গল্পটির নাম ‘মৃত্যুর তারিখসমূহ জেনে যাওয়ার পর’।
শুরুতে ভেবেছিলাম, এ গল্প লেখা খুব কঠিন হবে না। ক্রমাগত মাথার ভেতর যন্ত্রণা করে গেলে, একটা দৃশ্যের পর আরেকটা দৃশ্য, ঘটনা এবং সংলাপ ফিরে এলে দ্রুত গল্প সাজানো যায়। আমি হয়তো কনরয় স্টপেজে বাসের জন্য অপেক্ষা করছি – তখন গল্পের একটা মোড় আসে। অথবা ট্রেন শেপার্ড স্টেশনে পৌঁছে গেছে – আমাকে নামতে হবে, তখন আবার গল্পের প্রথম অংশকে মাঝে এনে শুরুটা অন্যভাবে করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু শুরুটা পালটে দিলে শেষটায় কী হবে, এসব ভেবে ভেবে ম্যাডিসন স্কয়ারের ২৩০৬ নম্বর রুমে চলে যাই। এরপর আরো ৮ ঘন্টা একটানা কাজে পার হলে ঘরে ফিরি। এভাবেই গল্প থাকে মাথার ভেতর।
গল্পের নামটি বেশ লম্বা। তবে নামের মধ্যে একটা আহবান আছে, গল্প পাঠের প্রস্তুতি আছে। সম্ভবনা থাকে গল্পের নাম দেখেই পাঠক অনুমান করবে – কেউ একজন মৃত্যুর তারিখ জেনে গেছে এবং এরপরে কী হবে তা নিয়ে গল্প। এখানে একটু খটকা থাকে, বলা আছে ‘তারিখসমূহ’ – অর্থ্যাৎ মৃত্যুর একাধিক তারিখ জেনে গেছে। খুব সম্ভবত একদল মানুষ তাদের মৃত্যুর তারিখ জেনে গেছে। আরোগ্য সম্ভবনাহীন মানুষ যদি জেনে যায় তার মৃত্যুর তারিখ, কিন্তু তখন আর কী-ই বা করার থাকে? কতোটুকুই বা সাজানো যায় জীবন? এরচেয়ে বরং একদল সুস্থ মানুষ জেনে যাবে তাদের মৃত্যুর তারিখ, প্রথমে কেউ কেউ বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে থাকবে, কিন্তু দেখা যাবে সত্যি সত্যি মানুষ তার জেনে যাওয়া তারিখে মারা যাচ্ছে। তখন কোলাহল হবে, জীবন সাজানোর গতিময়তা বাড়বে। গল্পের ভেতরে কী হবে সেটা পরে বলছি। আগে বলি, গল্পের শুরুটি কেমন হতো।
আচ্ছা, তারও আগে বলে রাখি – যেহেতু এই লেখকের কব্জির জোর নেই, সেহেতু গল্পটি উত্তম পুরুষে বর্ণিত হবে। চিন্তার-চৌবাচ্চারা (থিংক ট্যাঙ্ক এর অনুবাদ হলো কি?) বলে থাকেন - উত্তম পুরুষে লেখা সহজ। উত্তম পুরুষের বাইরে গিয়ে লিখতে হলে নাকি কব্জির জোর লাগে। আমার কব্জিতে জোর নেই, পারলে যা আছে ঐ সামান্য জোরটুকু মোহাম্মদ আশরাফুলকে দিয়ে দিতে পারি অনায়াসে – আকাশে ভাসিয়ে দেয়া বল যেনো আরো ভেসে, আমার কব্জির জোর পেয়ে, সীমানাটুকু পার হয়।
গল্পের শুরু এভাবে –
