পাঠ প্রতিক্রিয়া : আজগুবি রাত
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের লেখা নিয়ে নির্মোহ মন্তব্য প্রকাশে বরাবরই আমি ব্যর্থ। এর মূল কারণ – শুরুতেই এমন একটি ধারণা নিয়ে পড়া শুরু করি, মনে হয় – পাঠক হিসেবে আমার প্রত্যাশার সবটুকুই পূর্ণ হবে। এ তীব্র পক্ষপাতের ঘোরতর সমস্যাটি হলো, একবার হতাশ হলে আরেকবার মুগ্ধ হওয়ার সম্ভবনা বিলীন হয়ে যায়। পাঠক হিসেবে আমার এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে একজন জনপ্রিয় এবং আরেকজন সম্ভবনাময় তরুণ লেখকের গদ্য পাঠে।
এবার যখন সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের উপন্যাস ‘আজগুবি রাত’ পড়া শুরু করলাম, অদ্ভুতভাবে মনে হতে লাগলো – মুগ্ধতার পরিসমাপ্তি এবার ঘটতে যাচ্ছে। হুমায়ুন আহমেদ যেমন বিভিন্ন নামে একই উপন্যাস লিখে যান, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও সম্ভবত সে পথ ধরেছেন। আগে পড়া তাঁর ‘আধখানা মানুষ’ উপন্যাসের শুরুর সাথে, যেখানে প্রবল গতিতে তেড়ে আসা নদীর ঢেউ আঘাত করে গ্রামের সীমান্তে – ভাঙনের শব্দ শুনেও মানুষ নিশ্চিত হতে পারে না এ কীসের শব্দ – গ্রামের মাঝখানের কুলিং কর্ণারে বসে একটু আগে কোক খাওয়া মানুষটি ভেবেছিলো বুঝি তার পেট থেকে কোকের ঢেকুর উঠছে, ঠিক এরকমই মনে হয় ‘আজগুবি রাত’এর শুরুর একটু পরের অংশকে। প্রবল বেগে আসছে ঘূর্ণিঝড় সারিকা। দুবলার চরে ‘সমুদ্রকন্যার মন’ ছবির শ্যুটিং করতে আসা একদল ফিল্মী মানুষকে ‘আধখানা মানুষ’এর গ্রামবাসী মনে হয় তখন। অবশ্য ‘আজগুবি রাত’এর সূচনা অন্যভাবে। চতুর্থ পরিচ্ছেদ পড়ার পর জেগে ওঠা হতাশাকে যাচাইয়ে আবার প্রথম থেকে পড়া শুরু করি –
“বলেশ্বর দিয়ে ভাসতে ভাসতে নূর বানুর কাটা হাত পাথরঘাটার খেয়াঘাটে এসে ঠেকল। অন্তত দুদিন হাতটি নদীতে ভেসেছে – ভেসেছে কেন, ডোবাই তো উচিত ছিল – সে এক রহস্য।“
শুরুতে এমন রহস্য এবং কিছু প্রশ্ন রেখে উপন্যাসের শুরু। এরপর দ্বিস্তর বিশিষ্ট বয়ানে একদিকে থাকে নূর বানু ও তার স্বামী ইকবালুর রহমানের সংসার, আদর ও অনাটনের সংকট। অন্যদিকে বলেশ্বরের এক মাইল উজানে নূর বানুর কাটা হাত পেয়ে দ্বিধায় পড়া মাঝি তোশাররফ, জনৈক সজ্জন, আরো সময় পরে - থানার ওসি, এ সময়ের হার্টথ্রব নায়ক ফিল্মের হিরো লাকি খান। কাটা হাতটি কার হতে পারে এমন নানা জল্পনায় সংকট প্রবল হয় ঘূর্ণিঝড় সারিকার আগমনী সংকেতে। সারিকা মোকাবেলায় করণীয় এবং প্রস্তুতিতে প্রতিমন্ত্রীর ফোন, ঘটনাক্রমে থানার কাছে থাকা দূর্যোগ সচিব, ইউ এন ও, সোনারবাংলা টেলিভিশন চ্যানেলের রিপোর্টার সাবরিনা – আসলাম এবং এরকম আরো অনেকে থানায় হাজির হলে সারিকা নয় বরং কাটা হাতটি কার, কেনো এ হাত কাটা, কোত্থেকে এলো এ হাত – এসব প্রশ্ন প্রধান হয়ে ওঠে। আরো অদ্ভুতভাবে উপস্থিত সকলে সঙ্গোপনে কাটা হাতটির সঙ্গে নিজের জীবনের কোনো এক ঘটনার মিল পায়, দ্বিধাগ্রস্ত হয়।
