29 December, 2008

কল্পের নায়কদলঃ এক কোটি তরুণ ভোটার

কখনো কখনো কাটতি বেড়ে যায় কারো। প্রয়োজনের মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ আসে ব্যক্তি-দল কিংবা গোষ্ঠী থেকে। এবার নির্বাচনে যেমন বলা হচ্ছে নবীন এবং তরুণ ভোটাররাই ফলাফল নির্ধারণে মূল ভূমিকা রাখবে। রাজনৈতিক দলগুলোর এমন চিন্তা হুটহাট বা হুজুগে নয়, বরং তাদের থিংকট্যাংকরা বেশ ভেবেই তরুণদের কাছে ভোট চাইছেন।

কেনো চাইছেন, সেটা স্পষ্ট হবে যদি বাংলাদেশের জনসংখ্যার বয়স ভিত্তিক সেগমেন্টে তাকাই। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে - ২০০৬ সালের তথ্য মতে বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যক হচ্ছে ২২.২ বছর। অর্থ্যাৎ ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে এদের সবারই বয়স ছিলো সতেরোর কাছাকাছি। সে সূত্রে একেবারে নতুন ভোটারের এ গোষ্ঠী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে 'মহামূল্যবান'। নানান সূত্র বলছে - এবারের ভোটারদের ৩৩ শতাংশ তরুণ ভোটার, যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৪/২৫এর মধ্যে। জনসংখ্যার এ বিশাল এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ কী চায় বা কী ভাবে সেটি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কখনো ভেবেছেন বলে চোখে পড়েনি। ২৫ বছর আগে কিংবা এর কাছাকাছি সময়ে, আমার মতো, যাদের জন্ম তাদের কৈশোরে কিংবা উঠতি যৌবনে পলিটিক্যাল আইকন বলে ছিলেন না কেউ। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়ে মসনদ দখলের জন্য প্রতিহিংসার রাজনীতি ছাড়া তেমন বলার মতো কিছু চোখের সামনে ঘটেনি। এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় - আ'লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহার 'ভিশন ২০২১' নতুন ভোটার হওয়া তরুণ-তরুণীদের উৎসর্গ করেছে। অন্যদিকে বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারের শেষ অংশে জাতীয় উন্নয়নে যুবশক্তিকে কীভাবে সম্পৃক্ত করা হবে সে কথা বলা হয়েছে। এসব কথা শুনতে খুব ভালো লাগে। এতো স্বপ্ন দেখারই বয়স।

আমার যেমন ভালো লেগেছিলো ২০০১ সালে। এরকমই নির্বাচনের একদিন বা দু'দিন আগে হাতে এসেছিলো ৩২ পৃষ্ঠার নিউজ 'পৃন্টে' ছাপানো সাপ্তাহিকটি। মনকাড়া প্রচ্ছদ। চোখে চশমা পরে মোটরবাইক দিয়ে দাঁড়ানো সুদর্শন তরুণ। খানিক তফাতে গেঞ্জি আর জিন্সে মোবাইল হাতে হেটে যাচ্ছে তরুণী। মাঝামাঝি পড়ে আছে একটি বই - 'এ বৃফ হিস্টৃ অফ টাইম', লাল রঙা প্রচ্ছদের ব্যাকগ্রাউন্ডে দালান ছিলো এবং পাশে সূর্য উঠার ছাপ ছিলো বলে মনে পড়ছে। প্রচ্ছদ কাহিনী 'এক কোটি তরুণের কাছে একটি আবেদন'। চৌষট্টি কিংবা পঁয়ষট্টি অথবা সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়েসে সে সাপ্তাহিকের স্যুটেড বুটেড এডিটর চমৎকার একটি চিঠি লিখেছিলেন। 'আমার তরুণ বন্ধুরা, আমার তরুণ বান্ধবীরা' ডেকে 'তুমি' সম্বোধনের অনুমতি নিয়েছিলেন। তারপর নানান ছলে চার-দলীয় জোটের জন্য ভোট চেয়েছিলেন। 'অমুক দলকে ভোট দিও' এমন কথা তিনি সরাসরি বলেননি। তিনি তুলনা করেছিলেন, সে সময়কার দুই নেত্রীর, দুই অর্থমন্ত্রীর, দুই দলের ক্ষমতার দুই টার্মের। তারপর সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন তরুণ বন্ধু ও তরুণী বান্ধবীদের উপর। শেষে ছোটো ছোটো বাক্যে বলেছেন - 'কারো কথায় ভয় পেয়ো না', 'সকাল সকাল কেন্দ্রে যেও', 'আগে আগে ভোট দিও'। কিন্তু মাঝে দেখিয়েছেন দূর্দান্ত কিছু স্বপ্ন, প্রচ্ছদের অলংকরণের মডেল তরুণ তরুণী জীবন।