সকালে ঘুম থেকে উঠতেই শুনি আব্বার চিল্লাচিল্লি। ড্রয়িং রুমে বসে টেলিভিশনের চ্যানেল পাল্টাচ্ছেন আর চিৎকার করে যাচ্ছেন – ‘যতো সব ফালতু অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপার’। হাতের কাছে রাখা খবরের কাগজটাও ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন। সব জায়গায় এক খবর – ‘কী সব টেস্ট ফেস্ট করে মানুষ জেনে যাচ্ছে কে কবে মরবে’। আব্বার দিকে যেতে আমার সাহস হয় না। আমি চুপেচুপে রান্নাঘরে আম্মার কাছে যাই। আম্মা একচুলায় পরোটা ভাজছেন, অন্য চুলায় ভুনা গরুর গোশত। ঘ্রাণে আমার পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। আম্মাকে বলি, ‘আব্বা, এমন চিল্লাচিল্লি করছে কেনো? সারা দুনিয়া মেনে নিলো, আব্বার কেবলই আপত্তি’।
আম্মা শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালে জমে থাকা ঘাম মোছেন। বিড়বিড় করেন, কী বলেন বোঝা যায় না। আম্মার চেহারায় তাকিয়ে অনুমান করি, আম্মা বলছেন – ‘তোর আব্বা তো সারাজীবন এরকম’।
ফ্লোরে পড়ে থাকা পেপার কুড়িয়ে আমি বাথরুমে ঢুকি।
অনেক আগে যেবার বাসায় ইন্টারনেট কানেকশন নিলাম, আব্বা এলেন আমার রুমে। আমি ইয়াহুতে নিউ ইয়র্কে থাকা কাজিনের সঙ্গে চ্যাট করছি। আব্বা এসে আমার পাশে বসলেন, দেখলেন – আমি টাইপ করছি – ha ha.
আব্বা জিজ্ঞেস করলেন – হা হা মানে কী?
বললাম, হাসছি।
শুনে তাঁর চোখ যেনো কপালে উঠে গেলো, ‘তুই তো গম্ভীর হয়ে বসে আছিস, আর টাইপ করছিস – হাসছিস কই?’
আমি আব্বাকে কী করে বোঝাই - এসব চ্যাট, এসব অনুভূতি অন্যরকম।
সেদিন কিছু না বলে চলে গেলেন। এরপর আরো অনেকদিন আমি তাঁকে বলতে শুনলাম, ফোনে অন্য কাউকে বলছেন – ‘কী আর বলবো বলেন, মুখ গম্ভীর করে টাইপ করে আর বলে হাসছি, একটা বিশাল জেনারেশন গ্যাপ, হা হা হা’।
আব্বা এরকমই। পরিবর্তন মেনে নিতে পারেন না।
আমাদের বাসায় ডিশ এন্টেনার সংযোগ নেয়ার পর আম্মা নিয়মিত খানা খাজানা দেখে, আমার ছোটো ভাই মুকুল কার্টুন নেটওয়ার্ক, আর আমি রিমোটের বাটন চেপে চেপে আমিশা প্যাটেল খুঁজি।
আব্বা কোত্থেকে শুনে এলেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে প্রকৃতির নানান আজব জিনিশ দেখায়, দূর্লভ সব নাকি ব্যাপার স্যাপার। আব্বা অফিস থেকে ফিরে টানা কয়দিন ন্যাশনাল জিওগ্রাফি দেখলেন। সপ্তাহ খানেক পরে সাত্তার মামা আমাদের বাসায় এলে আব্বা বললেন, ‘লেদা পোকা কী খায়, এইটাও মানুষের আগ্রহের বিষয়?’
