'সিঁড়ি' পাঠ : শিশুদের সাহিত্য
বছর পাঁচেক আগে মফস্বলের এক উঠতি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের বার্ষিক স্মরণিকা হাতে পেয়েছিলাম। এলাকার গণ্যমান্যদের কঠিন ভাষার বাণী, পাতা ভর্তি বিজ্ঞাপন, অজস্রবার শোনা কৌতুকের মাঝে একটি লেখা পড়ে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলাম। কেজি ওয়ানের এক ছাত্রের লেখা গল্প:
এটুকুই বিবরণ। শিশু মনের কী চমৎকার বর্ণনা। স্কুল থেকে এসে মা'য়ের দেখা নেই। ছোট ভাইকে নিয়ে মামার সাথে নানুর বাড়ী গেছে শোনে আরও মন খারাপ। রাস্তায় দৌড়ে গিয়ে মা'কে না দেখা। আবার ঘরে ফিরতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে আঘাত পাওয়া এবং কান্নার মাঝে মা'কে পাওয়ার আনন্দ নিয়ে প্রাণবন্ত একটি লেখা!
কেনো জানি মনে হয় - শিশুদের খুব বেশী বেশী নৈতিকতা শেখানো কিংবা স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা থাকে পাঠাভ্যাসেও। সে কারণেই হয়তো শিশুদের লেখনীতে উঠে আসে -
সত্য কথা বলবো
ভালো কাজ করবো,
বেহেশতে যাবো
মজার ফল খাবো।
কিংবা
গাড়ী ঘোড়া কিনবে
সব লোকে চিনবে
চোখে দিবে চশমা
চলে যাবে বার্মা।
কচি হাতের গল্পও মিথ্যাবাদী রাখালের চক্কর থেকে বের হতে পারে না। লোভে পাপ পাপে মৃত্যুর গল্পে নতুন ঢঙে লোভী লোকটি সেভেন আপ মনে করে কেরোসিনের বোতল মুখে ঢেলে দেয় ঢকঢক করে।
দৈনিক পত্রিকার শিশুদের পাতার সম্পাদকও ছড়ার ছন্দ-তাল নিয়ে কঠিন থাকেন। তাই তোমাদের চিঠি পেলাম বিভাগে ভাইয়্যা সুন্দর করে বলে দেন - "'বই'এর সাথে 'নেই' ছন্দ মিলেনি। আবারও লেখা পাঠাও। আগামীতে অবশ্যই ছাপা হবে।"
এসব ধরাবাধা নিয়ম কানুনে শিশুরা কতোটুকু স্বত:স্ফুর্ত হয়ে লিখতে পারে জানি না। তবে এবার বাংলাদেশ থিয়েটার অব অ্যারিজোনার প্রকাশনে 'সিঁড়ি' পড়তে গিয়ে শিশুদের চমৎকার কিছু লেখা পড়ে আবার মুগ্ধ হয়েছি।
আট বছর বয়েসী ফারহান রাহমান লিখেছে:
এক ছিল রানী
ভালো লাগে তার
অনেক ঠান্ডা পানি।
আবার একই বলয়ে বেড়ে ওঠা সাত বছরের ফাতমা আবিদের ছড়া:
সে খায় অনেক পানি
সে অনেক পচা
সেটা আমি জানি।
আরেকটু বড়, দশ বছরের শাইরা আহমেদ লিখেছে - মোটা মামা:
নাম হলো তার গামা।
পরেন বিরাট জামা
এবার খাওয়া থামা।
তবে শাদীদ আহমেদের সাদামাটা কথা শিশুসুলভ ভাবনায় প্রকাশ পায় এভাবে:
সব সময় থাকে রোজা
তার নাই ক্ষুধা
জীবন খুব সোজা।
ভালো লেগেছে আফরা নাওয়ারের আমার আছে বাড়ি ছড়াটি :
বাড়ির মধ্যে গাড়ী
গাড়ীর মধ্যে আমি
আমি পড়েছি শাড়ী।
বাড়ি গাড়ী শাড়ী
নিয়ে কাড়াকাড়ি।
কে চালাবে গাড়ী
কে পড়বে শাড়ী
কে নেবে বাড়ি
আমি কি বলতে পারি?
নয় বছর বয়েসী শাবাব সিদ্দিকের লেখাটি আরও সহজ:
তাই লিখতে চাই না।
যখন বৃষ্টি দেখি
তখন কবিতা লিখি।
শাদিদ আহমেদের এ গল্পটিতে কল্পনার দূর্দান্ত মিশ্রণ:
পানির নিচে ছাগলের বাস। মাঠের সাথে তার বন্ধুত্ব! শেষে বই খেয়ে ছাগলের মৃত্যু!! পাগলে কিনা বলে ছাগলে কিনা খায় প্রবাদটি কি শাদিদ জানে?
শেষে বলি তালহা আবিদের ছড়াটি:
পাইনা কোন স্বাদ।
আমি খাইনা পানি
সেটা খারাপ জানি।
আমি খাই অনেক খিচুড়ী
আমার আছে ছোট ভূঁড়ি।
স্বপ্নে দেখি আবার
খাচ্ছি আমি খাবার।
সাহিত্যের অনেক প্রাজ্ঞজন হয়তো ভ্রু কুঁচকে অনায়াসে এ লেখাগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দিবেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে ভিনদেশে বেড়ে ওঠা এ শিশুদল ভীষণ প্রতিভার অধিকারী। মুক্ত ভাবনায় লেখালেখির সুযোগ পেলে এদেরই কেউ কেউ সহজেই তুচ্ছ করে দিবে অনেক তথাকথিত শিশু সাহিত্যিককে।
শেষে সুন্দর একটি প্রকাশনার জন্য 'সিঁড়ি' সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ।
.
.
.
0 মন্তব্য::
Post a Comment