ হাতে জিজ্ঞেস করি, এখানে কোন পথে যাবো…। বুড়ো আমাকে পথ ধরে নিয়ে চলে। জিজ্ঞেস করে - কবে এসেছি, কতোদিন থাকবো; এইসব। এরপরে একটু শব্দ করে হাসে, বলে – ‘তুমি আর কখনো ফিরে যাবে না’। আমার মনে হয় এ যেনো বনবাসে যাওয়া রাজপুত্রের প্রতি নিঝুম অরণ্যে সাধু বাবার ভবিষ্যৎবাণী। জমজম হালাল শপের সামনে এসে বুড়ো আঙুল দিয়ে ভেতর দেখায়। এরপর আমি ধন্যবাদ দিয়ে ভেতরে যাচ্ছি এমন সময় সে আমার শার্টের হাতা ধরে টান দেয়, বলে – ‘পুশকিন স্কয়ার তো ভেঙে গেছে, সেখানে এখন ম্যাকডোনাল্ডস’!
ঢাকায় ম্যাকডোনাল্ডস আসেনি এখনো। হয়তো চলে আসবে। শুনেছি কেএফসি জমেছে বেশ। সামিরার সঙ্গে বাইরে কোনো রেস্টুরেন্টে, শেষবার পিজা হাটেই, খেয়েছিলাম বলে মনে পড়ে। কিন্তু, চেনাজানা দোকান বাদ দিয়ে গুলশানের ভেতরের এমন নীরব গলির মুখের এ ফাস্টফুড দোকানে কেনো সামিরা আমাকে আসতে বললো - তার উত্তর ভেবে পাই না। সাড়ে চারটার পরে পনেরো এবং আরও পরে বিশ মিনিট পার হলে আমার মনে হয় সামিরা আর আসবে না। সামিরার সঙ্গে সাক্ষাতের এ দীর্ঘ প্রস্তুতি ব্যর্থ হলো। কতো কতো সম্ভাব্য প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর নিয়ে যে প্রস্তুতি, নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করা, কিংবা প্রয়োজনে সামিরার কাছে ক্ষমা চাওয়া। কিছুই হলো না। উঠে বেরিয়ে যাবো, এমন সময় – কালো বোরখা ঢাকা একজন আমাকে পাশ থেকে বলে, ‘যাচ্ছো কোথায়, ভেতরে চলো’। গলার আওয়াজে বুঝি – সামিরা। সামিরা সুলতানা। আমার অপেক্ষার সামিরা সুলতানা। দীর্ঘ প্রবাসে, কতো কতো বিষন্ন সকালে, ক্লান্ত দুপুরে, পথ হারানো বিকেলে বা ঘুম ভাঙা রাতে আমি সামিরাকে ভেবে গেছি। অসংখ্য ভাবনার শেষ গন্তব্য-বিন্দু ছিলো – আবার কি আমাদের দেখা হবে! যদি দেখা হয় তবে আলাপ শুরু হবে কী করে, কিংবা কী নিয়ে কথা বলবো আমরা! অনেকবার অনুশীলন করা নাটকের সংলাপ ভুলে গেলে সমবেত দর্শকের সামনে যেমন হয় – আমারও তেমন মনে হচ্ছিলো। সামিরা মাথার স্কার্ফ সরিয়ে আলাপ সহজ করে, ‘তুমি বেশ শুকিয়ে গেছো’। এর জবাবে আমারও এরকম কিছু বলা উচিত। কিন্তু, কালো পোশাক ঢেকে দিয়েছে সামিরার শরীর। আমি দেখতে পাই না, তাই বলতেও পারি না সামিরা শুকিয়েছে নাকি মোটা হয়েছে…। আমার চোখ বারবার সামিরার ঘাড়ে চলে যায়। সরানো স্কার্ফ পেঁচিয়ে আছে ঘাড়ে, ছয় বছর আগে আমার জীবনের প্রথম চুমু ছিলো সেখানে।
নেলী প্রথমবারই আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলো। হাত দিয়ে তার ঘাড় থেকে আমার তৃষ্ণার্ত মুখ সরিয়ে বলেছিলো – ওখানে নয়, ওভাবে নয়। বুলগেরিয়ার মেয়ে নেলী নিকোলোভার সঙ্গে পরিচয় জমজম হালাল শপে। বিশাল মাংসের স্তুপের সামনে প্রথম ছুরি হাতে আমি বুঝে গিয়েছিলাম, এ অনেক কঠিন কাজ। বারবার আমার নিশানা ভুল হয়। কখনো প্রয়োজনের চেয়ে জোরে কোপ মারি। হাড্ডিগুলো এবড়োথেবড়ো হয়ে যায়। তবুও আমি হাল ছাড়ি না। প্রতিদিন নতুন নতুন করে কায়দা শিখি। গরুর পেছনের রানের মাংস কাটার সময় লম্বালম্বি আর সামনের রানের সময় পাশাপাশি করে ধরতে হবে, এসব আমাকে নেলীই শিখিয়ে দেয়। আগ্রহের কমতি নেই দেখে নেলী নিজে এগিয়ে আসে, বলে – ওখানে নয়, ওভাবে নয়। তারপর নিজে ছুরি হাতে দেখায় কোন জায়গাটায় কীভাবে কাটতে হবে...। বুড়োর কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। এক সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফেরার পথে বুড়ো আমার পথ আগলে দাঁড়ায়, বলে – পুশকিন স্কয়ারের চায়ের দোকান আর নেই, সেখানে এখন ম্যাকডোনাল্ডস। আমার চোখে তখন ভীষণ ক্লান্তি, ঘরে ফেরার তাড়া। তবুও বলি – ‘পুশকিন স্কয়ার ভেঙে গেলে তোমার কী?’ বুড়ো আমার চোখে চোখে খেলা করে, ‘আমার কিছু নেই, তবে তোমার আর দেশে ফেরা হবে না’। এবার বুড়োকে আর সাধুবাবা মনে হয় না। মনে হয় – সেদিন আমার টেনশন ছিলো, চাকরি খোঁজার তাড়া ছিলো, তাই বুড়োর কথাকে ভবিষ্যৎবাণী মনে হয়েছিলো। আসলে, এ বুড়ো নিতান্তই পাগল – ভবঘুরে ভিক্ষুক, আমাকে ভড়কে দেয়ার চেষ্টা করছে...।
খুব আশ্চর্যজনকভাবে খেয়াল করি, সামিরা আমাকে ভড়কাচ্ছে না। অথচ এর আগে যতোবার সামিরার সঙ্গে সাক্ষাতের কল্পদৃশ্য ভেবেছি, মনে হয়েছে – সামিরা আমাকে নার্ভাস করে দেবে। আমাকে চমকে দেয়ার, তুচ্ছ করার, কাছে টানার কিংবা ছুঁড়ে ফেলার একটি কঠিন অস্ত্র তার হাতে আছে। এ ভয়াল অস্ত্রটি কারও বানানো ছিলো না। একদিন এক দুপুরে খেয়াল করেছিলাম সামিরা এ অস্ত্র হাতে আমার দিকে চেয়ে আছে, আর আমি মুষড়ে যাচ্ছি ক্রমশ। সেই থেকে শুরু - সামিরা আমাকে প্রভাবিত করে, আমি ভীত হই, পালাই। প্রথম প্রথম কেবল সামিরার কাছ থেকে পালানো। কিন্তু, এরপরে যখন, উপায় থাকে না, নিজের কাছ থেকে পালাতে ইচ্ছে করে, তখন আমি নাসিম ভাইকে ফোন করি। ভিসা পেয়ে ঢাকা-দুবাই-টরন্টোর এয়ার টিকিট কিনতে তিন মাস সময় লেগেছিলো। ঠিক যেদিন দেশ ছাড়ি সেদিন থেকে শুরু করে গত পাঁচ বছরের সব গল্প সামিরার জন্য জমা। অসংখ্য দিনের, স্মৃতির, কষ্টের, কিংবা অনুতাপের গল্প আমি করতে পারি – যদি সামিরা সুলতানা মনোযোগী শ্রোতা হয়, যদি বলে তার তাড়া নেই। এই আকাঙ্খা কিংবা অনুমান আমার প্রকাশ করা হয় না। ভেজিট্যাবল রোলে কামড় দিয়ে লেমন জুসে চুমুক দিচ্ছি, তখন মুখোমুখি সামিরা – তার হাতে অরেঞ্জ জুস। নীরবতা ভেঙে সামিরা জিজ্ঞেস করে, ‘ক’দিন থাকবে দেশে?’ আমি বলি, ‘ঠিক নেই। হয়তো একমাস কিংবা তিনমাস, অথবা আগামী সপ্তাহ’। সামিরা মাথা নাড়ে। আমার তীব্র আশা ছিলো, সামিরা জিজ্ঞেস করবে, ‘আগামী সপ্তাহ কেনো’; অথচ জিজ্ঞেস করে না। আমি টের পাই, সে-ই পুরনো অস্ত্র এখনো তার হাতে। অনেক সময় নীরব থেকে এ অস্ত্রের কারিশমা সে প্রকাশ করতে পারে। কথা চালু রাখতে আমি স্বাভাবিক থাকি, জিজ্ঞেস করি – ‘বাসার সবাই ভালো আছে?’ সামিরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। আমার এ প্রশ্নের ভেতরে আরও যে প্রশ্নটি লুকিয়ে আছে, যে প্রশ্নের উত্তর জানতে আমি নিজের সঙ্গে নিজে অবিরাম হুটোপুটি খেলেছি দুঃস্বপ্নে তা কি সামিরার জানা আছে? আমি ঐ প্রসঙ্গে আর যাই না, মনে কেবল একটিই ভয় - সেই পুরনো অস্ত্র। নীরবতা। সামিরা যেমন নীরব হয়ে গিয়েছিলো, আর আমি টের পেয়েছিলাম – ভয়াল এক অস্ত্রের মালিক সে হয়ে গেছে। ঐ অস্থির ঘুঘু ডাকা দুপুরে, যখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম – ‘তুমি রাগ করেছো?’ এর উত্তরে সামিরা কিছুই বলেনি। ভেবেছিলাম, হয়তো সে হাসবে, লজ্জা পাবে, কিংবা অনুতপ্ত হবে; যার স্পষ্ট প্রকাশ আমি তার চেহারায় দেখতে পাবো। কিন্তু ওসব কিছুই হয় নি। ‘তুমি রাগ করেছো?’ প্রশ্নের উত্তরে সে হু হু করে কেঁদেছে। আমি অপেক্ষায় ছিলাম আরও কিছুক্ষণ। কান্না থেমেছিল এক সময়। কিন্তু, এরপর ভয়ানক নীরব ছিলো সামিরা। মধ্য দুপুরের বিরান মাঠের মতো নীরব। আদালতে খুনের আসামীর বিচারের রায় ঘোষণার আগ মুহূর্তের মতো নীরব।
