29 April, 2011

নিষিদ্ধ লোবান, গেরিলা ও মেহেরজান


“আমি তোমায় সন্তান দিতে পারব। উত্তম বীজ উত্তম ফসল। তোমার সন্তান খাঁটি মুসলমান হবে, খোদার ওপর ঈমাণ রাখবে, আন্তরিক পাকিস্তানী হবে, চাওনা সেই সন্তান? আমরা সেই সন্তান তোমাদের দেব, তোমাকে দেব, তোমার বোনকে দেব, তোমার মাকে দেব, যারা হিন্দু নয়, বিশ্বাসঘাতক নয়, অবাধ্য নয়, আন্দোলন করে না, শ্লোগান দেয় না, কমিউনিস্ট হয় না। জাতির এই খেদমত আমরা করতে এসেছি। তোমাদের রক্ত শুদ্ধ করে দিয়ে যাব, তোমাদের গর্ভে খাঁটি পাকিস্তানী রেখে যাব, ইসলামের নিশানা উড়িয়ে যাব। তোমরা কৃতজ্ঞ থাকবে, তোমরা আমাদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তোমরা আমাদের সুললিত গান শোনাবে।”
                                           (নিষিদ্ধ লোবান, সৈয়দ শামসুল হক)



সীট ছিল একেবারে শেষ সারির আগে সারিতে।
সিনেমা শেষের পরে ধাক্কাধাক্কি এড়ানোর জন্য বসে থাকা নয়, একরকম বিমোহিত অনুভূতি নিয়ে বসেছিলাম আরো কিছুক্ষণ। সম্ভবতঃ গতবছর রেডিওতে শুনছিলাম ‘গেরিলা’ ছবির শ্যুটিং নিয়ে আলোচনা, ফোনে কথা বলছিলেন – জয়া আহসান, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুসহ আরো ক’জন কুশলী। শুনেছিলাম, সৈয়দ শামসুল হকের “নিষিদ্ধ লোবান” অবলম্বনে কাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের ছবি, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু এবং সৈয়দ হক; এই তিনের সংমিশ্রণ আছে বলেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম – গেরিলা দেখতে যাবো।

অনেকদিন ধরে পড়বো পড়বো করেও পড়া হচ্ছিলো না – সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস “নিষিদ্ধ লোবান”। আজ সকালে প্রস্তুতি নিয়ে পড়া শুরু করলাম। কাহিনী খুব দীর্ঘ নয়, সম্ভবতঃ দুই কি তিনদিনের গল্প, কিন্তু সৈয়দ হকের সম্মোহনী গদ্য একটানে নিয়ে যায় চৌষট্টি পৃষ্ঠার উপন্যাসের শেষে। বিশাল অংশ জুড়ে আছে লাশ সরানোর, মাটি চাপা দেয়ার গল্প। টানটান বিবরণ।

পর্দায় গেরিলার কাহিনী অবশ্য অন্যরকম।
শুরুতে আছে শহুরে জীবন। একেবারে বিরতির আগে পর্যন্ত। এরপরে বিলকিস গ্রামে ফিরে গেলে ‘নিষিদ্ধ লোবান’এর গল্প শুরু হয়। অবশ্য ছবি  শুরুতে দেখেছিলাম, কাহিনী - একজন মুক্তিযোদ্ধার অভিজ্ঞতা ও সৈয়দ শামসুল হকের “নিষিদ্ধ লোবান” অবলম্বনে। ছবির গল্পটুকু থাক না দেখা দর্শকের জন্য। ছবি নির্মাণ, শিল্পের বিদগ্ধ সমালোচকের ‘ক্যামেরার কাজ’ও বাকী থাক। শুধু বলি -পুরো ছবিটির দৃশ্য, জীবন, ধারণ – সবকিছু ছিল ৭১এর। রাস্তা, বাড়িঘর, পোশাক – সবকিছুতে সে সময়ের ছায়া ছিল।
গেরিলা কোনো ফ্যান্টাসি ফিকশন নয়। গেরিলা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের একদল গেরিলার অপারেশন, সাধারণ মানুষের শংকা, প্রাণের অনিশ্চয়তা, পাকি হানাদারদের নৃশংসতা, ধর্মের নামে হত্যা, খুন, লুটপাট, ধর্ষণ, সংখ্যালঘু নিধন – এর অনবদ্য আখ্যান। দেয়াল লিখন ও ব্যানারগুলো অসাধারণ। ম্যুভি রিভিউ বা দর্শক প্রতিক্রিয়া লেখা চেষ্টা করলাম না। বরং রায়হান আবীরের পোস্টের বক্তব্যের সাথে সহমত জানালাম।

২০১১ সালের এপ্রিলে এসে “গেরিলা” সিনেমাটি গুরুত্বপূর্ণ কেন?
গুরুত্বপূর্ণ একারণে যে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার নামে এখন “মেহেরজান” বানানো হচ্ছে। বাঙালি নারীর সঙ্গে পাকি সৈন্যের সঙ্গম-প্রেম কাহিনী দেখানো হচ্ছে। বিদেশী সেলিব্রিটি সেখানে অভিনয় করছে। “মেহেরজান” বানাচ্ছে কোনো ঝন্টু-মন্টু-মোহাম্মদ হোসেন না। মেহেরজান বানাচ্ছে - বিদেশে পড়ালেখা করা একদল জ্ঞানপাপী। দু’লক্ষ উনসত্তর হাজার নারী নিপীড়নের সত্যতাকে মিথ্যে প্রমাণ করতে শর্মিলা বসুরা যখন তৎপর তখন আমাদেরই মন্ত্রীকন্যা নির্মাণ করে “মেহেরজান” নামক এক অশ্লীল ছবি। এ অশ্লীলতা মুনমুন-ময়ুরী-ঝুমকার স্বল্পবসনা স্থুলকায়া সুড়সুড়ির চেয়ে অশ্লীল, ডিপজলের গালির চেয়েও অশ্লীল, মালেক আফসারীর রাজা’র চেয়েও অশ্লীল। “মেহেরজান” আমাদের ইতিহাসকে বিকৃত করে, “মেহেরজান” একাত্তর সালে আমার কিশোরী মায়ের পালিয়ের বেড়ানোর অনিশ্চিত দিন, মাইলের পর মাইল রাতে হাঁটাকে অপমান করে। “মেহেরজান” বিদ্রুপ করে গুরুদাসীকে। তাই দর্শক মেহেরজানকে বয়কট করে।
কিন্তু হায়, ঈশ্বর!
নষ্টেরও বুঝি পরিতোষক থাকে? সেটাই দেখলাম। একদল নষ্ট অধ্যাপক, স্থুল সৌন্দর্য্যধারক, ভন্ড সমালোচক মেহেরজানকে হালাল করতে এগিয়ে আসে। এরা কাউন্টার ন্যারেটিভ, আউট অফ ফ্রেম, ডিসকোর্স - এজাতীয় জার্গনে মায়ের ধর্ষণকে জায়েজ করতে খাটুনি দেয় ব্লগে, পত্রিকায়, ফেসবুক নোটে। পৃথিবীর কুৎসিততম জিনিশটিকেও এইসব নষ্ট-ভ্রষ্টদল অ্যাকাডেমিক আলোচনার তকমায়, বাহারী মোড়কে সুন্দর করে পরিবেশন করবে। আমি নিশ্চিত – একাত্তরের নিপীড়িত নারীদের নিয়ে অনলাইনেই যেসব লিখিত ডকুমেন্ট – ভিডিও পাওয়া যায় এগুলো এই অসভ্য অধ্যাপকদের চোখে পানি আনে না, আনবে না। তলানীর শরাবের লোভ, লেনাদেনার খুদ-কুটা, মিডিয়ায় ফোকাস; এসবের লোভে এই নিজের জন্মকে অস্বীকার করবে, নিজের মা’কে বিক্রি করে দেবে, এটুকুও কুন্ঠা করবে না।

