আব্দুল মান্নান সৈয়দের গল্প
আব্দুল মান্নান সৈয়দের লেখা আগে পড়িনি। গল্প নয়, উপন্যাসও নয়।
কখনো সংবাদপত্রের সাময়িকী পাতায় তাঁর লেখা চোখে পড়েছে বলেও মনে পড়ছে না। 'সত্যের মতো বদমাশ' নামে বইয়ের লেখক তিনি - এটুকুই মাথায় ছিল।
এ সপ্তাহে আব্দুল মান্নান সৈয়দের ১৫টি গল্প পড়লাম - বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত 'শ্রেষ্ঠ গল্প' মলাটে।
পড়েই আফসোস হলো - এতো দেরী করে পড়লাম কেন!
পাঠ অভিজ্ঞতার শুরুটা অবশ্য আরামের ছিল না। 'মাতৃহননের নান্দিপাঠ' পড়ে মনে হলো - অনেক গভীর বিষয়ের গল্প, জানি না সহজ না কঠিন করে লেখা - তবে শেষ বিচারে উচ্চমার্গেরই থেকে যায়। পাঠকের একনিষ্ঠ মনোযোগ দাবী করে এ গল্প। নয়তো - খেই হারানোর সম্ভবনা আছে প্রতি অনুচ্ছেদে।
চমকালাম দ্বিতীয় গল্প পড়ে। চাবি।
গল্পের নায়ক চাবি হারিয়ে যখন প্রতিবেশীদের দরজায় কড়া নাড়েন প্রতিটা ঘরেই দেখা হয় ভিন্ন ধরণের মানুষের। তাদের আচরণ, তাদের প্রতিক্রিয়া - এসবই নাগরিক বাস্তবতা। গল্পের নায়কের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। চাবি আর পাওয়া হয়নি। রূপকার্থে ব্যবহৃত চাবি আসলেই কি পাওয়া যায় জীবনে? যেমন করে পথ খুঁজে পায়নি 'রাস্তা' গল্পের নায়ক।
'গল্প ১৯৬৪', 'মাছ' আর 'জলপরী' পরের তিনটি অসাধারণ গল্প।
গল্প ১৯৬৪ বলার কৌশলে চমক আছে, শুরুতে বোঝাই যাইনি এ গল্প কবীরের। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় সংখ্যালঘু বন্ধুর বোনকে আশ্রয় দেয়ার মাঝেও আপাতঃ সচেতন তরুণের ভেতরের পশু জেগে ওঠে। প্রকাশ পায় অপরাধবোধ। কিন্তু, একেবারে শেষ লাইনে - গরমের সময় সাপ বেরোয় - বলার প্রয়োজন ছিল কিনা সেটা নিয়ে ভাবলাম অনেকবার। কখনো মনে হয়েছে শেষ ভাবনার দায় পাঠকের কাঁধে দেয়া যেতো, আবার মনে হয়েছে - কবীরের অনুতাপ বোঝাতে বা আত্মপক্ষ সমর্থনে এর দরকার ছিল।
চাবি আর মাছ - গল্প দুটোর মাঝে কোথায় যেন একটা সুক্ষ্ম মিল আছে। আত্ম অনুসন্ধান কিংবা আত্মমুক্তির ছায়া আছে দুটো গল্পেই। মাছ এর চেয়ে জলপরী আরেকটু সরলরৈখিক গল্প। তবে শেষে পানিতে ডুব দিয়ে শম্পাদের দরজার কড়া নাড়ার কৌশলটিই গল্পের কারিশমা।
অস্তিত্ব অন্যত্র গল্পটির শরীর কাঠামো একটু অন্যরকম। দাদার মৃত্যুর পর নাতির স্মৃতিচারণের ক্রমানুসারিক বিবরণ। অতীত থেকে বর্তমান আবার অতীতে যাওয়ার লাফ। লাফের মাঝখানেই মানুষের নিঃসঙ্গতার করুণ প্রলাপ।