পত্রিকার প্রথম পাতা – শেষ পাতা – বিশেষ সম্পাদকীয় পড়া শেষে আমি আব্বার এসব কথা ভাবছিলাম। এই যে আজ এক মাস সব মিডিয়া তুলকালাম কান্ড করে দিচ্ছে, সামান্য একটা টেস্ট করে মানুষ জেনে যাচ্ছে সম্ভাব্য মৃত্যুর তারিখ – আব্বা এটাকে বিশ্বাস তো করছেই না, বরং পুরো ব্যাপারটিকে তুচ্ছ করে মানুষের ওপর ক্ষেপে যাচ্ছে। আমিও প্রথমে আব্বার মতো অবিশ্বাস করতাম। কিন্তু, সেদিন রিন্টু যখন ভার্সিটির ক্যাফেতে এসে বললো – তার এক ফুপা বাইপাস সার্জারি করতে সিঙ্গাপুর যাবে, লাখ বিশেক টাকার মতো খরচ হবে। কিন্তু যাওয়ার আগে ঢাকায় ঐ ডেথ-টেস্ট করালো, দেখা গেলো বাঁচবেন আর ৯ দিন। এরপরও রিন্টুর ফুপাকে সিঙ্গাপুর নেয়া হলো, অপারেশনের আগের রাতে আবার স্ট্রোক করে মারা গেলেন। রেন্টু আঙুলের কড়ে গুনে গুনে দেখিয়ে দিলো রবিতে রবিতে আট আর পরের দিন সোমবার মিলিয়ে ৯ দিনই ছিলো। সোমবারে ফুপা মারা গিয়েছিলেন।
রাতে বাসায় ফিরে খাবার টেবিলে রিন্টুর ফুপার ঘটনা বলার সাহস আমি পাইনি। কারণ, এর আগেই আম্মা বলছিলেন, আমারদের বাসার তিন ব্লক পরে সাদী কাকার মামা শ্বশুর এ টেস্ট করেছিলেন, টেস্টে দেখা গেছে বাঁচবেন আর ৬ দিন। পুরোদস্তুর সুস্থ মানুষটি ঠিক ৬ দিনের মাথায় বাজার করে ফেরার পরে রিকশার ঝাঁকুনিতে রাস্তায় পড়ে গেলেন। হাসপাতালে নেয়ার পর – ডাক্তার বললো, ব্রেইন হ্যামারেজ।
আম্মার কথা আব্বা মন দিয়ে শোনলেন, আম্মাকে বললেন – ‘কাল সকালে বের হয়ে সব ক’টা টিভি চ্যানেলে যাবে, রিপোর্টারের কাজ খুঁজবে, আর কোন বাসায় কী হলো সেসব লাইভ টেলিকাস্ট করবে’।
আব্বার এরকম প্রতিক্রিয়ায় আম্মা চুপ মেরে গেলেন। আব্বা বলেই যাচ্ছেন –
‘...ঘুরে ঘুরে পশ্চিম পাইকপাড়ায় যাবে, বের করবে কার বাসার তরকারী পুড়ে গেছে। ঐটা রেকর্ড করে রাস্তায় দাঁড়াবে, বলবে – তরকারী পুড়ে পশ্চিম পাইকপাড়ার এ বাসায় এখন তীব্র গন্ধ, লতিফুন্নেসা, একুশে টেলিভিশন, পশ্চিম পাইকপাড়া’।
আম্মা চুপ, আমিও চুপ। আব্বা আর কথা না বলে - ভাত খাওয়া শেষ করলেন। রিন্টুর ফুপার ঘটনাটি তাই সে রাতে আর বলা হয়নি।
এতটুকুকে ভূমিকা হিসেবে মন্দ মনে হয় না। নাকি?
শিরোনামের চমকে পাঠক গল্পে যাবে, গিয়ে দেখবে – আজব এক ঘটনা ঘটছে, কী এক ডেথ-টেস্ট করে মানুষ মৃত্যুর তারিখ জেনে যাচ্ছে, এবং এরপর লৌকিক বা অলৌকিক যেভাবেই হোক না কেনো মানুষ ঠিক ঐ তারিখেই মারা যাচ্ছে। গল্পের কথক এবং তার মা এরকম দুটো ঘটনা জেনে গেছে। সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলেও রিপোর্ট হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে গল্পকে কীভাবে আগানো যায়?
সমস্যা দেখা দেয় দুটি।
এক – এরকম ঘটনা কি শুধু বাংলাদেশেই ঘটছে? তাহলে বাকী বিশ্বের প্রতিক্রিয়া কী? অন্য দেশে এই ডেথ-টেস্ট সফল হলে, সেখানকার বিজ্ঞানীরা কী বলছে?