নিন্দিত “মেহেরজান” যখন তার মিশনে ব্যর্থ, নষ্ট অধ্যাপক-সাংবাদিক-বিজ্ঞের দল যখন মেহেরজানের পক্ষে আরো ‘অ্যাকাডেমিক” পেপার লেখায় ব্যস্ত, তখন “গেরিলা” যেন এক সত্যালোকিত সকাল। গেরিলা’য় আমরা দেখি – পাকি কুত্তার বাচ্চা সেনাগুলো এদেশে প্রেম করতে আসেনি। আমাদের মায়েরা পাকিদের প্রেমে পড়ে নিজেদের বিকিয়ে দেয়নি। পাকি হানাদার ও এদেশীয় জামাত ইসলামের রাজাকারগুলো একাত্তরে কী করেছে, নারী ও সংখ্যালঘুকে কোন দৃষ্টিতে দেখেছে – তার এক ঝলক আছে গেরিলায়। কাউন্টার ন্যারেটিভের কুৎসিত ডিসকোর্সের গালে এক প্রচন্ড চড়-আঘাত। স্যালুট - নাসির উদ্দীন ইউসুফ, জয়া আহসান, এবং অন্যসব কুশলীব।

পুনশ্চঃ
একাত্তরের মতো একটি মীমাসিংত বিষয় নিয়ে এখনো কেন তর্ক হয়, এখনো কেন মিরপুর স্টেডিয়ামে তেইশে মার্চের খেলায় পাকি পতাকা ওড়ে, পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান উচ্চকিত হয়, জার্সি বদল হয়, কেন সমালোচকের বেশে একদল সুশীল ‘মেহেরজান’ তও্বকে লেহন করে – সে প্রশ্নের খানিক উত্তর পেলাম “নিষিদ্ধ লোবান”এ শেষের অংশে। জলেশ্বরী হাইস্কুল ক্যাম্পে বিলকিসকে উদ্দেশ্য করে পাকি মেজরের সংলাপ –

“আমি তোমায় সন্তান দিতে পারব। উত্তম বীজ উত্তম ফসল। তোমার সন্তান খাঁটি মুসলমান হবে, খোদার ওপর ঈমাণ রাখবে, আন্তরিক পাকিস্তানী হবে, চাওনা সেই সন্তান? আমরা সেই সন্তান তোমাদের দেব, তোমাকে দেব, তোমার বোনকে দেব, তোমার মাকে দেব, যারা হিন্দু নয়, বিশ্বাসঘাতক নয়, অবাধ্য নয়, আন্দোলন করে না, শ্লোগান দেয় না, কমিউনিস্ট হয় না। জাতির এই খেদমত আমরা করতে এসেছি। তোমাদের রক্ত শুদ্ধ করে দিয়ে যাব, তোমাদের গর্ভে খাঁটি পাকিস্তানী রেখে যাব, ইসলামের নিশানা উড়িয়ে যাব। তোমরা কৃতজ্ঞ থাকবে, তোমরা আমাদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তোমরা আমাদের সুললিত গান শোনাবে।”

নিষিদ্ধ লোবানে বিলকিস সে সুযোগ দেয়নি। কিন্তু পাকি মেজরের স্বপ্ন কিছুটা হলেও সত্যি হয়ে গেছে দূর্ভাগ্যজনকভাবে। মেহেরজানের পক্ষে ক্যানভাসার সুশীল সন্তানগুলো মূলত পাকি মেজরের বর্ণিত উত্তম বীজের উত্তম সন্তান। শুক্রাণু ডিম্বানুর বিচারে না হলেও আত্মাগতভাবে এরা পাকিস্তানী। এরা পাকিস্তানের নিশানা উড়িয়ে যাবে, কৃতজ্ঞ থাকবে, পাকিস্তানের পথের দিকে তাকিয়ে থাকবে। আর সুললিত গান? সেটা তাদের নির্মোহ অ্যাকাডেমিক ডিসকোর্সের কুৎসিত শব্দমালা ছাড়া আর কিছু নয়।

Read more...

23 April, 2011

ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়...


শাকিল স্যার দেশে এসেছেন সপ্তাহ খানেকের জন্য। পরশু ধানমন্ডি-বসুন্ধরা-ধানমন্ডি কিছু কাজ, সঙ্গে থাকা, স্মৃতিকাতরতা; এসবের মাঝে টুপ করে থামিয়ে দিলেন এই বলে, “তোমার লেখালেখির কী অবস্থা?”
আমি বলি, “স্যার, ওসব এখন পারি না। সময় পাই না।”

রাইটার্স ব্লক নাকি অন্য কিছু সে আলাপে যাইনি। মনে পড়ছিল, স্যার কীভাবে গুগলিং করে ‘ছাদের কার্ণিশে কাক’ পেয়েছিলেন, পড়ে মেইলে জানিয়েছিলেন কেমন লেগেছে।

বাসায় ফিরে ছাদের কার্ণিশে কাক পিডিএফ ফাইলে চোখ বুলালাম। এখন পড়ছি ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েলের বই “হোয়াট দ্য ডগ স্য”; একটা আর্টিকেলে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে – আমরা আইডিয়া কোত্থেকে পাই? এ জটিল প্রশ্ন ও অপরাপর বিষয় নিয়ে বইটিতে প্রায় বিশটির মতো আর্টিকেল আছে; মাইনর জিনিয়াস, আমরা কিভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করি, এবং কীভাবে আমরা অনুমান করি বা অনুমান ক্ষমতা ব্যবহার করি –এসব নিয়েই এ বই – কিছুটা সাইকোলজিক্যাল থিয়রি, কিছু কেইস স্টাডি। ভাবছিলাম, কীভাবে ছাদের কার্ণিশে কাক লিখেছিলাম? কে বলেছিল এসব লিখতে, এভাবে লিখতে? উত্তর জানি না।

গল্প-উপন্যাস পড়ার সময় দৃশ্যকল্প চিন্তা করি। এটা পুরনো অভ্যাস। গল্পগুলো পড়তে গিয়ে চরিত্রে চেনাজানা মানুষকে বসাই, তারা কথা বলে, তারা গল্পের মানুষ হয়ে যায়, চেনা জানা বা কল্পিত জায়গায় তারা বাস করে, হাঁটে। ইদানিং মাঝে মাঝে যেটা হয়, হুট করে এরকম একটা দৃশ্য চলে আসে। কিন্তু, মনে করতে পারি না, মেলাতে পারি না – কোথায় এমন ঘটেছিল। বাস্তব এবং অবাস্তবের, দেখা ও কল্পনার মিশ্রণে বিভ্রম জাগে...। হঠাৎ করে একটা লাইন, একটা প্যারা, একটা সংলাপ এসে মাথায় হানা দেয়। হ্যামারিং চলতে থাকে। এ এক যন্ত্রণা! এক সময় বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন পত্রিকা কিনতাম, পছন্দের কলামিস্টের লেখার আশায় – বিশেষ সংখ্যার সন্ধানে। মনে নেই, কেন কিনেছিলাম দৈনিক সংবাদ, ২৬ মে – ২০০৫ সংখ্যা। সেদিন ছাপা হয়েছিল সৈয়দ শামসুল হকের গল্প “ফেরি জাহাজের অপেক্ষায়”। শুরুটা অদ্ভুতরকম ভালো লেগেছিল, তাই ডায়েরির এক পাতায় টুকে রেখেছিলাম –