নেলীর ধারণা ছিলো – ভীষণ গোপন কষ্ট না থাকলে, আমার বয়েসী কোনো ছেলে এমন নীরব থাকে না। তুষার পড়া দিনে বরফ মাড়িয়ে আমরা কফি শপে বসি। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি, আমার নিজস্ব জগতে নেলী প্রবেশের সুক্ষ্ম চেষ্টা করছে। এ চেষ্টার শুরু কবে কোনদিন থেকে তা আমার জানা নেই। তবে, যেবার আমি বেখেয়ালে ছুরির কোপ নিজের কব্জিতে বসিয়ে দিলাম, রক্তে মাখামাখি হয়ে গেলো আমার হাত আর খাসির শিনার মাংস - সেবার নেলীর উৎকন্ঠা দেখে আমি টের পেয়েছিলাম, আরও একটি ভুল আরও একটি মেয়ে করতে যাচ্ছে। এই সম্ভাব্য ভুলের চিন্তা আমার মাথায় কিরকির আওয়াজ তোলে, হয়তো এ কারণেই কেটে যাওয়া কব্জির ব্যথা খুব ক্ষীণ মনে হয়। মনের ভেতর এ সিদ্ধান্ত জাঁকিয়ে বসে, আর যা-ই হোক নেলীকে এ ভুল করতে দেয়া যাবে না। নেলী নিকোলোভাকে ভুল থেকে বাঁচাতে আমার অতি সতর্কতা আরও নীরবতা নামায় আমার মধ্যে। নেলী জিজ্ঞেস করে, কী এমন গোপন কষ্ট আমার! আমি নেলীর কাছে মিথ্যে বলি, বলি – প্রকাশ্য কিংবা গোপন বলে কিছু নেই - আমি এমনই - বলতে নয় কথা শুনতে ভালোবাসি। সে আমাকে বুলগেরিয়ান গোলাপ কাজানলাস্কা রোজার গল্প বলে। ছয় বছর বয়সে পাশের বাড়ির ছেলেটি তাকে কাজানলাস্কা রোজা বলেছিলো, এ স্মৃতিকাতরতায় বিহবল হয় সে। আমি আরও আগ্রহী হই, বলি – তারপর? নেলীর আর কিছু বলার নেই, ঐ একটি গল্পই সে বলে বারবার। সাত বছর বয়সে কানাডায় পাড়ি জমায় তার পরিবার, তাই বুলগেরিয়ার স্মৃতি বেশি নেই। মূলতঃ দুজনের গল্পহীনতার কারণেই আমরা অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে আসি। আমাদের কফিশপ মহূর্তগুলো প্রলম্বিত হয় শেষ ট্রেনের অপেক্ষায়। সারাদিন কাজ করে, বরফ জমানো দিনে কফি চুমুক শেষে, আমরা উলটো পথে বাড়ি ফিরি প্রতিদিন। দিনে দিনে বরফ গলে, আকাঙ্খিত গ্রীষ্মের রোদ শেষে আরও এক শীতের শুরুতে ঝড় নামে এক শনিবার রাতে। নেলী আমার হাত ধরে বলে, ‘আজ আমার বাসায় চলো’।
রিন্টুরা আমাকে নিতে চায়নি। শেষ মুহূর্তেও নাফিজ ‘আয়্যাম শিউর – দিস ফাকিং লুজার উইল মেস এভরিথিং...’ বলে আমাকে রেখে যেতে চেয়েছিলো। আমি নীরব ছিলাম। কারণ, আমি চোখে দেখতে চেয়েছিলাম – রিন্টুদের গল্পগুলো কতোটুকু সত্য। এরা আমার বন্ধু, এবং বন্ধুর বন্ধু - সবাই গুলশানে থাকে, বনানীতে ক্লাস শেষে উত্তরায় লাঞ্চ করে, ধানমন্ডিতে জিমে যায়, আর বারিধারায় প্রেম করে। এরা পড়ালেখার কোর্সকে ক্রেডিট বলে, ভার্সিটির টিচারকে বলে ফ্যাকাল্টি। আমাদের খিলগাঁও মডেল কলেজ কিংবা তিলপাপাড়া মহল্লায় এসব ভাষার প্রচলন নেই। তাই সুন্দরী মেয়ে মানে কুল নাকি হট এ বিভ্রমে চক্কর খাই আমি, নীরব থাকি। সেদিন শেষ মুহূর্তে রিন্টু আমাকে নেয়, জিজ্ঞেস করে – ‘ভয় পাবি না তো?’ প্রবল আগ্রহে আমি সাহসী হই, বলি – ‘না, ভয় পাবো না’। ঘুষখোর বাবার কেনা লেক্সাস-জিএস থ্রি-হান্ড্রেডে নাফিজ আমাকে সামনে বসায়। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলে – কিপ কুল, বি কোআয়েট। রিন্টু-লিটন অন্য গাড়িতে, অন্যপথে। আমি চুপচাপ বসে থাকি। সিডি প্লেয়ারে – ইয়েলো ব্রিক রোড, দ্য ওয়ে আই এম; এমিনেম চিৎকার। মুখে চুইংগাম চিবিয়ে নাফিজ মাথা দুলাচ্ছে। এয়ারপোর্ট রোড ধরে গাড়ি ছুটছে...। আরও পরে বামে এবং ডানে, তারপরে আবার বামে ও কিছুটা সামনে গিয়ে মোড় ফিরতেই সাদা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে এসে নাফিজ গাড়ি থামিয়ে ফোন দেয়। হালকা ক্রীম কালারের টপস আর কালো স্কার্ট পরা কিশোরী বেরিয়ে আসে। আমি সীট বদলে পেছনে গিয়ে বসি। কিশোরী সামনে, নাফিজের পাশে। এরপর গাড়ি আরও চক্কর দেয়, উত্তরা দুই অথবা তিন, পাঁচ অথবা ছয় নম্বর সেক্টর পার হয়। এসব জায়গা আমার অচেনা, তাই কোন গলি পেরিয়ে গাড়ি আবার এয়ারপোর্ট রোডে ওঠে তা আমি বুঝি না। রিন্টু বলেছিলো, এমনই হয় – একজন গিয়ে নিয়ে আসে, বাকীরা অপেক্ষায় থাকে। এই প্রথম আমি রিন্টুর গল্পগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করি। আমার মনে পড়ে – কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় রিন্টুরা যখন খিলগাঁও ছেড়ে গুলশানে চলে আসে, আমাকে বলেছিলো – ঐদিকে লাইফের একটা ক্লাস আছে, স্ট্যান্ডার্ড আছে। নাফিজের গাড়ি বনানীর নিরিবিলি গেস্ট হাউজের পার্কিং লটে এসে থামলে আমার মনে হয় – রিন্টুদের জীবনে সত্যি উল্লাস আছে, স্বাধীনতা আছে। লিফটের বাটন টিপে তিন অথবা চার তলার রুমে যাওয়ার আগ মুহূর্তে আমি আবার ভীরু হয়ে উঠি। আমার জ্বর জ্বর লাগে, গায়ে কাঁপুনি আসে। তারপর এক রুমে দরজা খুললে ভেতরে রিন্টু এবং লিটনকে দেখতে পাই। টেবিলে চিভাস রিগ্যাল আর বিদেশি চিপস। নাফিজ পরিচয় করায় – ‘শী ইজ ফারিহা, আওয়ার হোস্ট টুডে’। আমি এই প্রথম নাম জানি তার – ফারিহা। ওরা হ্যান্ডশেক করছে, পরিচিত হচ্ছে। আমি জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। কার্ণিশে পড়ন্ত বিকেল। ফারিহা অবাক হয় – ‘ইয়্যু গাইজ ওয়্যার সাপোসড টু বি টু। হোয়াই ফোর?’ নাফিজ বোঝানোর চেষ্টা করে, আঙুল তুলে আমাকে দেখায় – ‘দ্যাট বয় ইজ গন্যা লীভ আস সুন’। ফারিহা চিৎকার করে – ‘আমাকে দু’জনের কথা বলা হয়েছে, নট থ্রি!’ লিটন এবার উঠে আসে, ফারিহার কাঁধে হাত রাখে – ‘ইয়্যূ আর সো হট, সুইটি’। এরপরও ফারিহার চিৎকার থামে না। নাফিজ পথ আঁটকায়, উঁচুস্বরে ধমক দেয় – ‘একদম চুপ, একটাও শব্দ নয়’। তখন আমার কী হয় জানি না, সবাইকে সরিয়ে হুট করে দরজা খুলে দিই, বলি – ‘ওকে যেতে দাও’। আমার কথা শুনে উঠে আসে রিন্টু। ভীষণ ভারী ঘুষি বসিয়ে দেয় আমার চোয়ালে – ‘ইয়্যূ মাদা-ফাকা, শাট আপ’! ওপাশ থেকে লিটন এসে দুমদুম লাত্থি দেয় আমার বুকে-তলপেটে, তারপর রিন্টু সজোরে চিভাসের বোতল ছুঁড়ে মারে আমার গায়ে। আমি প্রবল ব্যথায় মেঝেতে এক কোণায় দেয়ালে মুখ করে গুটি মেরে শুয়ে থাকি। ক্রমশ বন্ধ হওয়া চোখে দেখি – মেঝেতে আমারই আশেপাশে ফারিহার কালো স্কার্ট। ততক্ষণে নাফিজ হারিয়েছে ফারিহাকে, জিততে চলেছে রিন্টু এবং লিটন। আমার উঠতে ইচ্ছে করে, কিন্তু উঠতে পারি না। মনে হয় – এক ডুব সাঁতারে নেমেছি আমি, পানির নিচে শুনতে পাচ্ছি উপরের মানুষের সমবেত চিৎকার - করতালি। তখন আমার অমন ঘুম পেলো কেনো...!