সেবার ভোটার হইনি। নইলে ঐ চিঠি পড়ার পরে আমি আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাতাম, শুনেছি পালটিয়েছে অনেকে। মূল বক্তব্যে ভোটের আহবান হয়তো ছিলো, কিন্তু অমন চিঠি আমাকে কেউ কখনো লিখেনি। কেউ বলেনি - দেশের তরুণ হিসেবে আমার মোবাইল পাওয়ার অধিকার আছে। বিদেশে তরুণদের গাড়ী আছে- এপার্টমেন্ট আছে- ক্রেডিট কার্ড আছে, চাকরীর নিশ্চয়তা আছে, গার্লফ্রেন্ড আছে। আর বাংলাদেশের তরুণরা বেকার হয়ে হন্য জীবনে কাটাচ্ছে। সে চিঠিতে চিরযৌবনা এডিটর এ'ও লিখেছিলেন- 'বিদেশে তরুণদের গার্লফ্রেন্ড আছে। অথচ চাকরী নেই বলে তোমরা ভরা যৌবনেও (প্রাইম ইয়ুথ) বিয়ে করতে পারছো না'। ওয়াও! তরুণদের অর্থনৈতিক সমস্যার পাশাপাশি জৈবিক চাওয়া নিয়ে এমন করে আর কেউ ভেবেছেন বলে মনে পড়েনি। তাই সে চিঠি আমি বারবার পড়ি। হয়তো দু'পৃষ্ঠার চিঠি, কিন্তু কী দূর্দান্ত তার ভাষা, কী চমৎকার আহবান, লোভনীয় জীবনের ডাক!

দু'দিন পরে নির্বাচনে সেই এডিটরের ঘনিষ্ট দলটি জিতে। ভুমিধ্বস সে জয়ের উন্মাদনায় অনেক কিছুই ঘটে। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় শহরের কাকগুলোও বিষন্ন হয়ে যায়। তারপর ঋতু বদলায়। দেয়ালের পোস্টার খসে পড়ে। কিন্তু আমি যত্ন করে রাখি সে চিঠি, ৩২ পৃষ্ঠার সাপ্তাহিক। তরুণেরা এবার গার্লফ্রেন্ড না হোক, চাকরী অন্ততঃ পাবে সে আশায় চোখ রাখি স্মার্ট এডিটরের লেখায়। কিন্তু এ কী! তিনি আরও তরুণ হয়ে গেলেন। নানান রঙা শার্ট পরে (হয়তো আগেও পরতেন) লাল গোলাপ হাতে পেছনের জুলফি সামনে এনে ট্রেন্ডি করে চটাস চটাস করে বিদেশি ম্যুভির ক্লিপ দেখান। শুনেছি এমন অনুষ্ঠান তিনি আগেও করতেন। কিন্তু এবারও বিটিভির অনুষ্ঠানের চেয়ারটি তিনি নিজেই দখল করেছেন, সেখানে বসানোর মতো আরেকজন তরুণ খুঁজে পাননি। ওদিকে ঢাউস সাইজের বিশেষ সংখ্যায় তরুণরা লিখে যাচ্ছে তাদের প্রাইম ইয়ুথে ঘটে যাওয়া শরীরি সম্পর্কের ফ্রয়েডীয় কিংবা গুপ্তীয় গল্প। বিশেষ সম্পাদকীয়তে এডিটর জানাচ্ছেন - 'এসব গল্প আগামী দিনের সমাজ বিজ্ঞানীদের নীরিক্ষার বিষয় হবে'। কিন্তু, এক কোটি তরুণের কী হবে!

বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি, এক কোটি তরুণের একজন (স্ত্রী সহ) বিটিভি'র প্রাইম টাইমের স্লট দখল করেছিলেন। এই তরুণ পরে প্রবীণ পিতাসহ 'বিকল্প' পথ ধরেছেন। আরেক তরুণ অবশ্য তরুণের পর্যায়ে নেই। সেই এডিটরের ভাষায় বাংলাদেশের মহাথির তিনি। মালয়েশিয়া থেকে শেখার জন্য কিনা জানি না, তবে কতো কোটি টাকা কী জানি কী হয়েছে, আঁটকে গেছে। এই শাহেনশাহ তরুণের কাছাকাছি বন্ধুরা কেউ টিভি চ্যানেল করেছেন, ফোন কোম্পানী এনেছেন। এগুলোর অর্থায়ন সুত্র নিয়েও নানান তর্ক আছে, মামলা আছে। আজ এটিএন বাংলায় রাহুল রাহার সাথে 'লীড নিউজ' অনুষ্ঠানে বিএনপির মিস্টার রিজভী অবশ্য বলছিলেন, "বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের গণতন্ত্রের কৈশোরিক অবস্থায় দূর্নীতি একেবারে না থাকা সম্ভব নয়"। প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বড়ো কথা নয়, 'গণতন্ত্রের কৈশোরিক অবস্থা' কী, সেটা ভাবতেই অনুষ্ঠান শেষ। রাহুল রাহা বুঝেছেন কিনা জানি না। যাক, তরুণের গল্প ছেড়ে কৈশোরে নয়। ক্ষমতাবান তরুণেরা সব মামলা থেকে মুক্ত হবেন, ইতোমধ্যে হতে শুরু করেছেন, আরও হবেন, একেবারে বিশুদ্ধ তরুণ হবেন। বিপরীতে হার্ভাড/ক্যামব্রিজের পেপার নিয়ে আলোচনায় আসছেন আরেক তরুণ। তিঁনি বিদেশীনি গার্লফ্রেন্ডকে বৌ করেছেন, রাণীমা'র উজির নাজিররা লিখছে - সম্ভবনা আছে তিনিই হবেন রাজীব গান্ধী, তাঁর বিদেশীনি স্ত্রীটি সোনিয়া স্টাইলে দেশে আলো দেখাবেন। হয়তো সেসব কেবলই কল্প-গল্প। কিন্তু, শেষতক সে-ই সুদর্শন চির তরুণ সম্পাদকের পরিণতি মইন-মিলার কল্পগল্পের চেয়েও করুণ হয়েছে। লাভ রোডে 'সাদ্দাদের বেহেশতখানা'য় লস দিয়ে 'পালাতে গিয়ে' বিমান বন্দরে আঁটকে গিয়েছিলেন। তখনো আমি সে-ই চিঠিওলা ম্যাগাজিন সাথে নিয়ে ঘুরি। ইরাবতী বা কাওয়াই নদীর ওপাশে গেলেও একান্ত ব্যক্তিগত ডায়েরীর সাথে ভাজ করে রাখি। স্বপ্নগুলো সত্যি হোক না হোক, কল্পগল্প মনে করেই পড়ি সে চিঠি। সময় যায়, পাঁচ বছর, ছয় বছর। কেবল অপেক্ষায় থাকি, একবার যদি দেখা হয় - চিঠিটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করবো, 'আমাদের কাছে এ চিঠি আপনি লিখেছিলেন, মনে আছে?' দেখা হয়নি। বরং গত মে মাসে আরেক চিঠিতে তিনি বিদায় জানিয়েছেন ২৯ বছরের আজন্ম সংস্পর্শের পত্রিকা থেকে। সে চিঠি পড়ে আমি হতাশ হয়েছি, বিমর্ষ হয়েছি। তরুণদের মিছে স্বপ্ন দেখিয়ে তাঁর কী লাভ হলো, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চিন্তা বাদ দিয়েছি। কেবল, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছি - 'আই ফিল স্যরি ফর ইউ, মিস্টার রেহমান!'