“আমি তাকে চিনি না। আগে কখনো দেখিনি। লোকটাকে আমি ভীড়ের ভেতরে ঠিক পছন্দ করতে পারছিলাম না। এরকম হয়। অনেক মানুষের দেখা পাওয়া যায় পথে। পথ চলতি মানুষ তারা। এই দেখা হলো, আর কখনো দেখা হবে না। তবুও ওইটুকুর ভেতরে পছন্দ অপছন্দ গড়ে উঠে। কখনো এমন হয়, মানুষটির কথা বহুদিন পর্যন্ত মনে থাকে। কোনো কারণ ছাড়াই।”

এ গল্পের বাকী অংশ আমার স্পষ্ট মনে নেই। এ শুরুটুকু মিল পেয়েছিলাম অতীতের সঙ্গে। এরপরে ঢাকা, পাতায়া, ব্যাংকক, কুয়েত, লন্ডন, টরন্টো, বাহারাইন, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ি, প্রগতি সরণী, কুড়িল বিশ্বরোড, মিরপুর দুই নম্বর বাজার; এরকম অনেক জায়গার এ গল্পের এ অংশটুকু মাথায় হানা দিয়েছে।
গত ঈদে ‘কালি ও কলম’ ঈদ সংখ্যায় ছোটগল্প ছিল অনেকগুলো। সৈয়দ হকের গল্পের প্রথম প্যারা পড়েই থমকে গেলাম-

আমি তাকে আগে কখনো দেখিনি। লোকটিকে আমি ঠিক পছন্দ করতে পারছিলাম না। এ রকম হয়। অনেক মানুষের দেখা পাওয়া যায় পথে। এই দেখা হলো, আর কখনো দেখা হবে না। ওইটুকুর ভেতরেই পছন্দ-অপছন্দ গড়ে ওঠে। কখনো এমন হয়, মানুষটির কথা বহুদিন পর্যন্ত মনে থাকে"


পুরনো গল্প নূতন করে, নাকি আগেরটা খসড়া ছিল?
পরে যখন মন দিয়ে পড়লাম, দেখলাম – প্রথম প্যারার অংশটুকু বদলে গেছে। পাঁচ বছর পরে, নাকি পাঁচ বছর ধরে – সৈয়দ হক গল্পের এ সম্পাদনা করলেন? “মার্জিনে মন্তব্য”তে অবশ্য তিনি লিখেছেন – ৪/৫ বছর মাথায় না রাখা ছাড়া কোনো গল্প তিনি লেখেন না!
পুরো গল্পে আর কী কী পরিবর্তন এসেছে সেটা ধরতে পারলাম না, কারণ দৈনিক সংবাদের ঐ সংখ্যাটি সংগ্রহে রাখিনি।

আজ দ্য ডেইলি স্টারের স্টার ইনসাইট ম্যাগাজিন পড়তে গিয়ে আবার ফেরি জাহাজের অপেক্ষায় ফিরে পেলাম ইংরেজী অনুবাদে

"I Have never seen him before. I wasn't really able to like the man. A person meets many different people while on the streets. You see them for a moment, to never meet them again. A sense of liking or disliking develops instantly in that small portal of time. And sometimes, you end up remembering that person for many days to come."

স্টার ইনসাইটে অবশ্য গল্পটি “টু বি কনক্লুডেড” রয়ে গেছে। যতটুকু পড়লাম, হাসান আমিন সালাউদ্দিন অনুবাদ খারাপ করেন না।

::::::::

Read more...

08 January, 2011

ওকে, কাট


মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সিনেমা ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা হয়েছে ব্যাপক। ইন্টারনেটে, সামাজিক মহলে আলাপ আলোচনায় তিন ধরনের মন্তব্য খেয়াল করেছি - ১) ফারুকীর পর্ণ ম্যুভি ২) ফাটাফাটি, জোস ৩) কনসেপ্ট ভাল, তবে আহামারী কিছু না।


দেখার ইচ্ছা থাকলেও নানান ঝুট ঝামেলা আর সুযোগের অভাবে সিনেমাটি দেখিনি। রিলিজের প্রায় বছর খানেক পরে, কিছুটা অবসর মিললে, গত সপ্তাহে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারের ডিভিডি কিনলাম। দেখলাম। নিজস্ব মতামতে ওপরের তিন নাম্বারে নিজেকে রাখবো। সব মানুষই একা, নোবডি বিলংস টু নোওয়ান; এটা যদি মূল বক্তব্য হয়, তবে তার পরিবেশনা ভীষণ দূর্বল ছিল। এরকম কনসেপ্টের ছবি বিশ্বে নতুন নয়, তাই চমকের কিছু নেই। কিন্তু, প্রচার প্রসারে যেটা ঢোল বাজিয়ে বলা হচ্ছিলো একাকী মেয়ের জীবন-দ্বিধা-সংকট, সেসবের ছায়া হয়তো আছে সিনেমাটিতে কিন্তু দর্শককে আক্রান্ত করার মতো না। অন্তত আমি আক্রান্ত হইনি। তিশার একঘেঁয়ে অভিনয় দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে ছিলাম আগে, এখানেও তা-ই হলো। মূল সমস্যা মনে হয়েছে – ফারুকী একসাথে অনেক কিছু দেখাতে চেয়েছে – তাই ফোকাস সরে গেছে বারবার। একাকী মেয়ের জীবন, প্রেম-অপ্রেমের সম্পর্ক, নাকি পারস্পরিক দ্বিধা; সব মিলিয়ে খাপছাড়া লেগেছে সব। খুব কাছের এক মানুষ, ব্যক্তিগত জীবনে বাঙালি-সামাজিকতা-সংরক্ষণশীলতার পক্ষে তিনি, সিনেমা দেখে আমাকে বলেছিলেন – “আমাদের সামনের সীটে বাবা আর মেয়ে বসেছিল, ছিঃ ছিঃ কী বিব্রত অবস্থা!”
এবার সিনেমা দেখতে দেখতে বিব্রত অবস্থা নিয়ে ভাবলাম, হ্যাঁ ঠিক – মনে হয়েছে আমাদের ‘সামাজিক’ প্রেক্ষিতে ‘এখনো’ বাবা মেয়ে বসে এ সিনেমা দেখাটা কিছুটা অস্বস্তির। পালটা প্রশ্ন যেমন আসে, মল্লিকা শেরওয়াত যখন খুল্লামখুল্লা নাচে মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমের বক্সে তখন ফারুকীর সিনেমায় দোষ কোথায়? ওরকম যৌন আবেদন তো নেই। আবেদন নেই, সত্যি। কিন্তু ইংগিত আছে ব্যাপক। বয়স্ক লোলুপ কচি খন্দকার বারবার ‘আই ওয়ান্না ফাক ইউ’ গান শোনালে তিশা জিজ্ঞেস করে ‘শুধু গান শুননেই আপনার হয়ে যায়?” কাশবনের ভেতরে তপু যখন তিশাকে আড়াল থেকে আড়ালে নিয়ে যায় তখন তিশা ঠাট্টাচ্ছলে জিজ্ঞেস করে ‘আজ সতীত্ব নিয়ে ফিরতে পারবো তো?’ এর পরে আছে ‘ঋণ শোধ’এর জন্য শারীরিক সম্পর্কের ডাক। তপু ফার্মাসীর সামনে নিরোধক কেনার জন্য ঘুর ঘুর করছে, একবার স্যালাইন কিনে, পরেরবার সফল হয়। মাঝে আছে মধ্যরাতে এক ফ্ল্যাটে তপু-তিশার জেগে থাকা, সেখানেও শরীরি ডাক প্রবল। এসব দৃশ্য ইংগিত সংলাপ বেশিরভাগ দর্শকের কাছে অস্বস্তিকর লাগতেই পারে। সুতরাং, আপত্তির জায়গাটা একেবারে ফেলে দেয়ার নয়।
থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারকে আমি রেটিং দেবো পাঁচে তিন।
তবে ছবির গানগুলো শুনছি প্রায় বছর দেড়েক ধরে। সেগুলোকে চার।