আম্রকাননে, রাজা, অমরত্বের জন্য মৃত্যু - গল্প তিনটিকে এক শ্রেণীতে রাখা যায়। পৌরাণিক বা রূপকথার গল্প বলে মনে হয় - কিন্তু বর্তমানের সাথে যেনো মিলে যায় অনেক কিছু।
আরো বর্তমানের গল্প, যদিও ১৯৮৯ সালে রচিত, আবদুল হাফিজঃ জীবন ও সাহিত্য। সাহিত্য চর্চায় দলাদলি, এবং বণিকের সাহিত্য মাঠ দখলের যে কুশ্রী বাণিজ্য আমরা দেখি - তার চমৎকার বিবরণ আছে এ গল্পে। গল্পটি যেখানে শেষ, যেনো সেখানেই শুরু আরেক গল্প 'হোসেন মিয়ার সঙ্গে' - অন্ততঃ শুরুতে এমনটিই মনে হয় - লেখার উপকরণ সংগ্রহে লেখকের গণিকালয়ে যাওয়ার মিলের কারণে।
অতীতকে বর্তমানে আনার গল্প 'হোসেন মিয়ার সঙ্গে'। পদ্মানদীর মাঝির চরিত্ররা নতুনভাবে জেগে উঠেছে গল্পে, যেখানে নায়ক স্বয়ং মানিক বন্দোপাধ্যায়। কালক্রমে অনেক কিছু বদলালেও, হোসেন মিয়া কি আর পাল্টালো?
জানলাম, আব্দুল মান্নান সৈয়দ একজন জীবনানন্দ গবেষক।
জীবনানন্দ নামের একটি সাহিত্য পত্রিকাও তিনি সম্পাদনা করতেন। জীবনানন্দ বিষয়ে দুটো গল্প আছে এ বইতে।
'জীবনানন্দ দাশের একটি অপ্রকাশিত গল্প্', ব্র্যাকেটে লেখকের ভূমিকাসহ প্রকাশিত, কার লেখা?
জীবনানন্দের হলে সেটা মান্নান সৈয়দের শ্রেষ্ঠ গল্পে কেন? নাকি ভূমিকাসহ পুরোটাই গল্প। সে দ্বিধা রয়ে গেল মনে। অবশ্য 'নারী হৃদয় প্রেম গৃহ অর্থ কীর্তি স্বচ্ছলতা' শিরোনামের গল্পটি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর আগেরদিন ও ঐদিনের ঘটনা নিয়ে লেখা। ব্যক্তি জীবনানন্দকে জানা যায় এখানে।
সংকলনের শেষ গল্প 'বিদ্যা-সুন্দর কাহিনী' লেখা ২০০৬ সালে। ২০০০ পরবর্তী সময়ে সামাজিক প্রেক্ষাপট ও সম্পর্ক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে এ গল্পের ধাঁচ একটি দ্রুত গতির। আর এ কারণেই আব্দুল মান্নান সৈয়দের বাকী গল্পগুলো যেমন ধীর বাতাসের মতো পরশ দেয়, 'বিদ্যা-সুন্দর কাহিনী'তে সমকালের স্থান-পাত্র-দৃশ্য এসে সে শক্তিকে দূর্বল করে দেয়।
উপরে উল্লেখিত প্রথম ১০টি গল্পের ধারা এক।
সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ মানুষের গল্প। গল্পগুলোর বেশিরভাগ নায়ক পেশায় শিক্ষকতা, নাইট কলেজে পড়ায়। একা একা থাকে। সীমিত সামাজিক পরিধি। অন্ততঃ দুটি গল্পে প্রশ্ন জেগেছে - বিবাহ-আর-মৃত্যু ছাড়া আত্মীয় স্বজনদের মাঝে দেখা হয় কখন?