নির্বাচনের এ ডামাঢোলে, নবীন/তরুণদের জপাজপিতে আজ খুব মনে পড়ছে মিস্টার রেহমানের সে চিঠির কথা। প্রথম কৈশোরে প্রেমিকার লেখা চিঠির অনুভব যেমন প্রায়ই নস্টালজিক করে তোলে, ঠিক তেমন করে মনে পড়ছে। বাসায় কোথাও কোনো ফাঁকে আছে হয়তো এখনো। আজ বাদে কাল নির্বাচন। বিশাল তরুণ গোষ্ঠী ভোট দিবে। এক কোটি তরুণের একজন হয়ে, খুব আশার কিছু দেখতে পাচ্ছি না। বেকারত্ব বাড়ছে, চাকরীর বাজার সংকোচিত হচ্ছে, ধনী-গরীবের আয় বৈষম্য বাড়ছে দিনদিন। বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দা ২০০৮এ গেলো এবং এখনো চলছে তার ধাক্কা বাংলাদেশে বিন্দুমাত্র গেলেও নতুন সরকার কীভাবে সামলাবে। জনসংখ্যার বিকাশমান বা বিস্ফোরন্মুখ যুব অংশের কর্মসংস্থান কোথায় কীভাবে করা হবে সেটা হয়তো দেখার বিষয় হবে। কে জানে, হয়তো আরো একজন শাহাবুদ্দিন প্লেনের চাকায় চড়ে বিদেশ যেতে চাইবে, অবৈধ পথে ইউরোপ পাড়ি দিয়ে গিয়ে মাঝ সমুদ্রে পথ হারাবে মুন্সীগঞ্জের সোলায়মান, স্বপ্নভূক হয়ে মারা যাবে তারা, এবং আরও অনেকে। কুয়েতে ন্যুনতম মজুরী চাওয়া শতশত শ্রমিককে আধা রুটি খেতে দিয়ে রোদের মধ্যে পাথরে দাঁড় করিয়ে রাখবে, প্লেন ভর্তি করে রক্তাক্ত জামায় এসব মিসকিনদের ফেরত পাঠানো হবে স্বদেশে। এসব দেখে আমাদের নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র পুরনোর মতোই নির্বিকার থাকবে। পাঁচতারার বলরুমে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে প্রকাশিত প্রচারিত হবে - এবারও জিডিপি গ্রোথ সেভেন পার্সেন্ট। ধুমপান ও রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গণ বাড়বে। এক কিশোরী তার ফেসবুক প্রোফাইলে পলিটিক্যাল ভিউ লিখবেঃ All Sux। তখন বিভিন্ন চ্যানেলে তরুণদের আইকন সাজবেন একজন ভুঁড়িওলা বিগত বিতার্কিক। চল্লিশ ছোঁয়া হাল্কা সাদা হওয়া চুলে কলপ লাগিয়ে তরুণদের জায়গাটি তিনি দখল করে নিবেন। পরিপাটি গোঁফে, মেক-আপে স্যুটে বুটে, তিনি বলবেন, 'প্রিয় তরুণ বন্ধুরা, তোমরা হয়তো জানো, এডমান্ড বার্ক বলেছিলেন...'।

.
.
.

Read more...

08 December, 2008

গরুর খোঁজে, ফেইসবুকে

বিকেলে পাশের বাড়ীতে খানিক চাপা হৈ-হল্লা পড়ে গেলে তৌসিফ দ্রুত বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসে। এমন সমবেত চিৎকার সাধারণতঃ এ বাড়ির কারো কানে আসে না। কিন্তু তৌসিফ এ আওয়াজ শুনলো। কারণ, জানালা খোলা রাখার কারণে পাশের বাড়ীর বারান্দায় কী কী আলাপ হয়, বাড়ীর মালিক মতিন চাচা উঁচু স্বরে চাচীকে কী কী বলেন সব তার কানে চলে আসে। এরচেয়েও বড়ো কারণ কখন আকাঙ্খিত সে ডাক শোনা যাবে – ‘মা আমি বাইরে গেলাম, দরজা লাগিয়ে দাও’। এ ডাক শোনার পরে তৌসিফ দ্রুত জিন্সে পা গলায়, আরও দ্রুত জামায় এক্সাইট স্প্রে করে। তারপর হুড়হুড়িয়ে মোড়ের রাস্তা ধরে – ‘সুমাইয়া, কলেজে যাচ্ছো?’