ছবি শেষ হওয়ার পরে, ডিভিডির স্পেশাল ফিচার-এ ক্লিক করলাম। সিনেমা বানানোর পেছনের দৃশ্য, মুছে দেয়া দৃশ্য, কুশীলবদের সাক্ষাতকার, বিজ্ঞাপন, পোস্টার, ফটো এলবাম এসবের সঙ্গে আছে ফারুকীর করা ১৩ মিনিটের একটা শর্ট ফিল্ম, নাম – ওকে কাট।
এটা মূলত ছবি রিলিজের পরে দর্শক প্রতিক্রিয়া এবং ফারুকীর জবাবদিহিতা।
শুরুটা এরকম – ফারুকী বলছে কবে তার ছবি মুক্তি পেলো। কোন কোন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফ্যাস্টিভালে গেল। এরপরের দৃশ্যে মাঠ ভর্তি দর্শক চিৎকার করছে। হল থেকে দর্শক বের হচ্ছে, আনন্দ করছে, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারের জয় ধ্বনিত হচ্ছে আকাশে বাতাসে।
এরপরের দৃশ্যগুলো দর্শক প্রতিক্রিয়া। ফেসবুকে ফারুকী ও সিনেমার বিরুদ্ধে অভিযোগ - ক্যাম্পেইন।
ফারুকীর বাবা (অভিনয়ে রুমি) ফারুকীকে বকা দিচ্ছে, কেন সে ইসলাম বিরোধী সিনেমা বানালো, কেন হিযবুয তাহরীর ফারুকীর বিরুদ্ধে মিছিল করছে, কেন ফারুকী তার বাবার শান্তি নষ্ট করছে...।

এরপরের দর্শকগুলো কোনো এক মহল্লার গলিতে থাকে।
শার্টের বোতাম খোলা একদল তরুণ বলে – ছবিটা অঅঅসাম হইসে।
আন্টি বয়েসী একজন বলে, সিনেমাটায় লিভ টু গেদার প্রমোট করছো ফারুকী, খুব খারাপ করছ। ফারুকীও ক্যামেরার পেছন থেকে জবাব দেয়।
এক তরুণী ফারুকীকে জানায় সিনেমার গল্প নাকি ঐ তরুণীর জীবন থেকে নেয়া হয়ে গেছে।
এরপরে আসে তিন প্রাক-যুবতী। ফারুকী ভাইয়্যা ভাইয়্যা করে মুখে ফেনা তুলে, অটোগ্রাফ চায়। ছবিটা অন্নেক ভাল্ল হয়েছে, অসাধারণ। এরকম ছবি চাই দাবী জানায়।
এক মধ্য বয়স্ক পুরুষ জানায় – "শুরুটা ভাল ছিল, ফিনিশিং ভাল হয় নাই। একটা মেয়ের সাথে দুইটা ছেলে, এটা কি হয় বলো?" ফারুকী জবাব দেয় – "ওরা তো বেড়াতে গেছে, একসাথে থাকতে যায় নাই।" কিন্তু, দর্শক মানে না... "একটা মেয়ের সাথে দুইটা স্বামী?"
পরের দর্শক এক ওভার ব্রীজের নিচে। ফারুকীর ছবি তোলে মোবাইল ফোনে।
ফারুকীর ক্যামেরা ব্রীজের ওপরে ওঠে, নামতে থাকা কিশোররা সিনেমাটির জন্য ফারুকীকে অভিবাদন জানায়।
এবার ব্রীজের ওপরে। স্যুট টাই পরা এক মধ্য বয়স্ক লোক এগিয়ে আসে (একে ফারুকী গ্রুপের নানা নাটকে নিয়মিত দেখা যায়)। লোকটি জিজ্ঞেস করে – ‘ভাই আপনি ফারুকী সাহেব না?... মুভিটির মাধ্যমে আপনি সমাজকে কী দিতে চেয়েছেন? এখানে আমি কনডম সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, লীভ টুগেদার সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, আপনি ছেক্স সমন্ধে খোলামেলা আলোচনা করেছেন...তরুণরা উচ্ছন্নে যাবে না?' ফারুকী পাল্টা যুক্তি দেয়, হিটলারের কথা বলে, পেছনে মানুষ জমে যায়। এগিয়ে আসে খোচা খোচা দাড়ির এক তরুণ, এসেই মধ্যবয়স্ক লোকটিকে ধমক দেয় ‘ভাই আপনি ফিল্ম সমন্ধে কিছু বোঝেন? ফিল্ম সম্পর্কে আইডিয়া আছে আপনার?’ লোকটি চুপ থাকে। এবার তরুণটি চিৎকার দেয় – ফারুকীকে বলে, “বস্‌, আপনি কোনো চিন্তা কইরেন না, সারা দেশের ইয়াং জেনারেশন আপনার পিছে আছে বস্‌, এই ধরনের সিনেমা আমরা সব সময় চাই বস্‌, সব সময়ের জন্য।‘ উল্লেখ্য তরুণটির গায়ে টি-শার্টে লেখা – Blowjob is better than no job.
এরপর আরো তরুণ তরুণী ফারুকীকে ধন্যবাদ দেয়, অটোগ্রাফ নেয়। এবার আসে ক্যাপ পরা এক তরুণ। একেও ফারুকী গ্রুপের নাটকে মাঝে মাঝে দেখা যায়। সে জিজ্ঞেস করে – এই ছবি থেকে জাতি কী শিখবে? ফারুকী পালটা বলে, “আমি কি বলছি যে, আমি জাতির শিক্ষক?” তরুণটি জানায় এই ছবি দেখে ইয়াং জেনারেশন নষ্ট হয়ে যাবে। এবার ফারুকী জানায় সে নাকি একটা ছবি বানাবে এবার যেখানে সব ভাল থাকবে, ভাল ভাল লোক থাকবে, ভাল ভাল কথা বলবে; এর দুইমাস পরে বাংলাদেশের সব লোক যদি ভাল না হয়, সব দুর্নীতি যদি দূর না হয় ঐ তরুণের কী শাস্তি হবে? ফারুকীর এ যুক্তি শোনে তরুণটি সরে যায়।
এবারের দৃশ্যে ফারুকী তার ভাই-বেরাদারদের কাছে ফিরে আসে, এসে ঐ নেক্সট ছবির কনসেপ্টের কথা বলে, অ্যা নোবেল ফিল্ম, যেখানে সব কিছু ভাল ভাল থাকবে। যেহেতু সবাই ভাল হয়ে যাবে ছবির প্রথম সিকোয়েন্স হবে দুই পুলিস সব জামা কাপড় খুলে দিগম্বর হয়ে খোলা মাঠে চলে যাবে, যে দেশে অপরাধ নাই, সে দেশে উকিলেরও দরকার নাই, উকিল গাউনটাউন খুলে জমিতে চাষ করবে, এর পরে সবাই ঘরের তালা খুলে গার্বেজে ফেলে দেবে, সব বাড়ি ঘর দরজা জানালা খুলে ফেলে দেবে, কারণ দেশে সব ভাল হয়ে গেছে, প্রেমিক প্রেমিকারা বোরখা পরে দেখা করতে আসছে, আর লাস্ট শর্টে দেখা যাবে সূর্যাস্ত হচ্ছে, ডিরেক্টরের চেয়ার ফাঁকা, চেয়ারে আগুন লাগছে, কারণ যে দেশে সব কিছু সুখে শান্তিতে চলিতে লাগিল, যে দেশে কারো কোনো সমস্যা নাই, সে দেশে গল্প খুঁজে পাওয়া যাবে কোথায়? সব কিছু মাপা মাপা চলবে। ঐ দেশের ছবিতে ‘ওকে কাট’ বলে চলে যেতে হবে।

