নিরবধি পথ ছোঁয়ার শিল্পী; সঞ্জীব চৌধুরী
আমি তখন নচিকেতা-অঞ্জন-সুমনের গানের পাগল। দশ নম্বর গোল চক্করের চৌধুরী উদ্দোগে বলা ছিল - নচিকেতার নতুন অ্যালবাম আসলেই যেন আমাকে জানায়। মাঝে চিটাগাং গিয়ে হাতে পেলাম, দলছুটের অ্যালবাম - 'আহ!'। 'সাদা ময়লা রঙীলা পালে আউলা বাতাস খেলে' নাকি বিটিভির ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান শুভেচ্ছায় প্রচারিত হয়ে বেশ লোকপ্রিয় হয়েছে ইতোমধ্যে। নতুন শিল্পীর গান প্রথমে শুনলে ভালো লাগে না, বারবার শুনতে হয়, কান পেরিয়ে মনে লাগতে সময় লাগে। অথচ, দলছুটের গান নিমিষেই মনে ধরে গেলো।
ক্যাসেট প্লেয়ারে বারবার এপিঠ ওপিঠ করে 'আহ!' শুনি। প্রয়াত বন্ধু শুভ্রর করা প্রথম গানের হামিংটা গুনগুন করি সারাদিন। এরপর অন্যান্য গান, একটার চেয়ে একটা প্রিয় হয়ে ওঠে। প্রায়ই নিজের অজান্তে বলে উঠি - ঐ অন্ধের চোখে কেনো সানগ্লাস? কিনে ফেলেছো কি স্বর্গের সিঁড়ি? কিংবা আমার মনেতে নাই সুখ, চোখের মধ্যে বসত করে অন্য লোকের চোখ। কিছু ভালোলাগা যেমন উড়িয়ে নেয় না, উথাল-পাথাল করে না, বরং - নরম এক আবেশে জড়িয়ে রাখে অনেকক্ষণ, অনেক দিন। সেরকম 'আহ!' অ্যালবামের গানগুলো আমার প্রিয় হয়ে থাকে।
আরও পরে, হয়তো বছর দু'য়েক পরে - ফ্র্যাগমেন্টেড বাক্যের উদাহরণে আশিক বলছিলো - গাড়ী চলে না, চলে না চলে না রে। এটা সম্ভবত: বিটিভি'র ইত্যাদিতে প্রচারিত হয়ে শ্রোতাপ্রিয়। তখন কী যেন ক্যামন একটা সময় ছিল, তাই 'হৃদয়পুর' কিনতে দেরী হয়। চলতি পথে কোথাও 'মেয়ে তুমি এভাবে তাকালে কেনো, এমন মেয়ে কিভাবে বানালে ঈশ্বর' যে হৃদয়পুরের গান সেটাও বোঝতে দেরী হয়। এবার মনে হয় 'আহ!'র স্পর্শ ছাড়িয়ে যায় 'হৃদয়পুর'। আমি তোমাকে বলে দেবো, কী যে একা দীর্ঘ রাত আমি কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়, ছুঁয়ে কান্নার রং ছুঁয়ে জোছনার ছায়া! ভেবেছিলাম, বায়সিক অনুসঙ্গে এ মুগ্ধতা; কিন্তু এখন অনুভব করি - স্পর্শের ক্ষমতা যার আছে, সে গানের সময় কোনো ব্যাপার না - এখনও ঠিক একই রকমভাবে শিহরিত হই।
তারপর দুম করে এক বৈশাখে পাই - 'আকাশচুরি'। পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে সঞ্জীব-বাপ্পা বলছিলেন - বেশ এক্সপেরিমেন্ট আছে অ্যালবামে। আমি গানের তাল-মাত্রা বুঝি না। কথা ভালো লাগলে, সুর ভালো লাগলে চোখ বুঁজে শুনি বারবার। আকাশচুরি শুনে মনে হলো, আসলেই এক্সপেরিমেন্ট আছে। বাপ্পার 'জ্বরের ঘোরে ভালো থাকি, দেখতে আসো কেমন আছি, রাখো হাত কপালটায়, পুড়ে যাওয়ার কিছু থাকে না বাকী' যেমন ছেলেমানুষী মনে জ্বর প্রত্যাশী করে, তেমনি সঞ্জীবের 'আগুনের কথা বন্ধুকে বলি' দগদগে ক্ষত তৈরি করে, আমাকে নষ্ট শহরের নষ্ট ছেলে করে দেয়। ফরহাদ মজহারের লেখা এ গানে কোথায় যেনো আমি আমাকে খুঁজে পাই। দীর্ঘদিন যাবত আমার এমএসএনে নিক ছিলো - 'নষ্ট শহরের নষ্ট ছেলে'।
এরপর ২০০৩এর ডিসেম্বরে 'স্বপ্নবাজি' নিয়ে হাজির হন সঞ্জীব। এক পলকে চলে গেলো, আহ কি যে তার মুখখানা রিক্সা কেনো আস্তে চলে না? স্বপ্নবাজি খুব বেশী প্রভাব ফেলেনি, কারণ ব্যক্তিগত স্বপ্নময়তা কিংবা বাজির দরে তখন আমি ক্লান্ত, ম্যাটাডোরের লাল ষাঁড়। লাল কাপড়ের পেছনে দৌঁড়াতে দৌড়াতে থাইল্যান্ড এসে যখন থামলাম, তারও পরে দেশে যাবার সময় স্বপ্নবাজি ব্যাকুল করে দিলো। সেটা পরে বলছি।