এ শেষ প্রশ্নটি মাথায় রেখে মান্নান সৈয়দের গল্পগুলো আবার পড়লে বা আগামীতে নতুন গল্প পড়লে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে বলে আশা রাখছি।
কখনো সংবাদপত্রের সাময়িকী পাতায় তাঁর লেখা চোখে পড়েছে বলেও মনে পড়ছে না। 'সত্যের মতো বদমাশ' নামে বইয়ের লেখক তিনি - এটুকুই মাথায় ছিল।
এ সপ্তাহে আব্দুল মান্নান সৈয়দের ১৫টি গল্প পড়লাম - বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত 'শ্রেষ্ঠ গল্প' মলাটে।
পড়েই আফসোস হলো - এতো দেরী করে পড়লাম কেন!
পাঠ অভিজ্ঞতার শুরুটা অবশ্য আরামের ছিল না। 'মাতৃহননের নান্দিপাঠ' পড়ে মনে হলো - অনেক গভীর বিষয়ের গল্প, জানি না সহজ না কঠিন করে লেখা - তবে শেষ বিচারে উচ্চমার্গেরই থেকে যায়। পাঠকের একনিষ্ঠ মনোযোগ দাবী করে এ গল্প। নয়তো - খেই হারানোর সম্ভবনা আছে প্রতি অনুচ্ছেদে।
চমকালাম দ্বিতীয় গল্প পড়ে। চাবি।
গল্পের নায়ক চাবি হারিয়ে যখন প্রতিবেশীদের দরজায় কড়া নাড়েন প্রতিটা ঘরেই দেখা হয় ভিন্ন ধরণের মানুষের। তাদের আচরণ, তাদের প্রতিক্রিয়া - এসবই নাগরিক বাস্তবতা। গল্পের নায়কের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। চাবি আর পাওয়া হয়নি। রূপকার্থে ব্যবহৃত চাবি আসলেই কি পাওয়া যায় জীবনে? যেমন করে পথ খুঁজে পায়নি 'রাস্তা' গল্পের নায়ক।
'গল্প ১৯৬৪', 'মাছ' আর 'জলপরী' পরের তিনটি অসাধারণ গল্প।
গল্প ১৯৬৪ বলার কৌশলে চমক আছে, শুরুতে বোঝাই যাইনি এ গল্প কবীরের। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় সংখ্যালঘু বন্ধুর বোনকে আশ্রয় দেয়ার মাঝেও আপাতঃ সচেতন তরুণের ভেতরের পশু জেগে ওঠে। প্রকাশ পায় অপরাধবোধ। কিন্তু, একেবারে শেষ লাইনে - গরমের সময় সাপ বেরোয় - বলার প্রয়োজন ছিল কিনা সেটা নিয়ে ভাবলাম অনেকবার। কখনো মনে হয়েছে শেষ ভাবনার দায় পাঠকের কাঁধে দেয়া যেতো, আবার মনে হয়েছে - কবীরের অনুতাপ বোঝাতে বা আত্মপক্ষ সমর্থনে এর দরকার ছিল।
চাবি আর মাছ - গল্প দুটোর মাঝে কোথায় যেন একটা সুক্ষ্ম মিল আছে। আত্ম অনুসন্ধান কিংবা আত্মমুক্তির ছায়া আছে দুটো গল্পেই। মাছ এর চেয়ে জলপরী আরেকটু সরলরৈখিক গল্প। তবে শেষে পানিতে ডুব দিয়ে শম্পাদের দরজার কড়া নাড়ার কৌশলটিই গল্পের কারিশমা।
অস্তিত্ব অন্যত্র গল্পটির শরীর কাঠামো একটু অন্যরকম। দাদার মৃত্যুর পর নাতির স্মৃতিচারণের ক্রমানুসারিক বিবরণ। অতীত থেকে বর্তমান আবার অতীতে যাওয়ার লাফ। লাফের মাঝখানেই মানুষের নিঃসঙ্গতার করুণ প্রলাপ।
