বস্ত্রবালিকা ও অন্যান্য
রবিউল যখন খবরটা দিলো তখনো বিশ্বাস হয়নি। ফালানির মা ভুরু কুঁচকে বলেছিল - ধুররো মফিজ, তোর মাথা খারাপ হই গেছে? কিন্তু গতকাল ফ্যাক্টরিতে সবাই যখন বিষয়টা আলাপ করছিল তখন বিশ্বাস জন্মায় আস্তে আস্তে। শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা, কাটিং মাস্টার জুলফিকার শার্টের পকেট থেকে খবরের কাগজটা বের করে যখন জোরে জোরে পড়ে শোনায় আশেপাশের চোখগুলো তখন জ্বলজ্বল করে উঠে। কেউ একজন বলে উঠে - আরে বুঝোনা, এগুলান হইলো ভোটের কেরামতি। সাথের জন গলা খাকারি দেয় - ভোট হউক, যা-ই হোক মিয়ারা; বেতন বাড়বো - ঐটাই বড় কথা। জুলফিকার এবার আওয়াজ দেয় - ওই থাম তোরা। এই বাড়ায় লাভ আছে? জিনিসপত্রের যে-ই দাম, সংসার চলে? তিন হাজার না করলে আবার আগুন জ্বলবো কইলাম, রেডি থাইকো সবাই। দূরে দাড়িয়ে কথাগুলো শুনছিলো ফালানির মা।
সেদিন বিকাল থেকে ফালানির মা মনে মনে কী যেন একটা হিসাব করে। ঠিক একটা হিসাব না, অনেকগুলো হিসাব এসে আশেপাশে ঘর-বসতি করে। তবে মাঝে মাঝে সন্দেহও জাগে। হঠাত কী এমন হইলো যে নয়শো তিরিশ থেকে ষোলশ’ চার টাকা হইবো? ক’দিন আগে যে গন্ডগোল হইছে তার বদলে বড় জোর হাজার-বারোশ’ হইতে পারতো। কিন্তু ষোলশ’ চার টাকার ব্যাপারটা খটকা লাগে। চার টাকা আবার কোন হিসাব? রবিউল অবশ্য এই কথাও বলছিল যে - এইটা একুশ শ’ সতের টাকা পঁঞ্চাশ পয়সা হইবো দুই বছর পর। আবারো সতের টাকা পঁঞ্চাশ পয়সার পঁ্যাচ!
এ সব পঁ্যাচ-গোচ পেরিয়ে ফালানির মা কি জানি কি ভাবে আর গোপনে মনের ভেতর একটা সুখের স্বপন জাগে। ফালানিও এমকে অ্যাপারালসে কাজ করে। দুইজনের যদি মোট চৌদ্দশ’ও বাড়ে - কম কি? ফালানির বাপের হাঁফানির অসুদটা এইবার রেগুলার কেনা যাবে, মাসে একদিন ভালো মন্দ খাওয়া যাবে, খোলা তেলের বদলে টিভি-তে দেখায় ওরকম একটা সুগন্ধি তেলের বোতল কেনা যেতে পারে, ফেয়ার এন্ড লাভলি ইন্ডিয়ানটার দাম বাংলাদেশীটার চেয়ে দশ টাকা বেশি - এইবার ফালানি ইন্ডিয়ানটাই কিনুক ! আহারে, এই বয়সের মেয়েদের কত শখ থাকে! ফালানির বিয়ের জন্য মাসপ্রতি শ’দুয়েক করে টাকা জমানোও দরকার। ছোট বাচ্চা দুইটারে শাহ আলী মার্কেট থেকে দুইটা ভালো হাফ প্যান্ট কিনে দিতে হবে। ওদের ন্যাংটা থাকার দিন বোধ হয় ফুরালো। ... এসব ভাবতে ভাবতে মুখটা শুকিয়ে যায়। বেতন বাড়লে হাকিমপুরী জর্দাটা মনে হয় সব সময় কেনা যাবে।
পাড়ার মোড়ের দোকানে পান কিনতে গিয়ে রইসুদ্দি-র কথা শুনে ফালানির মা চমকে যায়।
- হ চাচী, খবর পাইছি আমরা। আর কি কও? তোমাগো অহন সুদিন। সরকার তো বেতন বাড়াই দিলো।
- কী কস রইসু? এখনো বাড়ায় নাই। ঐসব খবর বাতাসের কানাকানি।
- না চাচী, ডরাইও না। মিষ্টি খাইবার চামু না। তয় - এইবার কইলাম আর বাকী দিবার পারুম না।
পান মুখে দিয়ে আঙুলের আগায় লাগানো চুনটা দাঁতে লাগিয়ে যখন ঘরে ফিরছিল তখন দেখা বাড়িঅলা আকবর মহাজনের সাথে। ফালানির মাকে দেখে এগিয়ে আসে।
- দেখা হয়ে ভালোই হইলো, শুনো - তিন বছর ভাড়া বাড়াই নাই। শুনলাম তোমাগো বেতন বাড়ছে, সামনের মাস থেইক্যা তিনশ টাকা বাড়াই দিবা।
- ম’জন, বেতন তো এখনো বাড়ে নাই। খালি পেপারে কি জানি লিখছে...
- আরে পেপার না, আইজকা টেলিভিশনেও খবরে শুনলাম। ...যাউক, আর কথা বাড়াইও না। আগামী মাস-থন তিনশ টাকা বেশি দিবা...।
পরদিন সকালে বড় স্যারদের সাথে গার্মেন্টসের জমিদার স্যাররা আসে। কাজ থামিয়ে সবাইকে জমায়েত করে। এক স্যার পাঞ্জাবীর হাতাটা গুটিয়ে জুলফিকারের মাথায় হাত রাখে
- আমরা হইলাম ছোট ফ্যাক্টরীর মানুষ। তোমরা জানো আমরা সাব-কনট্রাক্টে কাজ করি। কারেন্ট না থাকলে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রডাকশন বন্ধ থাকে। হরতালের কারণে অর্ডার ক্যানসেল হইলে লাখ লাখ টাকা লস যায়। ...আমি তোমাদের সব সময় আমার ঘরের মানুষের মতো করে দেখেছি। সুখে দুঃখে তোমরা আমাদের সাথে ছিলা, আমিও ছিলাম। আগামীতেও থাকার চেষ্টা করবো। ক’দিন আগে বেতন বাড়ানোর একটা গুজব বাইর হইছে। আমার বিশ্বাস - তোমরা কেউ ঐসবে কান দিবা না। আমি কথা দিলাম - এখন থেকে প্রতি মাসে টাইমলি বেতন পাইবা সবাই। আর ঈদের বোনাসও কইলাম, খোদার কসম, ঈদের এক সপ্তাহ আগে দিয়া দিমু। এখন সবাই কাজে যাও। ...সব কাজকর্ম ঠিক মতো চলবো।
দ্রুত গতিতে বোতাম সেলাই করতে গিয়ে বারবার মন ছুটে যায় ফালানির মার। এই নিয়ে তিনবার আঙুলে সুঁচ লাগলো। পাশ থেকে কে যেন বলে উঠে - দেইখো, দেইখো - আল্লার গজব পড়বো...।
১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৬
0 মন্তব্য::
Post a Comment