একটা সময় ছিল বন্ধুসভার জন্য অপেক্ষা, বুধবার। ২০০১এ বন্ধুসভা 'মহানির্বাচন' আয়োজন করে সেরা লেখক বন্ধু ঠিক করলো। আমি বরাবরের মতোই পাঠক, অনুষ্ঠানেও গেলাম দর্শক হিসাবে একা। অনুষ্ঠানে নাম জানা অনেক লেখক-বন্ধুকে দেখলাম। দেশের দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাঠক পাতার প্রথম সম্পাদক হিসেবে আজীবন সম্মাননা দেয়া হলো সঞ্জীব চৌধুরীকে। চেয়ারে বসেছিলেন অনেকটা রাজার ভঙ্গিতে, মাথা উঁচু করে। শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাইলেন। গাড়ী চলে না দিয়ে নাচিয়ে গেলেন। দলছুটের গান শোনার সুযোগ আসে আরেকবার পরের বছর আর্মী স্টেডিয়ামে। কোনো এক অসুস্থ শিশুকে সাহায্য করতে অন্তর শো বিজের আয়োজন। অঞ্জন-নচিকেতা-দলছুট-আজম খান-ওয়ারফেজ। আগ্রহটা বেশী ছিল অঞ্জন দত্ত আর নচিকেতার জন্য। বিশাল লাইন পেরিয়ে যখন আর্মী স্টেডিয়ামে ঢুকি তখন মঞ্চে দলছুট। প্রথম বারের মতো শুনলাম - তুমি আমার বায়ান্ন তাস। পরে রেডিও মেট্রোওয়েভে শুনলেও ঐ কনসার্টের স্টাইলটা মনে গেঁথে আছে। তুলনামূলক ধীর গতির সুরটাও।
স্বপ্নবাজির কথা বলছিলাম। দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি ও যাওয়া আমার কাছে বিশাল এক আনন্দের ব্যাপার। ছুটির আবেদন, প্লেনের টিকিট, বাসের টিকিট, বিমান বাংলাদেশ ৬/৭ ঘন্টা ডিলে হয়ে এয়ারপোর্টে অপেক্ষা এসবই আনন্দের, ভীষণ আনন্দের। গত বছর জানুয়ারীতে দেশে যাবো। যাওয়ার আগের রাতে আমার ঘুম হয় না। খানিকটা এক্সাইটমেন্ট কাজ করে। আবার মনে হয় ঘুমালে আমি অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে যাবো। এখানে আমাকে ডাকার কেউ নেই, ফ্লাইট মিস হবে! তাই রাত জেগে গান শুনি। আচমকা সঞ্জীবের 'যাই পেরিয়ে এই যে সবুজ বন, যাই পেরিয়ে ব্যস্ত নদী অশ্রু আয়োজন' নতুনভাবে মুগ্ধতা জাগায়। বাকী রাত এ গান শুনে কাটিয়ে দিই। হেমন্তের 'পথের ক্লান্তি ভুলে' ছাড়া এমন বাড়ী ফেরার গান আর শুনিনি। আর কোনো গান এমন করে আমাকে ঘরে ফেরার জন্য ব্যাকুল করতে পারেনি।
দলছুটের সঞ্জীব চৌধুরীর অনেক পরিচয়। পত্রিকায় দেখলাম ছাত্রজীবনে তুমুল তুখোড় ছিলেন, রাজনীতি করেছেন, কবিতা গানে অদম্য। এটিএনে এক ধারাবাহিক নাটকে (?সুখের লাগিয়া?) অভিনয়ও করেছেন। পরিচয়ে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, তারুণ্যের প্রাধান্য দিতেন। গতকাল থেকে মনে পড়ছে আলী মাহমেদ শুভ'র একটা কথা। 'একালের রূপকথা' বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন - সঞ্জীব চৌধুরী লেখক বানাবার মেশিন।
দিনলিপি লিখতে ভালো লাগে না। খালি মন খারাপের কথা আসে। পরশু শনিবার মরার মতো ঘুমিয়েছি। সন্ধ্যায় কানে আইপড চাপিয়ে চিরচেনা নোরা রেস্টুরেন্টে খেতে বসি। রাস্তার পাশে খোলা আয়োজন। 'তোমার ভাঁজ খুলো আনন্দ দেখাও করি প্রেমে তরজমা' - অকারণ ভালো লাগা আনে। এমনটি আনে প্রায়ই সুবীর নন্দী, শাহনাজ রহমতউল্লাহ কিংবা নিয়াজ মোহম্মদ চৌধুরী। অধুনা শিরিন, হাবীব, শান্তারাও ভর করে। বাসায় ফিরে শুঁড়িখানা ব্লগে দেখি সঞ্জীব চৌধুরী অসুস্থ! এরপর নানা আপডেট। অনেকের মতো আমিও মিরাকলের আশায় থাকি। এখনো 'জোছনা বিহার' শোনা হয়নি। তৃষ্ণা মেটেনি। সঞ্জীবের গান আরও চাই, সঞ্জীবকে চাই। নানা গুজবও রটে সংবাদ অসংবাদের। পড়তে ইচ্ছে করে না। একজন মানুষ, প্রিয় শিল্পী এরকম করে কেনো চলে যাবে?