দুই – এটা কী সায়েন্স ফিকশন, নাকি নিছক কল্পগল্প।
ঠিক এ জায়গায় এসে গল্পকার হিসেবে আরামদায়ক জায়গা হলো কল্পগল্পকে বেছে নেয়া। যেহেতু বাকী বিশ্বে এ ঘটনা ঘটে গেছে বলে দিলে তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ জটিল হয়ে যাবে, ঢাকা শহরের নানান চমকের জীবনে এ ঘটনা চমক পাবে না। আরো সমস্যা আমি তেমনভাবে সায়েন্স ফিকশনের পাঠক না, সুতরাং এ প্লটে গল্প আগানো আমার জন্য বেশ কঠিন। যদিও আমার ধারণা - এরকম প্লটে সায়েন্স ফিকশন হয়েছে, কিংবা হয়ে থাকার সম্ভবনাই ব্যাপক।
এখানে এসে গল্প আঁটকে যায়।
আমার কিছু অচেনা উঠতি বয়েসী বন্ধু-বান্ধবী আছে, যারা সময়ে অসময়ে আমাকে ইয়াহু মেসেঞ্জারে টোকা দেয়। কেউ কেউ তাদের রিসেন্ট ব্রেক আপ এবং তৎসংক্রান্ত ক্রাইসিসের কথা বলে। আমি শুনি, কারণ - আমি মনোযোগী শ্রোতা। তারাও এপ্রিশিয়েট করে। কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমি সংকটে পড়ে যাওয়া মানুষকে ব্যাপক সান্ত্বনা দিতে পারি,বিজনেস কেইস এনালাইসিসের মতো করে একাধিক সমাধান বলি, তারপর একটা ডিসিশন ম্যাট্রিক্স করতে বলি। বলি, “এ বয়সটা ভুল করারই বয়স, ভুল থেকে শিখে নাও, আরো বড়ো হলে পরে আর শিখতে পারবে না”। প্রায়ই দেখেছি – এ কথা এখনকার উঠতি জেনারেশন পছন্দ করে। যাবতীয় ভুল সিদ্ধান্ত তাদের মনে অপরাধবোধ জাগায়। সে প্রেক্ষিতে আমি যখন বলি – ভুল জীবনের অংশ, ভুল করা মানে জীবনের শেষ নয়; তখন তারা আমাকে পছন্দ করে। ঠিক আমাকে নয়, আমার কথাকে পছন্দ করে।
‘মৃত্যুর তারিখসমূহ জেনে যাওয়ার পর’ নামের গল্পটি যখন আঁটকে গেলো তখন আমি সারাদিন ইয়াহু মেসেঞ্জারে ঘাপটি মেরে থাকি। আমার সেই অচেনা উঠতি বয়েসী বন্ধু-বান্ধবীদের জন্য অপেক্ষা করি। নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে টোকা দেই। তাদের কেউ বিআরবি বলে যায় – আর আসে না, কারো গার্লফ্রেন্ড ম্যাঙ্গো ক্যাফেতে ওয়েইট করছে, কাউকে আম্মু বকা দিচ্ছে এতক্ষণ নেটের সামনে বসে থাকার জন্য, তাই জিটিজি। আমি মন খারাপ করি, তবুও অপেক্ষা করি। ডেথ টেস্টে মৃত্যুর তারিখ জেনে গেলে, এবং টেস্ট করা সকল সুস্থ-অসুস্থ লোক যৌক্তিক কিংবা অযৌক্তিক ব্যাখ্যায় মারা গেলে কী হতো আমাদের প্রতিক্রিয়া; ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির তাসিফ মেহমুদ, সানিডেলের মৌমিতা অথবা মোহাম্মদপুর কিংস কলেজের কেমেস্ট্রি অনার্সের ছাত্র সিরাজুল ইসলাম কী ভাবতো – কী করতো; সেসব আমার জানতে ইচ্ছে করে। আমার বরাবরই মনে হয় – তাদের সঙ্গে কথা বললে আমি গল্প আগাতে পারবো। অথচ তারা কেউ অনলাইনে আসে না। তখন রকিকে মনে পড়ে।
রকি আমার পুরনো বন্ধু। কোপেনহেগেন স্কুল অব বিজনেসে এমবিএ করছিলো সেবার।
সামারে থাইল্যান্ড গিয়েছিলো ব্রেকে।
আমি খুশি হয়েছিলাম, আমার পুরনো বন্ধুদের কেউ কেউ এখনো আমাকে মনে করে, ভিনদেশে গিয়ে ফোন করে বলে – আসো দেখা করি।
