পাঠ প্রতিক্রিয়া - ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প
গল্পকার নামে আমরা যাদের চিনি তারা কতোটা গল্প
লেখেন আর কতোটা গল্প বলেন – এ প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত পাঠকের দরবারেই ছেড়ে দিতে
হবে। পাঠকই নির্ধারণ করবেন - কতোটা পথ সঙ্গী হতে পেরেছে লেখকের গল্পবয়ান, কতোটা
চেনাজানা হয়ে উঠেছে গল্পের ভেতরের মানুষগুলো। আর গল্পকার যখন তার কিছু গল্প মলাট
বন্দী করে পাঠকের হাতে তুলে দেন, তখন তার অবস্থা হয় সেই তীরন্দাজের মতো যে কিনা
তাকিয়ে থাকে, ছুঁড়ে দেয়া তীরে নয়, ঘিরে থাকা দর্শকের স্থির হওয়া চোখের ভাষা সন্ধানে।
বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখক মাহবুব আজাদ তাই বলেছেন – “পাঠকের আয়নায় নিজের বিম্ব দেখতে
চাইছি, তাই পাঠকের পাঠপ্রতিক্রিয়ার প্রত্যাশী হয়ে থাকবো।” আলোচ্য বইটির নাম –
ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প।
বাংলা ছোটগল্পের ছাপিত মাধ্যমে মাহবুব আজাদ
নামটি একেবারে নতুন হলেও বিগত কয়েক বছরে সাহিত্য চর্চার নতুন মাধ্যম অনলাইন
সমাবেশে লেখক বেশ পরিচিত। বলা হয়েছে – “বাংলা ব্লগের ঊষাকালেই সেখানে লেখালেখি
শুরু মাহবুব আজাদের। এ মাধ্যমটি কৌলিন্য লাভ করার আগে সেখানে যেহেতু রচনার মান
সাধারণভাবে সুউচ্চ ছিলো না, অনেক পাঠকেরই খেদ ছিলো তাঁর লেখার এমন অপচয় নিয়ে।
অনামী লেখকের লেখা নিয়ে এমন ভালোবাসা সাধারণ পাঠক যখন দেখান তখন সে লেখার মান
কতোটা ভালো হতে হয় সে কথা বলাই বাহুল্য।”
প্রশ্ন জাগে, মাহবুব আজাদ কোন বিষয়ে গল্প লেখেন
বা কেমন করে লেখেন?
ম্যাগনাম ওপাস ও
কয়েকটি গল্প বইয়ে গল্পের সংখ্যা ছয়। আকৃতি বিচারে হয়তো কৃষ এবং
বৃহদাকার এমন ভাগে গল্পগুলোকে গোত্রীয় করা যায়, কিন্তু – বিষয়বস্তু বিবেচনায়? ঠিক
এ জায়গায় এসে একটু থমকে যেতে হয়। কারণ, গল্পগুলোকে পাশাপাশি রেখে নিক্তিতে মাপার
উপায় নেই। ‘পুরনো বাড়ি’ গল্পটির কথাই ধরি। হাসান নামের যুবকটি তার পরিবারের পুরনো
আবাসে যায় কেবলই স্মৃতি হাতড়াতে? ক্রমশ নেই হয়ে যাওয়া নীল আকাশ, লাল শিমুল আর বুড়ো
কৃষ্ণচূড়ার জন্য বিষাদগ্রস্ত হতে? অথবা যদি উত্তর দিই - “এখানে তো কিছু নেই!
কিচ্ছু নেই!” বলে হু হু কাঁদতে যদি গিয়ে থাকে হাসান, তবে কি তা কেবলই অহেতূক? নাকি
শেষে এই অনুধাবন প্রকাশ পায় যে বালকবেলা এবং তার শত্রু কাকেরা হারায় না কখনো? গল্প
পাঠের শেষে জীবনানন্দের লাইনটিই মাথায় চক্কর দেয় – “পাবে নাকো কোনোদিন,/ পাবে নাকো
কোনোদিন/ পাবে নাকো কোনোদিন আর”।
অতীত স্মৃতির বালিশে মুখ গুঁজে ঘ্রাণ নেয়ার
মাদকতা কেটে যায় ‘নিদপিশাচ’ নামের অতিপ্রাকৃত গল্পটি পড়লে। পরিতোষবাবুর মেয়ে
স্বাগতার প্রতি মোহ এবং ঘনিষ্ঠতার আকাঙ্ক্ষা বাস্তব-অবাস্তবের জালে যখন বন্দী হয়,
গল্পকথক উঠতি বয়সের নাসিম তখন স্বপ্ন এবং বাস্তবের চক্করে পড়ে। এ দুয়ের মাঝে
প্রোথিত দেয়াল সে ভাঙতে পেরেছিলো কিনা তা জানতে গল্পের শেষ লাইন পর্যন্ত পড়ে যেতে
হবে। গল্পকারের ছুঁড়ে দেয়া তীরে, শেষ অবধি, এমন তীক্ষ্মই চোখ থাকে পাঠকের।
অসহ্য লজ্জার এবং হতাশার কল্পনা-জগত যদি বাস্তব
হয়ে উঠে! এমন শংকা জাগায় ‘বিলুপ্তি’ গল্পটি। বাংলাদেশের শেষ জীবিত মুক্তিযোদ্ধাকে
নিয়ে লেখা এ গল্প পড়ে পাঠক বলবেন – অতিকল্পনা নয়, রাষ্ট্রের সামগ্রিক ব্যর্থতার
সম্ভাব্য বাস্তবতা এই গল্প!