আম্রকাননে, রাজা, অমরত্বের জন্য মৃত্যু - গল্প তিনটিকে এক শ্রেণীতে রাখা যায়। পৌরাণিক বা রূপকথার গল্প বলে মনে হয় - কিন্তু বর্তমানের সাথে যেনো মিলে যায় অনেক কিছু।
আরো বর্তমানের গল্প, যদিও ১৯৮৯ সালে রচিত, আবদুল হাফিজঃ জীবন ও সাহিত্য। সাহিত্য চর্চায় দলাদলি, এবং বণিকের সাহিত্য মাঠ দখলের যে কুশ্রী বাণিজ্য আমরা দেখি - তার চমৎকার বিবরণ আছে এ গল্পে। গল্পটি যেখানে শেষ, যেনো সেখানেই শুরু আরেক গল্প 'হোসেন মিয়ার সঙ্গে' - অন্ততঃ শুরুতে এমনটিই মনে হয় - লেখার উপকরণ সংগ্রহে লেখকের গণিকালয়ে যাওয়ার মিলের কারণে।
অতীতকে বর্তমানে আনার গল্প 'হোসেন মিয়ার সঙ্গে'। পদ্মানদীর মাঝির চরিত্ররা নতুনভাবে জেগে উঠেছে গল্পে, যেখানে নায়ক স্বয়ং মানিক বন্দোপাধ্যায়। কালক্রমে অনেক কিছু বদলালেও, হোসেন মিয়া কি আর পাল্টালো?
জানলাম, আব্দুল মান্নান সৈয়দ একজন জীবনানন্দ গবেষক।
জীবনানন্দ নামের একটি সাহিত্য পত্রিকাও তিনি সম্পাদনা করতেন। জীবনানন্দ বিষয়ে দুটো গল্প আছে এ বইতে।
'জীবনানন্দ দাশের একটি অপ্রকাশিত গল্প্', ব্র্যাকেটে লেখকের ভূমিকাসহ প্রকাশিত, কার লেখা?
জীবনানন্দের হলে সেটা মান্নান সৈয়দের শ্রেষ্ঠ গল্পে কেন? নাকি ভূমিকাসহ পুরোটাই গল্প। সে দ্বিধা রয়ে গেল মনে। অবশ্য 'নারী হৃদয় প্রেম গৃহ অর্থ কীর্তি স্বচ্ছলতা' শিরোনামের গল্পটি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর আগেরদিন ও ঐদিনের ঘটনা নিয়ে লেখা। ব্যক্তি জীবনানন্দকে জানা যায় এখানে।
সংকলনের শেষ গল্প 'বিদ্যা-সুন্দর কাহিনী' লেখা ২০০৬ সালে। ২০০০ পরবর্তী সময়ে সামাজিক প্রেক্ষাপট ও সম্পর্ক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে এ গল্পের ধাঁচ একটি দ্রুত গতির। আর এ কারণেই আব্দুল মান্নান সৈয়দের বাকী গল্পগুলো যেমন ধীর বাতাসের মতো পরশ দেয়, 'বিদ্যা-সুন্দর কাহিনী'তে সমকালের স্থান-পাত্র-দৃশ্য এসে সে শক্তিকে দূর্বল করে দেয়।
উপরে উল্লেখিত প্রথম ১০টি গল্পের ধারা এক।
সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ মানুষের গল্প। গল্পগুলোর বেশিরভাগ নায়ক পেশায় শিক্ষকতা, নাইট কলেজে পড়ায়। একা একা থাকে। সীমিত সামাজিক পরিধি। অন্ততঃ দুটি গল্পে প্রশ্ন জেগেছে - বিবাহ-আর-মৃত্যু ছাড়া আত্মীয় স্বজনদের মাঝে দেখা হয় কখন?
এ শেষ প্রশ্নটি মাথায় রেখে মান্নান সৈয়দের গল্পগুলো আবার পড়লে বা আগামীতে নতুন গল্প পড়লে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে বলে আশা রাখছি।
0 মন্তব্য::
Post a Comment