ঘরে তৈরি ডিনার শেষে নেলী আমাকে জিজ্ঞেস করে – ‘এখনই ঘুমোবে?’ আমি হাই তুলি, বলি – ‘হুম ঘুম পাচ্ছে’। গায়ে গাউন চাপিয়ে নেলী আমার পাশে এসে বসে। আমি সে-ই বুড়োর গল্প বলি, জিজ্ঞেস করি – পুশকিন স্কয়ারের চায়ের দোকান ভেঙে ম্যাকডোনাল্ডস হওয়া মানে কী? নেলী হাসতে থাকে, আমার হাতের আঙুল নিয়ে খেলা করে। বলে - ঐ বুড়ো রাশিয়ান, মস্কো থেকে এসেছিলো রিফিউজি হয়ে, এখনো কম্যুনিজমের স্বপ্ন দেখে আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিক্ষা করে। আমি নেলীকে বলি, মাংসের দোকানের কাজ আমার আর ভালো লাগে না, আমিও ঐ বুড়োর মতো – ভিক্ষা করবো। নেলী অবাক হয় কিনা জানি না, তবে মুহূর্তেই ‘আমাকেও নিয়ো সঙ্গে’ বলে আমার কপালে চুমু বসিয়ে দেয় সে। এ ঘটনার আকষ্মিকতায় আমি চুপ মেরে যাই। এরপর নেলী আমার চুলে বিলি কাটে। বুলগেরিয়ান গান শুনবো কিনা জিজ্ঞেস করে। এমন শরীরি ঘনিষ্ঠতা অসহ্য লাগে আমার। বুক ধুকধুক করে। গায়ে প্রবল কাঁপুনি আসে। আমি নেলীকে বলি, ‘ঘরের হিটারটা বাড়িয়ে দাও, আমার শীত করছে’। এপার্টমেন্টের অটো কন্ট্রোলড হিটার বাড়ানোর বা কমানোর সাধ্য তার নেই। তাই আমার কাঁপাকাঁপা গায়ে নেলী চাদর চাপিয়ে দেয়, সাথে নিজেকেও। এমন উষ্ণতায় আমার দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। কিন্তু তুষার ঝড়ের রাতে এ উষ্ণতা ছেড়ে রাস্তায় বেরুতে ইচ্ছে করে না। বরং টের পাই – কখন আমার হাত দুটোও দ্রুত চঞ্চল হয়ে উঠেছে। খুলে নিচ্ছে লাইট-পিংক ভিক্টোরিয়াস সিক্রেট। আরও পরে আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁট নেলীর ঘাড়ে গেলে সে হাত দিয়ে সরিয়ে দেয় – বলে, ওখানে নয়, ওভাবে নয়...।
ঘুম নয়, আমি অজ্ঞান হয়েছিলাম। সম্বিৎ ফিরে এলে, অনেক কষ্টে দাঁড়িয়ে দেখি বিছানায় কাত হয়ে পড়ে আছে ফারিহা। আর কেউ নেই। বাইরে রাত নেমেছে। আমি ফারিহার গায়ে ধাক্কা দিই, ডাকি। সাড়া নেই। রিন্টুকে ফোন করি, তার মোবাইল বন্ধ। কী করবো ভেবে পাই না। আরও পরে ফারিহা চোখ খোলে, বিড়বিড় শব্দ করে, খাটের ওপাশে পড়ে থাকা মোবাইল ফোন দেখিয়ে, বলে - সামিরা আপু। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘সামিরা আপুকে ফোন দেবো?’ বিধ্বস্ত ফারিহা কী বলে বুঝি না, তবে আমি ফোনবুক সার্চ করে সামিরা আপুকে ফোন দিই। সংক্ষেপে বলি – ফারিহা এখানে, নিরিবিলি গেস্ট হাউজ বনানী, রুম নম্বর...। আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সামিরা আপু বুঝে নেয় অনেক কিছু। মিনিট চল্লিশেক পরে পরিপাটি সালোয়ার কামিজ – মাথা ঢাকা ওড়নায় সামিরা নামের এক তরুণী এসে কড়া নাড়ে। ফারিহাকে দুপাশে দুজন ধরে গাড়িতে তুলি। সামিরার বাসার গেটে পৌঁছলে আমাকে বিদায় জানানো হয়। গাড়ী থেকে নামার মুহুর্তে সামিরা আমার ফোন নম্বর চেয়ে নেয়। সে রাতে আমার ঘুম হয়নি। মাঝরাতে কোথাও সাইরেন বাজিয়ে এম্বুলেন্স চলে গেলে আমার মনে হয় – একদল পুলিশ আমাদের তিলপাপাড়া মহল্লা ঘিরে রেখেছে, আমাকে এরেস্ট করে নিয়ে যাবে – আর শতশত মানুষ দেখবে সে দৃশ্য। এরকম দুঃশ্চিন্তায় আমার ঘুম ভেঙে গেছে পরের আরও তিন রাত। চতুর্থ রাতে সাইরেন কিংবা হুইসেলের শব্দে ঘুম ভাঙলে দেখি আমার মোবাইলে রিং হচ্ছে। সামিরা