ঈদের ছুটিতে সুমাইয়ার কলেজ বন্ধ, প্রাইভেটেও যায় না। বরং আজ দুপুরের পর থেকে সুমাইয়ার সিডি প্লেয়ারে বাজছিলো – ‘চাঁদের আলো যদি ভালো লাগে, কাল হয়ে যায় ঝাপসা, আমার এ তরী যদি চলে যায়, ফিরে আর আসবে না’। দূর থেকে ভেসে আসা অস্পষ্ট গানে কান পেতে তৌসিফ আনন্দআলো’র চলতি সংখ্যায় ‘অপি করিমের আয়নাঘর’ পড়ছিলো আর ভাবছিলো আগামীকাল কীভাবে সুমাইয়াদের বাসায় যাওয়া যায়। এর মাঝে আচমকা এমন হৈ-হল্লায় সে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে।

মতিন চাচা হন্তদন্ত হয়ে কথা বলছেন। পেছনে চাচী। সুমাইয়াকে দেখা যাচ্ছে না। মতিন চাচা কোনদিকে যাবেন সেটাও ভেবে পাচ্ছেন না, ডান-বাম করছেন। চাচীও অস্থির। শেষে চাচা পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে ডান দিকে রওনা দিলে তৌসিফ চাচীকে জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে। চাচীর কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম জমেছে। অস্থিরতায় জড়ানো গলায় যা বললেন তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে কুরবানীর গরু হারিয়ে গেছে। কীভাবে হারালো, কোথায় হারালো, কখন হারালো এসব প্রশ্নের সাথে দারোয়ান মাসুদ কই ছিলো সে প্রশ্ন চলে আসে। আর জানা যায়, গরুর সাথে সাথে মাসুদও নাই। মাসুদ কোথাও গেলো আর এই ফাঁকে চোর গরু নিয়ে হাওয়া হলো, নাকি মাসুদ নিজেই গরু নিয়ে হাওয়া হলো সে প্রশ্নের উত্তরে চাচীও দ্বিধাগ্রস্থ। কেবল বলেন, দেখো তো তোমার চাচা আবার কোনদিকে গেলো।

মতিন চাচা গরুর খোঁজে রাস্তায় হন্য হয়ে ঘুরছে, চাচী গেটে দাঁড়ানো; তখন তৌসিফের ছাদে যেতে ইচ্ছে করে। ‘এই ছাদে আমি আর ঐ ছাদে তুমি’ স্টাইলে সুমাইয়ার সাথে ইটিশপিটিশ করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু চাচীর উৎকন্ঠা ‘দেখো তো, তোমার চাচা কোনদিকে গেলো’ তৌসিফকে দায়িত্বশীল করে তোলে। তার মনে হয় এ-ই সুযোগ, চাচার সাথে গরুর খোঁজে বের হয়ে খানিক প্রিয় হওয়া যাবে। এসব ভেবে তৌসিফ দৌড়ে ডান দিকের রাস্তায় যায়। অনেক দৌড়ে মতিন চাচার কাছাকাছি আসতেই চাচা ঘাঁড় বাঁকিয়ে একবার তাকান। যখন দেখে তৌসিফও সমান তালে লম্বা লম্বা পা ফেলছে তখন মতিন চাচা জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি আমার সাথে কোথায় যাচ্ছো?’
‘আমিও যাই চাচা, গরু খুঁজি’।
‘তোমাকে কে বলেছে আমাদের গরু খুঁজতে?’
তৌসিফ এবার চুপ থাকে। তবে পা চলা বন্ধ করে না।
‘এই ছেলে, কথা শোনো না কেনো? যা-ও বলছি।‘
তৌসিফ এবার থামে। বলে, ‘চাচা, আমি তাহলে ঐদিকটাই খুঁজি?’
মতিন চাচা কথার জবাব দেন না। আগের মতোই ছুটতে থাকেন। তৌসিফ তখন লীফা কনফেকশনারীর সামনে এসে খানিক জিরোয়। সেন্টু-জাহিদদের খোঁজ করে। সবাই মিলে খূঁজলে হয়তো গরু পাওয়া যাবে। পরের মুহুর্তেই মতিন চাচার খিটখিটে আচরণ মনে পড়ে। তার মনে হয়, কোনো দরকার নেই খোঁজার, গরু হারিয়েছে বেশ হয়েছে। তখন তৌসিফের কল্পনায় ভেসে উঠে সারা বিকেল সন্ধ্যা রাত ঘুরেও মতিন চাচা তার গরু খুঁজে পাবে না। ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরবে ঘাম নিয়ে। তৌসিফ আজ রাতে এসএমএস এ সুমাইয়াকে বলবে – ‘কী আর করবে, আমাদের বাড়ী চলে এসো, গোশত কেটে দিও। এক কসাইয়ের টাকা দেব, ব্যাগ ভর্তি গোশত দিবো, চাইলে কলিজা-চর্বি দেবো।‘ সুমাইয়া কী বলবে সেটা ভাবার সুযোগ হয় না। সামনে মোটরবাইক থামায় অয়ন ভাই, কলেজের ছাত্র সংসদের সভাপতি।
হাত তুলে ‘স্লামালাইকুম ভাইয়া’ বলতেই অয়ন ভাই ডাক দেয়, ‘কী করিস? এদিকে আয়, বাইকে উঠ।‘