কড়া রোদের এক দুপুরে ৩০১ সুকুমভিত রোড ঠিকানা থেকে ৭ মিনিট হাঁটার দূরত্বে আমরা ম্যাকডোনাল্ডসে বসি। রকি তখন ম্যাক-ইনডেক্স নিয়ে আলাপ তোলে। জেফ জার্ভিসের ব্লগ থেকে ব্যাখ্যা দেয়। আমি গল্প শুনি, আমার ভালো লাগে। রকি আমাকে বোঝায় – গ্লোবাল সিটিজেন শব্দটি কেবল একাডেমিন পারপাসে না রেখে পারসোনাল লাইফে নিয়ে আসতে হবে, দেশের জন্য কিছু করা মানে দেশে থাকতে হবে এমন কিন্তু নয়। আমি মাথা নাড়ি। খুব আলগোছে খেয়াল করি, একদা লাজুক-নীরব আমার এ বন্ধুটি এখন সৌম্য হয়ে গেছে। অনায়াসে সে এখন ঢাকার এক কর্পোরেট অফিসে ফিরতে পারে। কিছু বিজ্ঞাপনী সংস্থার তরুণ, কিছু ওয়ান্না-বি-মডেল কিছু টেন্ডারবাজ রকির পেছন পেছন ঘুরবে। সকাল আটটা সাতান্ন মিনিটে অফিসে যাবে রকি, নয়টা দশ মিনিটে তার অফিসে মর্ণিং ব্রিফিং হবে, সেখানে বাইশ বয়েসী এক উদ্ভিন্না ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনী কথা না শুনে রকির ধারালো চিবুকে অপলক তাকিয়ে থাকবে, কিংবা দুপুরে লাঞ্চের পরে অকারণে রকির রুমের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে সে। কাঁচ ঘেরা তাপশীত-নিয়ন্ত্রিত রুমে বসে রকি এসবই দেখবে। তারপর সন্ধ্যা ছয়টা এক মিনিটে অফিসের ডেস্কটপ বন্ধ করে, নিজের ল্যাপটপ ব্যাগে ঢুকিয়ে ইন্টারকমে ডাক দেবে সেই সকালের উদাসীন এমটিকে। চারকোণা মোটা ফ্রেমের চশমা মুছতে মুছতে রকি মেয়েটির চোখে চোখ রেখে বরফ শীতল গলায় বলবে – “এন অফিস, ইজ এন অফিস, ইজ এন অফিস, বিকজ দিস ইজ এন অফিস”।
এ কথাতেই মেয়েটি বুঝে যাবে – কর্পোরেটের কেউ কেউ জুতো পা অবস্থায় মরতে চায়, কাজ করতে করতে মরতে চায়। রকি আর কথা আগাবে না। এরপর সে সন্ধ্যায় পিয়াসীতে যাবে, সেখানে কিছু ব্যাংকার, কিছু টেলিকম গুরু, কিছু অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা গোল হয়ে বসবে। রকি মন দিয়ে সব শুনবে, আবার আড় চোখে দেখে নেবে রোডস এন্ড হাইওয়েজের এক ইঞ্জিনিয়ার দূরের টেবিলে কাঁপা কাঁপা হাতে নেশা করে, আর হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে – তার বৌ ভেগে গেছে এক মেট্রিক পাশ কন্ট্রাক্টরের সাথে। রকি সব দেখবে, নেশা করবে, কিন্তু তাল হারাবে না। কারণ রাত বারোটা এক মিনিটে তাকে এটিএন বাংলার লীড নিউজে যেতে হবে, জুনিয়র চেম্বার্সের প্রতিনিধি হিসেবে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি এবং সাম্প্রতিক ব্যবসায়ের হাল হকিকত নিয়ে কথা বলবে সে। এ অনুষ্ঠানে রকি ভুলেও কোনো ইংরেজী শব্দ বলবে না, চাহিদা-যোগান-সমন্বয়-প্রান্তিক চাষী-লভ্যাংশ-বিপনন-বন্টন-ভূর্তকী-মোদ্দাকথা; এসব শব্দে বুঝিয়ে দেবে বিদেশে পড়লেও সে বাংলার মানুষ, এদেশে কর্পোরেটের মার্বেল পাথর কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলের বৈঠকী স্টেজ; সব তার জন্যই।
অথচ এসব আমার কল্পনাতেই থাকে।