সুলতানা। আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় সে। আমি ভয় পাই, সকাতরে জানাই – আমি ফারিহাকে হেল্প করতেই চেয়েছিলাম। সামিরা অভয় দেয়, ফারিহা বলেছে সব, আমার কোনো দোষ নেই। এরকম আরও কয়েকবার ফোন আলাপ শেষে আমি সামিরা সুলতানার সঙ্গে দেখা করি। ফারিহার কাজিন সামিরা সুলতানা, সাত মসজিদ রোডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্রী। এরপরে আরও বেশ কয়েকবার দেখা হলে, আল-বাইকে বসে চিকেন উইংয়ে কামড় দিতে দিতে সামিরা জিজ্ঞেস করে – আমি কেনো নিরিবিলি গেস্ট হাউজে গিয়েছিলাম। এ প্রশ্নের উত্তর যতোটা সহজভাবে জানি, ততটা কঠিন লাগে প্রকাশে। আমার এ দ্বিধা – প্রকাশ্য অস্পষ্টতা ও ভীরু চাহনিতে সামিরা হয়তো বুঝে গেছে – আমি নির্বিষ প্রকৃতির ছেলে, আমার ওপর নানা কারণে আস্থা রাখা যায়। তাই আমার সঙ্গে যোগাযোগে এক রকম নিরাপদ বোধ করে সে। আমিও সামিরাকে সঙ্গ দিই – রাপা প্লাজায়, মেট্রো শপিংয়ে কিংবা আড়ং-এর শো পিস সেকশনে। এমন চার অথবা পাঁচ মাস গেলে আমি একদিন ভয়ে ভয়ে সামিরাকে জিজ্ঞেস করি – ‘ফারিহা কেমন আছে?’ জবাবে সামিরা জানায় – লন্ডন চলে গেছে সে, মায়ের কাছে। এ সংক্ষিপ্ত উত্তর আমার জানার আগ্রহ মেটায় না। তবে অনুমান করে নিই, ফারিহা ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে, এতদিন বাবার কাছে থাকতো। ইংরেজী স্কুলে পড়ার কারণে নিয়ন্ত্রণহীন জীবন ছিলো তার, যেমন ছিলো এবং আছে নাফিজ-লিটন-রিন্টুদের। এখন মায়ের কাছে ফিরে গেছে ফারিহা। আবার এমনও মনে হয় – ফারিহা এ শহরেই আছে, সামিরা আমাকে মিথ্যে বলেছে। তবে আমি এই সত্য-মিথ্যা উদ্ঘাটনে যাই না। বরং ভালো লাগে, সামিরার সঙ্গে আমার একরকম বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে আমি তখন সামিরাদের ধানমন্ডির বাড়িতেও যাই। হিন্দি সিনেমা এবং ক্রিকেট নিয়ে আলাপ করি। কয়েক মাসে আপনি থেকে তুমিতে নেমে – সামিরা আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কখনোই কোনো মেয়ের হাত ধরোনি?’ আমি উত্তরে বলি, ‘এখনো না’। সামিরা কোনো ছেলের হাত ধরেছে কিনা সে প্রশ্ন আর করা হয় না। ততক্ষণে নিজের হাতে আমার হাত তুলে নিয়েছে সামিরা।
বুড়ো আমার পথ আগলে রাখে। বলে, উত্তর তোমাকে দিতেই হবে, বলো – কেনো পুশকিন স্কয়ার ভেঙে গেলো। আমি বুড়োকে ধাক্কা দিই, পথ ছাড়তে বলি। কিন্তু না, বুড়ো পথ ছাড়বে না। আমার কারণেই নাকি পুশকিন স্কয়ারের চায়ের দোকান ভেঙে গেছে, সেখানে এখন জমজমাট ম্যাকডোনাল্ডস। অতএব শাস্তি আমাকে পেতেই হবে। হাত ধরে আমাকে বুড়ো নিয়ে যায় ট্রেন স্টেশনে। অন্ধকার সে আন্ডারগ্রাউন্ড। বুড়ো আমাকে নির্দেশ দেয়, রেল লাইনে শুয়ে থাকতে হবে। আমি উঠতে চাই, কিন্তু পারি না, বুড়ো লাঠি হাতে আমাকে ভয় দেখায়। দূর থেকে ট্রেন আসছে, আমার গায়ের ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাবে, এমন সময় মনে হয় আরও দূর থেকে করুণ স্বরে কে যেনো ডাকছে আমাকে, তাই আমি সরে যাই। গা ঘেঁষে ট্রেন চলে গেলে বুড়ো আমাকে ধমক দেয় - কেনো সরলাম আমি। আমাকে মারতে চায় সে। আমি ভয়ে হাসফাঁস করি। নেলী আমাকে জড়িয়ে ধরে হাল্কা ঝাঁকুনি দেয়, জিজ্ঞেস করে – ‘দুঃস্বপ্ন দেখছিলে?’ আমি উঠে বসি। জানালার পর্দায় সফেদ আলো। বাইরে সকাল হয়ে গেছে। বলি – বাসায় ফিরবো, ভালো লাগছে না। নেলী কফি করতে চায়, কিন্তু আমার ইচ্ছে করে না। দ্রুত নেলীর বাসা থেকে বেরিয়ে আসি। পথে সেই বুড়ো এবার সত্যি সত্যি আমার পথ আঁটকায়। রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে – ‘তোমার আর কখনোই দেশে ফেরা হবে না’। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কেনো?’ বুড়ো আর জবাব দেয় না। পুশকিন স্কয়ার নিয়েও কিছু বলে না। রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে রাখে মুখে, চোখের ভুরু ওঠানামা করায়। যেনো আমাকে জিজ্ঞেস করছে – ‘নেলীকে তুমি ভালোবাসো?’ এই প্রথম আমি গত রাতের জন্য অপরাধবোধে ভুগি। আমার মনে পড়ে সামিরার নীরবতার কথা। সেই এক মৃত দুপুরে সামিরার বাসায় আমাদের হঠাৎ জেগে ওঠার কথা। এপ্রিলের প্রচন্ড গরমের সে দুপুরে হঠাৎ কোত্থেকে এক ঘুঘু এসে সামিরার জানালায় বসেছিলো। আমাদের দিকে তাকিয়ে ডেকে চলেছিল বিরামহীন। মুহূর্তগুলো আরোপিত ছিলো না বলে, কোনো পক্ষ থেকে অসম্মতি ছিলো না বলে – অনায়াসে আমি সামিরার ঘাড়ে চুমু দিয়েছিলাম তখন। সাদামাটা একটি মৃত দুপুর এভাবে আমাদের জীবনে অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠে, তাই এতদিন পরেও মনে পড়ে সেই ঘুঘুর ডাক। আর ঘুঘু-ডাকা দুপুরে আমার সমাপনী জিজ্ঞাসা - ‘তুমি রাগ করেছো?’ যার উত্তরে সামিরা কিছুই বলেনি। হু হু কান্না শেষে অস্বাভাবিক নীরবতায় ডুব দিয়েছিলো সে। ঐ নীরবতায় সামিরার ব্যক্তিগত আদালতে আমার মৃত্যুদন্ড ঘোষিত হয় সেদিন।
সামিরার নীরবতার মধ্যেও পারষ্পরিক যোগাযোগ এবং যাতায়াত ছিলো অনিয়মিত। কেবল সাক্ষাতের উষ্ণতাটুকু ছিলো না। ঘুঘু-ডাকা দুপুরের পরে, হয়তো মাস দেড় দুই পরে, এক বিকেলে সামিরা ফোন করে বলে – ‘আয়্যাম এক্সপেক্টিং’। এ দুটো শব্দ আমাকে বিহবল করে তোলে। অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত সময়ের সামনে আমি দাঁড়িয়ে। মাথার ভেতর হাজারো শব্দে বিচরণ করেও আমি বলার মতো কোনো বাক্য খুঁজে পাই না। সামিরার নীরবতা এবার আমাকে গ্রাস করে। আমাকে দু’দিন ভাবার সময় দেয় সে – ‘বিয়ে করবে কি করবে না বলো’। পরীক্ষার খাতায় জটিল ক্যালকুলাস মেলানো আমার একুশে মাথায় এ বড্ডো ধাঁধাময় মনে হয়। আমার চারপাশ কেবলই শুন্যতায় ভরে ওঠে। পরামর্শের জন্য ছুটি রিন্টুর বাসায়। সেখানে নাফিজ এবং নীল শার্ট পরা অচেনা এক তরুণ আমার কথা শুনে হো হো শব্দে হেসে ওঠে। নাফিজ খ্যাসখ্যাস গলায় বলে – ‘দ্যাট স্লাট হ্যাজ মেইড ইয়্যূ এ ভিক্টিম’। পাশের নীল শার্ট পরা অচেনা তরুণ সম্মতি দেয়, সামিরা তার অনেক দিনের চেনা। আমার ভীরুতা, মানসিক দূর্বলতা এবং সামগ্রিক অক্ষমতা আমাকে সাহস জোগায় নাফিজের কথায় বিশ্বাসী হতে। পরদিন সামিরার প্রশ্নের জবাবে ফোনে চিৎকার করি, ‘ইয়্যূ ব্লাডি ফ্রীক প্রস, গো টু হেল – ডোন্ট ট্রাই টু রুইন মাই লাইফ’। এ কথা শুনে সামিরা নিঃশব্দে ফোন রেখে দেয়। আমি তখন বিড়বিড় করি, না – এ কথা আমি বলতে চাইনি। আমি অন্য কিছু বলতে চেয়েছিলাম। অথচ কী বলতে চেয়েছিলাম তা আমার জানা নেই। সামিরাকে আর ফোন করিনি, কারণ আমি তার থেকে আড়ালে থাকতে চেয়েছি। কিন্তু, এভাবে আরো দিন গেলে টের পাই – আমি আসলে আমার নিজের কাছ থেকে পালাতে চাইছি। এ চেনা শহর, শহরের খিলগাঁও তিলপাপাড়া মহল্লা, এই কোলাহল, এই মুখরতা আমার ভালো লাগে না। আমি দেশ ছাড়ার প্ল্যান করি, কানাডায় নাসিম ভাইকে ফোন করি।