কোথায় যাবে সে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে জানা যায় সামনের ইলেকশনের এমপি ক্যান্ডিডেট আসাদ ভাই এলাকায় এসেছে। ঈদে সবার সাথে দেখা সাক্ষাত করছে, মূল কাজ নির্বাচনী প্রচারণা তো আছেই। তৌসিফ জানে না এইসব জায়গায় তার কী কাজ থাকতে পারে, তবুও অয়ন ভাইয়ের সাথে উদ্দেশ্য-কারণ-জিজ্ঞাসায় যায় না। ঠান্ডা বাতাসে মোটরবাইকে শীতশীত ভাব লাগছে আর কেনো জানি সুমাইয়াকে মনে পড়ছে।

ঝিলের পাড় ব্রিজের উপরে মোটর বাইক উঠলে অয়ন দেখে দূরে মাঠ দিয়ে মাসুদ হেটে যাচ্ছে, সুমাইয়াদের দারোয়ান মাসুদ। হাতে রশি ধরা গরু। তৌসিফের মনে হয় – আর্কিমিডিসের মতো ইউরেকা ইউরেকা বলে চিৎকার দেয়। অয়ন ভাই মোটর বাইক থামিয়ে কাহিনী শুনলে দ্রুত দুইজন মাঠে নেমে যায়। মাসুদ খানিক থতমত খেলেও বলে, ২দিনে গরুটা দূর্বল হয়ে পড়েছে, তাই সে ভেবেছে – এদিকটায় এনে ঘাস খাওয়ালে ভালো হবে। আর যাই হোক কাল সকালেই এই গরুর জীবন শেষ। মাসুদের এ গল্প নিতান্তই বানোয়াট মনে হয়। বোঝা যায় – গরু নিয়ে ভাগছিলো সে। নয়তো কাউকে না বলে কয়ে এতো দূরে এনে গরুকে ঘাস খাওয়ানোর কী দরকার হলো। মাসুদ কথার পিঠে কথা বললে অয়ন ভাই মাসুদের শার্টের কলার চেপে ধরে, বলে – ‘তুই কোন স্কুলে পড়ছোস?’
এরকম কথা কাটাকাটি শেষে অয়ন ভাই তৌসিফকে দায়িত্ব দেয় গরু এবং মাসুদ দুইটাকে নিয়ে সুমাইয়াদের বাসায় পৌঁছে দিতে। আসাদ ভাইয়ের মিটিং্যের দেরী হয়ে যাবে তাই অয়ন ভাই মোটর বাইকে টান দেন। ওদিকে গরু আর মাসুদকে সামনে রেখে তৌসিফ রাস্তা ধরে।

পথে পথে মাসুদ নানা বাহানা দেয়। বলে তার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিলো না, চুরি তো নয়ই, ক্ষুধার্ত গরুর জন্য তার মায়া চুপসে চুপসে পড়ে। তখন তৌসিফের মাথায় অংক খেলে। দুয়ে দুয়ে আর আর দুই দু’গুনে চার মিলে যায়। মাসুদকে হাত করার এই সুযোগ, সামনে নানান কাজে তাকে দরকার হতে পারে। আর আজ এই মুহুর্তে মাসুদকে চোর প্রমাণের চেয়েও নিজেকে হিরো বানানোর বড়ো দরকার। আর সে সুযোগ যখন হাতের কাছে চলে এলো তখন বৃথা হেলা করা কেনো!