এই হলো ‘ওকে কাট’এর সংক্ষেপ। এ শর্ট ফিল্ম নাকি আবার রটারডামে কি একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানো হয়েছে!
ছবি বানানোর পরে এমন জবাবদিহিতার কোনো দরকার আছে কিনা সেটা বিরাট প্রশ্ন। এতসব স্বতঃপ্রণোদিত কারণ দর্শানোকে বরং ছবির পাবলিসিটি বলে মনে হয়েছে।

থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার সিনেমা দেখে যদি সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়, ‘অ্যা নোবেল ফিল্ম’ দেখে দেশের সব মানুষ ভালো হবে কিনা – ফারুকীর এমন যুক্তিকে খোঁড়া মনে হয়েছে। রাতে ড্রাম বাজিয়ে মহল্লার মানুষের ঘুম নষ্ট করার অভিযোগ করলে ড্রামার যদি পালটা যুক্তি দেয় – কাল থেকে আমি ড্রামের বদলে বাঁশী বাজাবো, দেখি সবাই শান্তিতে ঘুমায় কিনা – সবাই না ঘুমালে বলেন- আপনার কী শাস্তি হবে? এরকমই অসামঞ্জস্য মনে হয়েছে ফারুকীর যুক্তিকে।

স্পেশাল ফিচারের এইসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আত্মপক্ষ সমর্থন থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বারের দূর্বলতাকেই প্রমাণ করে।



Read more...

07 January, 2011

ছাদের কার্ণিশে কাক প্রসঙ্গে

 
ঢাকা, শুক্রবার, ২৪ পৌষ ১৪১৭, ০১ সফর ১৪৩২, ০৭ জানুয়ারি ২০১১
    ওয়েবে বাংলা লেখালেখির প্রাথমিক পর্যায় আরিফ জেবতিক   গ্রামীণফোনের নিয়ন্ত্রক সংস্থা নরওয়ের টেলিনর কম্পানির অর্থায়নে পরিচালিত একটি গবেষণার ফল অনুযায়ী ২০১০ সালের শেষে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ। দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর এ সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। গত কয়েক বছরে এ প্রবৃদ্ধির হার ৩০ শতাংশেরও বেশি ছিল।
মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রায় ইন্টারনেট যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনোদনমাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে, ফেইসবুকে প্রায় ৯ লাখ বাংলাদেশির নিয়মিত পদচারণা তার একটি বড় উদাহরণ। বাংলাদেশের সব বড় পত্রিকার মোট প্রচারসংখ্যা যোগ করলেও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যার ধারেকাছেও পেঁৗছাবে না।
শ্রেণীবিন্যাসে এই পাঠকদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি, 'যারা সাহিত্যের বড় ভোক্তা ও পৃষ্ঠপোষক। এই বিপুলসংখ্যক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠী তাই আমাদের সাহিত্যের জন্য একটি বড় সম্ভাবনা হয়ে দেখা দিয়েছে। একসঙ্গে এত বেশি পাঠকপ্রাপ্তি আগে কখনোই সম্ভব ছিল না। প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশমানকালে, যেখানে সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে নেট ব্যবহার যাপিত জীবনের রুটিনে প্রবেশ করছে, সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে এত বড় সংখ্যক পাঠকের মুখোমুখি হওয়ার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে যাঁরা লেখেন তাঁদের সাহিত্যরুচি, শৈলীগত বিচার, মূল্যবোধ, মানগত দিক বাংলা সাহিত্যের বিশাল সমুদ্রকে অপরাপর ভাষায় পরিচিত করতেও ওয়েবের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আসুন, আমরা বরং বর্তমানকালের এই মাধ্যমটির সুলুক সন্ধান করি।

ব্লগ আর মৌলিক সাহিত্য প্রতিদ্বন্দ্বী না পরিপূরক

ইন্টারনেট পাশ্চাত্য মাধ্যম, সেখানে বাংলাকে প্রবেশ করানো সহজ হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু সুখের বিষয়, আমাদের তরুণ উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তিবিদরা স্বার্থহীনভাবেই এ কাজে এগিয়ে এসেছেন আগ্রহের সঙ্গে। ইন্টারনেটে বাংলাকে সহজভাবে প্রকাশ করার জন্য তরুণরা একাধিক উদ্যোগ নিয়েছেন, যার ফসল এখন ঘরে তুলছি আমরা।
এ সাফল্যের কারণে যে বিষয়টি এগিয়ে গেছে, সেটি হচ্ছে বাংলা ভাষায় ব্লগ লেখা। ব্লগ শব্দটি এসেছে 'ওয়েবলগ'-এর সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে। প্রথম দিকে সারা বিশ্বেই ব্লগ বলতে দৈনন্দিন ডায়েরি লেখাই বোঝাত, কিন্তু ব্লগের যখনই প্রসার হয়েছে, তখনই এই দৈনন্দিন ডায়েরি লেখার জায়গাটুকুও বিকশিত হয়েছে বিভিন্ন সৃজন ও মননের ভেতর। এসেছে রাজনৈতিক প্রবন্ধ, ইতিহাস আলোচনা, মন্তব্য কলাম আর অবধারিতভাবেই এসেছে গল্প, কবিতা, উপন্যাস সাহিত্যনির্ভর বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা।
বিশেষ করে ব্লগ সনাতন লেখক-পাঠক সম্পর্ককে বাতিল করে দিয়েছে। এখানে প্রত্যেক লেখকই পাঠক এবং প্রত্যেক পাঠকই লেখক। এই নতুন ধারা তৈরি করেছেন অজস্র লেখক। বাংলা ব্লগের এই প্রাথমিক বিকাশকালে এই লেখকদের গড় মান নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও, আগামীতে এই লেখকদের মধ্য থেকেই যে নেতৃস্থানীয় লেখক উঠে আসবেন এবং বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবেন, তেমন আশাবাদ প্রকাশ করা অযৌক্তিক হবে না।

অসম্পাদিত ব্লগ সাহিত্য : মানহীনতা না নতুন সাহিত্য?