জমজম হালাল শপে কাজ করে প্রথম মাসে যেদিন বেতন পেলাম, সেদিন দেশ থেকে রিন্টুর মেইল পাই – সামিরা তার বাবার বন্ধুর ছেলেকে বিয়ে করেছে। এলিফ্যান্ট রোডে কম্পিউটার এক্সেসরিসের ইম্পোর্টার ব্যবসায়ী পাত্র। কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্রী সামিরা সুলতানার কম্পিউটার ব্যবসায়ী বর এবং তাদের সুখী জীবন কামনা করে সেই সন্ধ্যায় আমি কিছুটা নির্ভার হই। কিন্তু, একটি প্রশ্নের উত্তর আমার জানা হয় না। গত সপ্তায় দেশে নেমে তিনদিনের মাথায় সামিরাকে যে প্রশ্ন করতে ফোন করেছিলাম, কিন্তু সাহসের অভাবে করতে পারিনি, সে প্রশ্ন এবার আমি সামিরাকে করবো কিনা ভাবি। গুলশানের এ নীরব ফাস্টফুড দোকানের কোণার টেবিলে তখন কেবল আমরা দুজন মুখোমুখি। অনেক নীরবতা শেষে সামিরা যখন বলে – ‘এবার আমাকে যেতে হবে’ তখন আমি কাঁপাকাপা গলায় জিজ্ঞেস করি, ‘বাচ্চাটি কেমন আছে?’ এ প্রশ্ন শুনে সামিরা ভীষণ সরাসরি আমার চোখে চোখ রাখে। হয়তো রাগের তীব্রতায় সে নিজের ঠোঁটে কামড় দেয়। কয়েক মুহুর্ত নীরবতায় স্থির থাকে। তারপর ভারী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে বলে – ‘দ্যাট বাস্টার্ড ওয়াজ এবর্টেড’। এ উত্তর আমার কাছে চমকের কিছু মনে হয় না। কারণ, গত পাঁচ বছরের অনেক অনেক সম্ভাব্য অনুমানে এ উত্তরটিও ছিলো। তাই আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি। এক সময় ‘ভালো থেকো’ বলে সামিরা বিদায় নেয়। এরপর আরও সময় যায় সে সন্ধ্যায় এবং রাতে। আমি কেবলই অনুভব করি – কঠিন এক প্রশ্নের উত্তর আমি জেনে গেছি। আমার আর কিছু জানার নেই, সামিরার এ উত্তরের পরে আমি এক অন্যরকম ছুটি পেয়ে গেছি। এবার বরং গত পাঁচ বছরে আপন হয়ে ওঠা অচেনা শহরটিতেই ফেরা যাক। নেলী নিকোলোভার কাছে কাজানলাস্কা রোজার গান শোনা যাক। তাই আমি আবার দেশ ছাড়ার দিনক্ষণ ঠিক করি...।
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্রপেলার যখন চালু হচ্ছে, যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি শেষের দিকে। আমি রানওয়ের কাক-শালিক কিংবা অন্য কোনো পাখি দেখছি, প্রথমবার দেশ ছাড়ার অনুভূতিগুলো ভাবছি, তখন সেই বুড়ো আমার কাঁধে ধাক্কা দেয়। মিটিমিটি হেসে বাংলায় বলে – ‘বাচ্চাটি বেঁচে আছে এখনো’। শুনে আমার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে। মনে হয় – প্লেনের সমূহ ইঞ্জিন আমার মাথায় ঢুকে যাচ্ছে। যেনো আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে গেছে, পা নাড়তে পারছি না। ঘাড় পিঠ টানটান শক্ত হয়ে আছে, আবার মনে হয় - কিরকির শব্দে মাথা ছিঁড়ে আলাদা হয়ে ওপরের দিকে উড়াল দেবে এক্ষুণি। এরকম অসহ্য যন্ত্রণায় নিজেকে খানিক সামলে কিছু একটা বলতে পাশ ফিরলে দেখি – সেখানে কেউ নেই। সৌম্য স্মিত চেহারার এয়ার-ক্রু আমার সামনে দাঁড়িয়ে -‘স্যার, সীট বেল্ট বেঁধে নিন- প্লিজ’ । আমি তার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করি – পুশকিন স্কয়ার ভেঙে গেছে, সেখানে এখন ম্যাকডোনাল্ডস।
0 মন্তব্য::
Post a Comment