খানিক ধমকের পরে মাসুদকে বুঝানো হয়, তাকে চোর বলা হবে না। বরং বলা হবে সে’ও হঠাৎ বিকেলে গেটের কাছে গরু না দেখে খুঁজতে বের হয়েছিলো। ভয়ে কাউকে বলেনি কিছু। তবে শেষমেশ গরু খুঁজে পেয়েছে তৌসিফ। ঝিলের পাড় ব্রিজের অন্য পাশে দড়ি ছেড়া গরু দেখে তৌসিফ ভেবে নিয়েছে এটাই সুমাইয়াদের গরু। গরু নিয়ে আরেকটু সামনে আসতেই মাসুদের সাথে দেখা, তখন মাসুদ সনাক্ত করে এটাই তাদের গরু। এ গল্পের ফরম্যাট ঠিক হয়ে গেলে দুজনেই খুশি হয়ে সুমাইয়াদের বাসার গেটে কড়া নাড়ে।

তখন সন্ধ্যা নেমেছে। টিভিতে দু’জন মডেল সেলিব্রিটি আর একজন নাট্যকার মিলে খাসির শাহী কোর্মা রান্না শিখাচ্ছে। মতিন চাচা গরু দেখে উল্লাসে ফেটে পড়লেন। মাসুদ তুই কই ছিলি জিজ্ঞাসার পরে যখন তিনি জানতে পারেন সব কৃতিত্ব তৌসিফের তখন তিনি তৌসিফের মাথায় হাত বুলান। বেঁচে থাকো বাবা, বলে বিকেলের রাগী কথার জন্য একটু লজ্জিতও হন – ‘বুঝো তো বাবা, ঈদের আগের দিন গরু হারানো। কাল বাসায় এসো বাবা, তোমার বাবা মা’কেও আসতে বলো’।
তৌসিফ তখন সুমাইয়ার দিকে তাকায়। নোকিয়া এন সিরিজের নতুন সেটে গরুর ছবি তুলছে সে, আর এমন ভাব করছে যেনো তৌসিফকে চিনেও না সে।

তৌসিফের নিজেকে কেমন যেনো সুপার হিরো মনে হয়। মনে হয় এরচেয়ে বেশি আনন্দের ঈদ হতে পারে না। সুমাইয়ার উপর একটু অভিমান হয়। কী এমন ক্ষতি ছিলো একটু কথা বললে। সুমাইয়া এক কাপ চা খেয়ে যেতে বললে চাচা-চাচী কি বাধা দিতো আজ? এ অভিমানে তৌসিফ সুমাইয়াকে ফোন করে না সে। আরও খানিক পরে ফেসবুকে লগ ইন করলে নোটিফিকেশনে দেখে ‘সুমাইয়া মতিন ট্যাগড ইউ ইন ওয়ান ফটো'।
তৌসিফের বুকটা ধক করে উঠে। তবে কি গোপনে সুমাইয়া তখন তার ছবিও তুলে নিয়েছে! স্লো ইন্টারনেটে আস্তে আস্তে পেজ ওপেন হয়। কিংবা অতি উৎসাহে তৌসিফের মনে হয় পেজ ওপেন হতে দেরী হচ্ছে খুব। শেষে একটা গরুর ছবি আসে, দেখা যায় ছবির নাম – ‘আমাদের কোরবানীর গরু, আজ হারিয়ে গিয়েছিলো’। গরুর পেটে ট্যাগ করা – তৌসিফ রহমান। রাগে তৌসিফের দাঁত কিড়মিড় করে। তখন মোবাইল ফোনে রিং হয়। সুমাইয়ার ফোন – ‘কী খবর, হলি কাউ- পবিত্র গরু?’
তৌসিফ চুপ করে থাকে।
সুমাইয়া জিজ্ঞেস করে – ‘কাল বাসায় আসবে তো? পরশু সকালে ফ্রি আছো? ঘুরতে যাবে?’
তৌসিফ এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না। মনে হয় এর জবাব গরু খোঁজার চেয়েও কঠিন।

ফেসবুক স্ট্যাটাসে তৌসিফ টাইপ করে –
‘আগামীকাল সুমাইয়া গরুর গোশত খাবে’।

.
.
.

Read more...

  © Blogger templates The Professional Template by Ourblogtemplates.com 2008

Back to TOP