--- শেষে চলে যায়। কেনো যায়? এ প্রশ্নের জবাব আমি জানি না, ঈশ্বরের নিষ্ঠুরতায় নীরব হয়ে থাকি। সঞ্জীব চৌধুরী চলে গেছেন, যেখানেই যাক - ভালো থাকুক। তাঁর গানগুলো থাকুক আগামীর দিনগুলোয়, আমাদের মাঝে কালজয়ী হয়ে।
.
.
.
6 মন্তব্য::
এখনো বুঝে উঠতে পারছি না,বিশ্বাসও হচ্ছে না!
ঘুম আসছিলো না, মাঝরাতে বিছানা থেকে উঠে বসে আছি। তখন এই লেখাটা পড়লাম...ঠিক এমনি করে সবগুলো স্মৃতি মনে পড়ে গেলো...প্রথম "সাদা-ময়লা" শোনা, "হৃদয়পুর"র "আমি তোমাকেই বলে দেব", "আমার সন্তান সে তো তোমার কাছ থেকে পাওয়া" পুরো পাগল করে দিয়েছিলো। তারপর "আকাশচুরি"র অনেকগুলো গান। "স্বপ্নবাজি"র খবর কেন যেন সময়মত পাই নি আমি... আর্মি স্টেডিয়ামের সেই কনসার্টে আমিও ছিলাম। ওটা বোধহয় দলছুট'র প্রথম ওপেন এয়ার কনসার্ট ছিলো। বাপ্পা অনেক নার্ভাস ছিলো, জমছিলো না...সঞ্জীব দাঁড়িয়ে হাল ধরলেন "গাড়ী চলে না" দিয়ে...এবার দেশে গিয়ে খুব কাকতালীয়ভাবে খুব কাছে থেকে দেখা হলো, কথা হলো...তার ছোট্ট মিষ্টি চঞ্চল বাচ্চা মেয়েটা, ততোধিক চঞ্চল তার বৌ...
...আপনার লেখায় কি নিয়তির কিছু ছিলো? বুঝছি না...কেমন যেন শক্ত মনে হচ্ছে নিজেকে এই রাত্তির বেলা...নিয়তিই বুঝি মেনে নিলাম।
কিচ্ছু ভালো লাগছে না। এমন একজন মানুষ এরকম আচমকা চলে যাবেন? কেনো? সারাদিন দলছুটের গান শুনেছি আজ। মানুষটার ছবির দিকে তাকালেই চোখ ভিজে যাচ্ছে।
পড়লাম।
পাখি অন্য ঘোরে,
গান গায় অন্য সুরে।
এ ঘর অন্ধকার,
তারার আলো কোন ঘরে?
ঘরে ফিরবো না,
ঘরের ফেরার কিছু নেই।
রাখব না ধরে আর,
ধরে রাখার কিছু নেই।
--
অদ্ভুত সব গান সঞ্জীবদার।
ঢাকায় অনেক রাত এখন। তবু ক্রমাগত শুনছি।
”সঞ্জীব চৌধুরী লেখক বানাবার মেশিন।“
শিমুল,
আজও আমার মত তাই...আমাদের দেশে এমন মেশিনের বড্ডো আকাল!
এই মানুষটা চলে যাওয়ায় স্বার্থপরের মত বারবার এটাই বলতে ইচ্ছা করছে:
আফসোস মানুষ, এভাবে চলে যেতে নেই- এ অন্যায়!
Post a Comment