বার্গার শেষ করে তখন ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস চিবুচ্ছি। রকি আমাকে চমকে দিয়ে বলে সে আর দেশে ফিরবে না। রকি জীবনের হিসেব করে ফেলেছে। আটাশে বিয়ে, তিরিশে বাবা হবে। পঞ্চাশে সন্তানের বয়েস হবে বিশ, ভার্সিটির ছাত্র। ততদিনে এখনকার সবুজ পাসপোর্টটি অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে, রকি এবং তার পরিবার হবে কল্যাণ রাষ্ট্রের নাগরিক, যেখানে রাষ্ট্র সব দায়িত্ব নেবে, যেখানে সন্তানের জন্য ডিপিএস করে সারা মাসের সঞ্চয় থেকে টাকা সরাতে হবে না। রকি তখন অনায়াসে অবসরে যেতে পারে কিংবা মারাও যেতে পারে। বেঁচে থাকলে নিদেনপক্ষে ইউএন এর কোনো অংগসংস্থার কনসাল্ট্যান্ট হয়ে বাংলাদেশে হলিডে কাটাতে যেতে পারে। রকির হিসেবে ভুল নেই। আমি তখন স্মৃতিকাতর হই, টেস্ট পেপারে দেয়া রাজশাহী মডেল কলেজের একাউন্টিং সেকেন্ড পার্টের ফাইনাল একাউন্ট যখন কেউ মেলাতে পারেনি, তার পরদিন রকিদের বাসায় গেলে সে আমাকে ব্যালকনি থেকে চিৎকার দিয়ে বলে – ‘সংরক্ষণশীলতার নিয়ম অনুযায়ী হিসাববিজ্ঞান সব সময় ক্ষতির দিক চিন্তা করে, তাই বাজারমূল্য কম থাকলেও সেটাকে আসল বিবেচনা করতে হবে’।
কোকের গ্লাসের তলানীতে আর কিছু নেই, তবুও আমি স্ট্রতে টান দিই, বাতাসের ফুরৎ ফুরৎ শব্দ হয়।
রকি জিজ্ঞেস করে – ‘তোমার প্ল্যান কী?’
আমি তখন সুকুমভিতের বুক চিড়ে যাওয়া গাড়ি দেখি, বলি – ‘তুমি কি ভুলে গেছো, কোনো পরীক্ষাতেই আমি এইম ইন লাইফ রচনা লিখিনি...’
রকি আর কথা বাড়ায়নি।
‘মৃত্যুর তারিখসমূহ জেনে যাওয়ার পর’ নামের গল্পটির জন্য আমি রকিকে খুঁজি। ডেথ-টেস্ট সত্যি হয়ে গেলে তার জীবন পরিকল্পনায় কী প্রভাব পড়তো সেটা নিয়ে জানা যেতো। ইন্টারেস্টিং কিছু পেলে রকিকে আমার গল্পের নায়ক বানিয়ে দিতাম। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেছে – গল্পের সূচনায় একজন তরুণকে দেখা যাচ্ছে, যে ভার্সিটিতে যায়, ক্যাফেতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, বাবাকে খানিক ভয়ও পায়। ঠিক এরকম একটি চরিত্রকে ধরে এই অবস্থায় গল্প সামনে আগানো দুঃসাধ্য মনে হয়। তবুও অনেকগুলো সম্ভবনা রাখি, যার একটা এরকম: ডেথ-টেস্ট সফল। মানুষ চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করছে। জানাজার নামাজ কিংবা ফিউনারেলের ইনভাইটেশন কার্ড চলে যাচ্ছে আগে। গল্প কথক তরুণটি তার দূর সম্পর্কের মামা ও ভার্সিটির শিক্ষক, যারা কিনা একই দিন মারা যাবে, তাদের কাকে শেষ বারের মতো দেখতে যাবে – তা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভোগে। শহরের প্রেমিক প্রেমিকারা এখন জেনে নিচ্ছে কে কবে মারা যাবে। কাছাকাছি সময়ে মরে যাওয়ার মানুষগুলো সম্পর্কে জড়াচ্ছে। দেশের ব্যাংকগুলো নতুন নতুন বিনিয়োগ স্কীম নিয়ে আসছে। জীবনের তখন আর অনিশ্চয়তা নেই, কারণ – মৃত্যুর নিশ্চয়তা আছে। মানুষের মৃত্যুতে শোক নেই – ব্যথাতুর কিংবা সন্তপ্ত হওয়ার অনুভূতি নেই...।
এগুলো হলো – গল্পের মাঝামাঝি পর্যায়ের মাল মসলা।
কিন্তু, শেষটায় কী হবে?