বর্তমানে ওয়েবভিত্তিক লেখালেখির চলছে সূচনাকাল। এখানে যাঁরা লিখছেন, তাঁরা সংখ্যায় অনেক বেশি। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে সামহোয়্যারইনব্লগ নামে কমিউনিটি ব্লগের আবির্ভাব ওয়েবে বাংলা লেখালেখির প্রবণতাকে এমন পর্যায়ে পেঁৗছে দিয়েছে, বাংলা লেখালেখির ট্রেন্ড হিসেবে ব্লগ একটি শক্তিশালী মিডিয়ায় পরিণত হয়েছে। সামহোয়্যারইনের কমিউনিটি ব্লগ কনসেপ্টটি একটি আধুনিক ধারণা, যেখানে প্রথম পাতায় একসঙ্গে অনেক লেখকের লেখা প্রকাশ করার সুযোগ তৈরি হয়। এর ফলে পাঠকদের পক্ষে তাঁদের পছন্দ ও রুচিমতো লেখাকে বাছাই করার সুযোগ ঘটে এবং লেখকের জন্যও একসঙ্গে বহু পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হয়। সামহোয়্যারইনব্লগের আবির্ভাব না হলে ওয়েবভিত্তিক বাংলা লেখালেখির চর্চা নিঃসন্দেহে অনেক পিছিয়ে থাকত। সামহোয়্যারইনের পর ২০০৭ সালে বাংলা ওয়েবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন অনলাইন লেখকদের সংগঠন 'সচলায়তন'-এর আবির্ভাব। পরবর্তী সময়ে কমিউনিটি ব্লগ ধারায় যুক্ত হয়েছে আমার ব্লগ। বর্তমানে আমরা বন্ধু, দৃষ্টিপাত, মুক্তমনা, উন্মোচন, ক্যাডেটম কলেজ ব্লগ, প্রথম আলো, নাগরিক ব্লগসহ আরো অনেক ব্লগ সাইটে লেখকরা লিখে চলছেন তাঁদের মনন ও সৃজন বিকাশে। প্রধান ব্লগসাইট সামহোয়্যারইন-এ এ মুহূর্তে ৬৫ হাজার নিবন্ধিত ব্লগার আছেন, ২০১০ সালে প্রায় ১১ লাখ পাঠক অর্ধকোটিবার এই ব্লগসাইটটি ভিজিট করেছেন।
এই রাশি রাশি লেখা প্রকাশিত হওয়ার ফলে লেখার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক। দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া ব্লগে সাধারণত লেখক তাঁর লেখাটি সরাসরি প্রকাশ করতে সক্ষম হন। ব্লগে লেখার নিচে মন্তব্য প্রকাশের সুযোগ যদিও ব্লগকে জনপ্রিয় করার অন্যতম প্রধান কারণ, কিন্তু এ মন্তব্যে লেখার মান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার রীতি পরিপক্ব হয়ে ওঠেনি এখনো। ফলে যা লেখা হচ্ছে, তার অধিকাংশই সাময়িক ঢেউ তুলে হারিয়ে যাচ্ছে অতল গহ্বরে। দীর্ঘকাল মনে রাখার মতো লেখা ওয়েবে খুব বেশি লেখা হয়নি, আর যা-ও লেখা হচ্ছে তা অনেক লেখার ভিড়ে রয়ে যাচ্ছে আলোচনার বাইরে।
ওয়েবভিত্তিক লেখালেখির ক্ষেত্রে তাই একটি বড় প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে যে আদৌ এই হাজার হাজার লেখা কোনো চিন্তার নতুন পরিবর্তন তৈরি করতে পারছে কি না। দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে_আমরা এই লেখার সংখ্যাকে স্বাগত জানাব না লেখার মান নিয়ে সচেতন হব। একজন মানুষের প্রকাশের আকাঙ্ক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, না কি প্রকাশযোগ্যতাকে বিবেচনা করা হবে? দ্বিতীয়টিকে বিবেচনা করতে হলে সম্পূরক প্রশ্ন দাঁড়ায়, এই বিবেচনাকারীর মানদণ্ড কিভাবে নির্ধারিত হবে?
মান রক্ষার এই প্রশ্নটি যে বাইরে থেকে উত্থাপিত হচ্ছে এমনটি নয়, ওয়েবভিত্তিক বাংলা লেখকরাই বিভিন্নভাবে জবাব খুঁজছেন এই প্রশ্নের। কয়েকটি ব্লগ সাইটে যে মডারেশন চালু আছে, সেটি নিয়ে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ আছে। সচলায়তনের মতো ওয়েবসাইটগুলোতে প্রাক-যোগ্যতা বিবেচনা করে সদস্যপদ দেওয়া হচ্ছে, আবার আমার ব্লগের মতো মডারেশনবিহীন ব্লগে সরাসরি যে কেউ নিবন্ধিত হয়ে লেখালেখি শুরু করে দিতে পারেন। এভাবে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওয়েবভিত্তিক লেখার মান নির্ধারণ-সংক্রান্ত আলোচনার একটি ফয়সালা হবে বলে আশা করা যায়। তবে এই আলোচনা সমাপ্তিতে অনেক বেশি সময় লাগবে, অন্তত আরো এক দশক লেগে যেতে পারে কিংবা আরও বিশি সময়।

আগামী দিনের সাহিত্য কতটা ওয়েবে সৃষ্টি হবে?

নতুন লেখকদের জন্য একটি সাহিত্য পুরস্কার হচ্ছে সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার। গত বছর একুশের বইমেলায় এই পুরস্কারের জন্য নির্ধারিত পাঁচটি পুরস্কারের মধ্যে দুটিই জিতে নিয়েছেন ওয়েবে লেখালেখি করা দুই নবীন লেখক। কবিতায় তনুজা ভট্টাচার্যের 'সাময়িক শব্দাবলী' এবং গল্পে মাহবুব আজাদের 'ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প' সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার জিতে নেয়। এ পুরস্কারপ্রাপ্তি একটি ইঙ্গিত মাত্র, যা থেকে বোঝা যায় যে ওয়েবে মানসম্পন্ন লেখালেখি হচ্ছে। যদিও পুরস্কার শুধু স্বীকৃতিও বটে।
সাহিত্যের আরেকটি বড় প্রয়োজনীয় বিষয় হচ্ছে পাঠক। ওয়েবে লেখালেখি করে তরুণ ও নতুন লেখকরা সহজেই পেঁৗছাতে পারছেন পাঠকদের দোড় গোড়ায়। এসব লেখকের একটি নিজস্ব পাঠকগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে। এর ফলে প্রকাশকরাও এসব লেখকের দিকে ঝুঁকছেন। বিশেষ করে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জাগৃতি, শুদ্ধস্বর ও শষ্যপর্ব ওয়েবভিত্তিক লেখকদের বড় পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমার ব্লগ তো নিজেই প্রকাশনা ব্যবসায় নেমে চালু করেছে_আমার প্রকাশনী। গত বছর বইমেলায় এ প্রকাশনী থেকে ডজনখানেক বই প্রকাশিত হয়েছে। বইমেলায় লিটিল ম্যাগ চত্বরে যেভাবে লিটিল ম্যাগ আন্দোলনের কর্মীরা একসঙ্গে আড্ডা মারেন, কয়েক বছর ধরে, ওয়েব লেখকদেরও এভাবে জোটবদ্ধ আড্ডা মারার রেওয়াজ চালু হয়েছে। জাগৃতি প্রকাশনী প্রথম বাংলাদেশে ব্লগের লেখা প্রকাশ করে, ২০০৭ সালে তারা প্রথম প্রকাশ করে "শুভ-র ব্লগিং"। একই বছর সামহোয়্যারইন ব্লগের লেখকদের বাছাই করা লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয় 'অপরবাস্তব'।
অপরবাস্তব-এর পাশাপাশি সচলায়তন এবং আমার ব্লগ তাদের নিজস্ব লেখকদের বাছাই করা লেখা নিয়ে প্রকাশ করে আসছে সংকলন। দেখা যাচ্ছে, গত তিন বছরে বাংলা ওয়েবভিত্তিক লেখকদের শতাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণত নতুন ও অপরিচিত লেখকদের বই প্রকাশিত হলে সেগুলো দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়, এদিক দিয়ে ওয়েবভিত্তিক লেখকরা ব্যতিক্রম। তাঁরা প্রতিনিয়ত নিজেদের লেখা পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করায় একটি পরিচিতি তৈরি হয়েছে, যে কারণে এসব লেখকের বইয়ের বিক্রি তুলনামূলক ভালো।
ওয়েবভিত্তিক লেখালেখির ক্ষেত্রে একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঠকের মূল্যায়ন সরাসরি পাওয়া যায়। এই মূল্যায়ন লেখকমাত্রই উপভোগ করেন। ফলে যাঁরা ইতিমধ্যেই জনপ্রিয় লেখক, তাঁদেরও প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি ওয়েবে লেখালেখি শুরু করতে দেখা যাচ্ছে। প্রয়াত মুহম্মদ জুবায়ের তাঁর শেষ দুটি উপন্যাস ওয়েবেই প্রকাশ করেছিলেন। লুৎফর রহমান রিটনের আনকোরা ছড়াটি সেকেন্ডের মধ্যেই পেঁৗছে যাচ্ছে হাজার পাঠকের কাছে, পাঠক প্রতিক্রিয়াও পাওয়া যাচ্ছে কয়েক মিনিটের মধ্যেই। ফেইসবুকে কোনো একটি কবিতা কী গল্প নিয়ে সাহিত্যামোদীদের দীর্ঘ তর্ক-বিতর্ক কখনো কখনো আন্তমহাদেশীয় বাহাসে রূপান্তরিত হচ্ছে। তবে গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, সাহিত্যমোড়ল অনেকেরই এই সরাসরি পাঠ প্রতিক্রিয়ার প্রতি ভীতি কাজ করে। এই ভীতি থেকেই তাঁরা ওয়েবে প্রকাশিত লেখাগুলোকে উড়িয়ে দিতে চান। বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকতায় লেখক হয়ে ওঠা এই ব্যক্তিদের জন্য পাঠকের সরাসরি প্রতিক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই সুখকর হয় না।