বইয়ের শেষ গল্প ‘ম্যাগনাম ওপাস’ আসলে কার
মহত্তম কীর্তির বয়ান? গল্পের ভেতরের গল্পকার আনিস চৌধুরীর রেখে যাওয়া অনুপস্থিতি
নাকি সংগোপনে লেখা অন্য কোনো গল্প? ম্যাগনাম ওপাসের সন্ধানে থাকা রকিব এবং রমা যখন
শরীরি ঘনিষ্ঠতায় ক্লান্ত এবং উদ্দীপ্ত, তখন কি গল্পকার মাহবুব আজাদ নিজেই রচনা
করেন অন্য কোনো মহত্তম কীর্তি? অবশ্য দূর্বল পাঠকের শংকা থাকে - ফ্রয়েড এসে অদৃশ্য
করে দেবে দৈনন্দিনের মুখোশ? পাঠকের চোখ যখন ছুঁড়ে দেয়া তীরের দিকে, সমবেত হাত যখন
অপেক্ষায় নন্দিত কিংবা নিন্দিত অভিধা যোগের, তখন মূলতঃ ম্যাগনাম ওপাস মাহবুব
আজাদেরই অনন্য সৃষ্টি হয়ে ওঠে।
শুরুতে বলছিলাম, গল্পগুলোর বিষয় বৈচিত্র্যের
কথা। বাকী গল্প দুটি, এই পাঠকের মতে ‘বনসাই অ-গল্প’, ‘সেতু সংকট’ আর ‘তোমার ঘরে
বসত করে কারা’ ধার ও ভার বিবেচনায় খানিক তলানীতে পড়ে যাবে। কিন্তু পিয়াসী পাঠকের
চুমুক বিস্বাদ জন্ম দেবে না, এ সম্ভাবনা থেকে যায় প্রবল। এর পেছনের কারণ ঐ একটিই –
লেখকের বৈচিত্র্য প্রয়াস এবং বর্ণনায় পরিমিতবোধ।
সাম্প্রতিক সাহিত্য আলোচনায় এ সময়ের বাংলা
ছোটোগল্প নিয়ে এক ধরনের শ্লেষ শোনা যায় প্রায়শ। কাল/দশকের মানদন্ডে স্বর্ণযুগকে
অতীত করে দেয়া উত্তরাধুনিকতার মোড়কে গল্প সৃষ্টিকে অযুত বিশেষণে ফেনায়িত করা হয়
হরহামেশা। কিন্তু, পরীক্ষণের সে সুতিকাঘরে যতো গল্প খুন হচ্ছে অথবা দারিদ্র্যের
অগম-দুর্গম পুষ্টিহীনতায় গল্পগুলো যে জায়গা পাচ্ছে না পাঠকের মনে - সে দিকটিতে কি
তাকাচ্ছেন সুধীজন? মূলধারার বাইরে অনলাইন মাধ্যমে হাজার পাঠকের মুখোমুখি দাঁড়ানো
গল্পকারের সে ভয় নেই। গল্পের তুমুল ময়নাতদন্ত সেখানে লেখককে ঋদ্ধ করছে প্রতিদিন।
তাই নীরিক্ষণের মোড়ক নয়, বরং পাঠকের মুখোমুখি দাঁড়ানো কিছু গল্পের সংকলন ‘ম্যাগনাম
ওপাস ও কয়েকটি গল্প’। প্রথম প্রকাশিত বইটির জন্য মাহবুব আজাদকে যখন ‘সিটি-আনন্দ
আলো সাহিত্য পুরস্কার’ দেয়া হয়, তখন লেখককে স্বীকৃতি নয় – স্পষ্টভাবেই পাঠককে
জানান দেয়া হয় এক সম্ভাবনাময় লেখকের আগমন সংবাদ।
_____
_____
বইয়ের নামঃ ম্যাগনাম ওপাস ও কয়েকটি গল্প
লেখকঃ মাহবুব আজাদ
ধরনঃ ছোটগল্প সংকলন
প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারী ২০১০
প্রকাশকঃ শস্যপর্ব
পরিবেশকঃ পাঠসুত্র
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৮০
মূল্যঃ ১০০ টাকা।
0 মন্তব্য::
Post a Comment