নুর বানুর কাটা হাতের রহস্য উন্মোচনে উপন্যাসে যতোটা গতি এবং অস্থিরতা – ঠিক ততোটাই স্থির নুর বানু আর ইকবালের সংসারী জীবন। নুর বানুর ঘরে, উঠানে এবং বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তায় কী হয় না হয় তার সবই দেখে কানা রাইসু। কানা রাইসু, যার বয়স এখন দশ, নিরবে নির্জনে বসে থাকে নুর বানু ও ইকবালুর রহিমের বাড়ির উঠানের উলটা দিকে অঘন জঙ্গলের পাশের বিলাতি আমড়া গাছের নিচে বছরের পর বছর। কানা রাইসু সেখানে বসে বসে বৃষ্টিতে ভিজে, আবার পরদিন রোদে শুকায়। কখনো ঘুমায় কিনা তার ঠিক নেই, তবে কানা রাইসু সব দেখে। দেখে - নুর বানুর সংসারের সকাল-দুপুর বিকাল, সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত। নুর বানুকে বেশ কয়েকবার কানা রাইসুর সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। কিন্তু অন্য কেউ কি কানা রাইসুকে দেখে না? নাকি দেখলেও তুচ্ছতার কারণে মনোযোগ দেয় না? উপন্যাসটি পড়তে পড়তে হঠাৎ করে মনে হয়, কানা রাইসু হয়তো কোনো মানুষ নয়। কালের স্বাক্ষী হয়ে থাকা কোনো গাছ, ঘাট কিংবা অন্য কোনো জড়বস্তুর কল্পিত মানবরূপ! সারিকার তান্ডবের সূচনায় ‘আজগুবি রাত’ এর আখ্যান শেষ হয়। নূর বানুর কাটা হাতের রহস্যময়তা এবং অন্যান্য সমূহ সংকটের কিছু কিছু সমাপ্তিও হয়তো হয়, কিন্তু পাঠকের মনে দাগ কেটে যায় কানা রাইসু – সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের এক দূর্দান্ত সৃষ্টি এই কানা রাইসু। অভিনন্দন জানুন, লেখক!
‘আজগুবি রাত’ পড়েছি প্রায় মাসখানেক হলো।
পড়ার পরপরই দুটো বিষয়ে প্রশ্ন জাগে। মনে হয় – এ নিতান্তই লেখকের অমনোযোগীতা। প্রথমতঃ উপন্যাসের একেবারে শুরুর এ অংশ –
“...আর নূর বানুর হাত যে নূর বানুর হাত, সে কথাটাও এক কানা রাইসু ছাড়া -এবং আমি ছাড়া - কেউ-ই তো জানে না। আর কানা রাইসুর জানা আর আমার জানা তো একই কথা, যদিও তার বয়স মাত্র দশ, আমার যেখানে...। যা হোক, বয়সের কথা থাক... নূর বানুর বয়সের কথাই না হয় বলি।”
এটি উপন্যাসের চতুর্থ বাক্য। স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে উত্তম পুরুষে বলা হবে বাদবাকী গল্প। কিন্তু, কথক নিজের বয়স না বলে যেখানে থামলো, তারপর আর ফিরলো না – সারিকার তান্ডবেও না।
অন্য প্রশ্নটি –
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পের মানুষগুলোর নাম বরাবরই যথার্থ মনে হয়। নূর বানু গরীবের মেয়ে, লাকি খান ফিল্মের হিরো, ভিলেন সম্রাট আনজাম, বিউটি কুইন আলপনা; নামগুলো শুনলে মনে হয় – এমনই তো হওয়ার কথা। লেখকের এ সচেতনতার কারণেই উপন্যাস বয়ানে পড়ি – লাকি খান ‘দেখলেন’, ওসি ‘বললেন’, সচিব ‘শুনলেন’ এবং এই ধারাবাহিকতায় নূর বানু এবং তার গরীব স্বামী ইকবালুর রহমান ‘দেখল’/’বলল’/’শুনল’। অথচ, উপন্যাসের একেবারে শেষ প্যারায় –
“শুধু ইকবাল দেখলেন, তিনি নূর বানুর আঙুলে আঙুল বুনে পাথরঘাটার আকাশ দিয়ে উড়ছেন। তাঁর পেছনে অজগরের সে ফনা।”
হতাশ হওয়ার যে শংকা শুরুতেই জেগেছিলো মনে, যে শংকা মনোযোগ বাড়িয়েছে পাঠে, তা কেটে গেছে মাঝামাঝি পর্যায়ে। কানা রাইসুর কারণে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের অন্যান্য উপন্যাস (যা পড়েছি) থেকে ‘আজগুবি রাত’কে এগিয়ে রেখেছি। কিন্তু, প্রশ্ন দুটি অমীমাংসিত রয়ে গিয়েছিলো। সপ্তাহ খানেক আগে, সম্ভবত ট্রাফিক জ্যামে বসে বসে অপেক্ষায়, এ দুটি প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি নিজের মনে।
লেখকের জন্য তাই আরো এক দফা অভিনন্দন।
0 মন্তব্য::
Post a Comment