ওয়েবভিত্তিক লেখালেখি কি লিটল ম্যাগকে প্রতিস্থাপন করবে?

ওয়েবভিত্তিক লেখালেখি আগামী দিনে আমাদের লিটিল ম্যাগ আন্দোলনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেবে না, এমনটি নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যাচ্ছে না। প্রথাবিরোধী লেখালেখির ক্ষেত্র তৈরি করতেই লিটিল ম্যাগ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। এই ক্ষেত্রের জন্য এখন সবচেয়ে উর্বর ভূমি হচ্ছে ওয়েব। এখানে অল্প আয়াসে অনেক বেশি পাঠকের সামনে পেঁৗছানো যাচ্ছে। লেখা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য ওয়েব এখন সবচেয়ে সহজলভ্য মাধ্যম। বিপণন নিশ্চিত থাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখা এখন অনেক বেশি পাঠকের সামনে তুলে ধরা সম্ভব হচ্ছে। আর্থিক সংগ্রামের কারণে যেসব লিটিল ম্যাগের প্রকাশনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, সেগুলোর আন্তর্জাল প্রকাশনা তুলনামূলক সহজ হবে।
আগামীতে তাই লিটিল ম্যাগগুলো ওয়েবভিত্তিক হয়ে উঠলে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। ইতিমধ্যেই তরুণ লেখকদের বড় একটি অংশ ওয়েবকে আশ্রয় করে নিয়েছেন। শূন্য দশকের কবিদের বড় অংশ এখনই ওয়েবে লেখালেখি করছেন, ভবিষ্যতে এ ধারা আরো বাড়বে_এ কথা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায়।

ই-বুক বনাম মলাটবন্দি বই

আন্তর্জালে বাংলা লেখালেখির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর বই প্রকাশের উদ্যোগগুলোও আলাদা নজরের দাবি রাখে। প্রযুক্তিনির্ভর পাশ্চাত্য সমাজে বইয়ের ডিজিটাল আর্কাইভিং দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। ডিজিটালাইজড বই পড়ার জন্য হাতে বহনযোগ্য যন্ত্র পাওয়া যাচ্ছে। এ রকম একটি যন্ত্রে কয়েক শ বই সংরক্ষণ ও বহন সম্ভব হচ্ছে। ফলে আধুনিক সমাজে একজন পাঠকের জন্য একটি ছোট যন্ত্রের মাধ্যমে অনেক বেশি বই সংরক্ষণ ও সঙ্গে রাখা সম্ভব, যা প্রচলিত পদ্ধতিতে সম্ভব নয়। আধুনিক মোবাইল ফোনগুলোতেও ওয়েব থেকে পড়ার সুবিধা চালু হচ্ছে।
আর এসবের ফলে ই-বুকের ধারণাটি আগামী দিনে আরো বেশি জনপ্রিয় হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বাংলা আন্তর্জাল সাহিত্য চর্চায় প্রথম স্বয়ংসম্পূর্ণ ই-বুকের ধারণা প্রচলন করে 'সচলায়তন'-এর লেখকগোষ্ঠী। সচলায়তন ইতিমধ্যে অনেক গল্প, কবিতা ও আত্মচরিত সংকলন প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া সামহোয়্যারইন, আমার ব্লগ, আমরা বন্ধু প্রকাশিত বইগুলোর মানে ও সৌকর্যে আমাদের প্রচলিত প্রিন্ট মিডিয়া থেকে সমৃদ্ধ বলে মনে হয়।
স্বয়ংসম্পূর্ণ উপন্যাস সম্ভবত প্রথম আন্তজালে প্রকাশ করেন আনোয়ার সাদাত শিমুল। তাঁর ই-বই 'ছাদের কার্নিশে কাক' প্রকাশের প্রথম কয়েক মাসেই সহস্রাধিক বার ডাউনলোড হয়।
এখানেই ওয়েবভিত্তিক প্রকাশনার একটি বড় সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। সাধারণত আমাদের দেশে নতুন লেখকরা প্রকাশকদের কাছ থেকে নানা বিড়ম্বনার শিকার হন। লেখক সম্মানী প্রদান তো দূরের কথা, বইটি প্রকাশের জন্য এক ধরনের প্রকাশক উল্টো লেখকের কাছ থেকেই টাকা-পয়সা নিয়ে থাকেন। তার পরও নানা ঝক্কি পেরিয়ে যে বই প্রকাশিত হয়, নতুন একজন লেখকের সেই বইয়ের বিক্রি শতকের ঘর পেরোলে সেটিকে দেখা হয় লেখকের সৌভাগ্য হিসেবে।
কিন্তু অন্যদিকে ওয়েব দিচ্ছে এক অবারিত সুযোগ। সেখানে লেখক নিজেই তাঁর বইয়ের প্রকাশক হতে পারছেন, এবং নিজের মমতা মাখানো সৃষ্টিটি কম সময়ে ছাপা বইয়ের তুলনায় অনেক বেশি পাঠকের কাছে পেঁৗছে দিতে পারছেন। এতে একটি শঙ্কাও থেকে যাচ্ছে_মান নির্বাচনের। এ ছাড়া এই বিপণন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ বৃদ্ধি পেতেই থাকে, নতুন আগ্রহী পাঠকরা কয়েক বছর এমনকি কয়েক যুগ পরও বইটি অনায়াসে নেট থেকে ডাউনলোড করে ফেলতে পারেন। ছাপা মাধ্যমের বইয়ের কপি অনেক সময় খোদ লেখকের কাছেই কয়েক বছর পড়ে থাকে না।
এসব সুবিধার জন্য আগামীতে আরো বেশি পরিমাণ ই-বুক প্রকাশিত হবে_সে কথা বলা বাহুল্য।

ওয়েবভিত্তিক সাহিত্য পত্রিকা এখনো প্রত্যাশিত প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি

বাংলায় ব্লগ লেখালেখি একটি পর্যায়ে পেঁৗছার পর এখন সাহিত্যকে তার নিজের স্বতন্ত্র পথ খুঁজে বের করার সময় এসে দাঁড়িয়েছে। ওয়েবভিত্তিক সাহিত্য পত্রিকার চর্চাও শুরু ব্লগ আন্দোলনের প্রায় সমসাময়িক। তবে এত দিন পর্যন্ত এই চর্চা যে খুব সাফল্য পেয়েছিল, তেমনটি বলা যাচ্ছে না। হাজার দুয়ারি, বীক্ষণ_এ রকম কয়েকটি ওয়েব সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হলেও সেগুলো নিয়মিত নয়। প্রথম উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে মাসিক 'বাংলার মাটি'। সম্প্রতি চালু হওয়া 'সাময়িকী' দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। 'সাময়িকী'তে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-বই আলোচনার পাশাপাশি সাহিত্য জগতের খবরাখবরও নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে, সাহিত্যামোদীরা নিয়মিত এই সাইটটিতে ঢুঁ মারছেন। পশ্চিমবঙ্গের 'গুরুচণ্ডালি' ওয়েব এবং ছাপা মাধ্যম_দুইভাবেই প্রকাশিত হয়ে আসছে। ছাপা গুরুচণ্ডালি বাংলাদেশে সহজলভ্য না হলেও ওয়েবের কল্যাণে এই সাহিত্য পত্রিকাটি বাংলাদেশেও জনপ্রিয়। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের ব্লগ সাইট কফি হাউসের আড্ডায়ও নিয়মিত লিখছেন অনেক বাংলাদেশি লেখক। দুই বাংলার তরুণ লেখকদের এই সেতুবন্ধ আন্তজালের আগে এতটা সহজ ব্যাপার ছিল না। তবে এখনো ওয়েবভিত্তিক সাহিত্য পত্রিকার প্রভাব ও প্রসার উল্লেখযোগ্য কিছু হয়ে ওঠেনি। অনলাইন সংবাদ মিডিয়ার যে জনপ্রিয়তা, সে তুলনায় অনলাইন সাহিত্য পত্রিকাগুলোর সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না।
ওয়েবে বদলে যাচ্ছে সাহিত্যের রূপ?

ওয়েবভিত্তিক লেখালেখিতে নিরীক্ষা করা সহজ। যেকোনো লেখা প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাঠক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। পাঠকের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনে সেই লেখাটি সংযোজন-বিয়োজন করাও সহজ। তাই সাহিত্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য ওয়েব সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম। এক ধরনের লিটল ম্যাগ বলা চলে।
ওয়েবকেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চা গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই মিডিয়ার সাহিত্য চর্চায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে লেখার আকারে। সাধারণত একটি প্রচলিত ছোটগল্প দুই-আড়াই হাজার শব্দে লেখা হলেও, ওয়েবে ছোটগল্পের আয়তন দেড় হাজার শব্দ পেরোচ্ছে খুবই কম। সাধারণত ওয়েবে ছোটগল্পগুলো গড়ে ৫০০ থেকে হাজার শব্দেই সীমাবদ্ধ। ধারাবাহিক উপন্যাসগুলোয় প্রথমদিকে যে পরিমাণ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, পরবর্তী সময়ে উপন্যাসটি দীর্ঘ হয়ে উঠলে পরের পর্বগুলোতে পাঠকসংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর কারণ কী? কম্পিউটারের মনিটরে কি বড় লেখা পড়া অসুবিধাজনক না ওয়েবে যাঁরা পাঠে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন, তাঁদের পাঠাভ্যাসে সমস্যা? আগামীতে এ নিয়ে গবেষণার সুযোগ থাকল। এমনিতেই আমাদের দেশে দুই-তিন ফর্মার বড় গল্পগুলোকে উপন্যাস নাম দিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে, ওয়েব সাহিত্য চর্চা আরেকটু শক্তিশালী হয়ে উঠলেই দুই ফর্মার উপন্যাস বাজারে পাওয়া শুরু হতে পারে।

ওয়েব পেশাদার লেককদের হুমকির কারণ হবে কি?

আমাদের দেশে পেশাদার লেখকের সংখ্যা কম নয়। সাক্ষরতার হার বাড়লে আগামীতে আরো বেশি লেখক জীবিকা হিসেবে লেখালেখিকে বেছে নিতে পারেন। সাহিত্যকে পুষ্ট ও গতিশীল রাখতে একটি ভাষায় পেশাদার লেখকদের অবদান অনেক।
এই লেখক ও প্রকাশকদের জন্য ইন্টারনেট ভবিষ্যতে হুমকি হিসেবে দাঁড়াতে পারে। বর্তমানে বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইটে জনপ্রিয় লেখকদের বই স্ক্যান করে তুলে দেওয়া হচ্ছে, এতে বই না কিনেই পাঠকরা সহজেই ডাউনলোড করতে পারছেন। জনপ্রিয় লেখকদের বইগুলো প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ওয়েবে সেগুলো সহজলভ্য হয়ে উঠছে। এই বই আপলোড করা হচ্ছে পাইরেসির মাধ্যমে। এতে লেখক ও প্রকাশক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ওয়েবে প্রকাশিত লেখাগুলোর স্বত্ব নিয়েও আগামীতে আইনি ঝামেলা তৈরি হওয়ার সুযোগ আছে। ইতিমধ্যে ওয়েবে প্রকাশিত লেখাগুলো বিভিন্ন পত্রিকায় মূল লেখকের অজ্ঞাতে প্রকাশিত হওয়ার ভূরি ভূরি নজির আছে। ওয়েব থেকে লেখা সংগ্রহ করে বই প্রকাশ করে ফেলেছেন এমন একজন 'প্রকাশকের' সঙ্গে গত বর্ষার বইমেলায় দেখাও হয়েছে আমার। দেশের কপিরাইট আইনে এ-সংক্রান্ত শক্তিশালী ধারা যোগ করা প্রয়োজন, না-হলে এই অরাজকতা দিন দিন বাড়তে থাকবে।
সংখ্যার বিচারে এটি এখনো তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও এ প্রবণতা যদি এখনই রোধ করা না যায়, তাহলে আমাদের অডিও-শিল্প যেভাবে পাইরেসির কারণে প্রায় বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছে, ভবিষ্যতে মুদ্রণশিল্পও এ রকম বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।

শেষ কথা বলার সময় হয়নি এখনো

বিশ্বে প্রযুক্তির বিকাশ যে দ্রুততায় ঘটছে, সেখানে দাঁড়িয়ে ওয়েবের লেখালেখি চর্চাটি আগামীতে আমাদের সাহিত্যে আলাদা প্রভাব কতটুকু ফেলতে পারবে, সেটি এখনই ধারণা করা মুশকিল। অনেক বেশি সংখ্যায় লেখকদের আগমন এবং সহজ প্রকাশযোগ্যতা সাহিত্যকে শেষ বিচারে ঋদ্ধ করবে না নতুন অরাজকতার জন্ম দেবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করার সময় নয় এখন। তবে শেষ পর্যন্ত ওয়েবের কারণেই কিছু নতুন ধারার লেখক পাওয়া যাবে, পাঠকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, এ রকম আশাবাদ প্রকাশ করতেই পারি আমরা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বংলাভাষিরাও আন্তজালের বিশ্বায়নে এগিয়ে চলছেন, এটাই বর্তমানের তৃপ্তি জাগানিয়া তথ্য।

Read more...

  © Blogger templates The Professional Template by Ourblogtemplates.com 2008

Back to TOP