ধরা যাক - আমাদের গল্পকথক যে কিনা একটি ভার্সিটিতে পড়ে, তার একজন প্রেমিকা আছে, মেহরীন, – যে নিজের মৃত্যুর তারিখ জেনে গেছে, কিন্তু প্রেমিক গল্পকথকেরটা জানা হয়নি। আমাদের গল্পকথকের তখন ভীষণ ব্যস্ত সময়। তাহলে আসুন, গল্পের “হতে-পারতো-শেষ-অংশটা” পড়ি –
“টানা তিনদিনে তিনটা ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে আসে। মনে হয় – কতো রাত ঘুমাইনি। বাসায় বলে রেখেছিলাম, ১৮ ডিসেম্বর আমার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে দরজার হুক বন্ধ করে একটানা ঘুম দেবো, কেউ যেনো আমাকে এই তিনদিন না ডাকে, আমাকে যেনো খাবারের জন্যও না ডাকা হয়। আজ সব ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে রিন্টুরা যখন রাঙ্গামাটি যাচ্ছে, তখন আমি বাসায় ফিরি। কলিংবেল চাপতে গিয়ে দেখি দরজা খোলা। আমি ভেতরে পা দিতেই আম্মা এসে আমাকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। আম্মার কান্নায় যতো না অবাক হই, তারচেয়ে বেশি অবাক হই যখন দেখি সোফায় মেহরীন বসা। আমাদের বাসায় আগে সে কখনো আসেনি, তার কথা আমার বাসায় জানাইনি এখনো।
আমি মেহরীনের দিকে তাকাই, আম্মা আমাকে ছাড়ছে না। শক্ত করে জড়িয়ে হাউমাউ কান্না বেড়েই চলেছে। এবার মেহরীন এসে যোগ দেয়। তার আগে আমার হাতে দেয় একটি সাদা খাম। খুলে দেখি – আমার ডেথ-টেস্ট রিপোর্ট। ভুলে গিয়েছিলাম দু’সপ্তাহ আগে মেহরীনের জোরাজুরিতে টেস্টে গিয়েছিলাম। অবাক হয়ে দেখি – আজই আমার মারা যাওয়ার কথা, স্পষ্ট লেখা এ বছরের তারিখ, আজই – আজ ১৮ ডিসেম্বর। জানি না কেনো, আমার অদ্ভুত ভালো লাগে। আমার হাসি পায়। আম্মা আর মেহরীনকে সরিয়ে আমি আমার রুমে চলে আসি। দরজার হুক লাগিয়ে বলি – “আমি ৩ দিন ঘুমাবো, কেউ আমাকে ডাকবে না”।
সমাপ্তি হিসেবে এ অংশটুকু কেমন তা আমার জানা নেই।
কারণ, গল্পের মাঝটা আমি লিখিনি। আসলে মাঝে কী হবে তা আমি জানি না। আমি ইচ্ছে করেই আর সমূহ অচেনা বন্ধু, রকি অথবা অন্য কাউকে খুঁজিনি। কে যেনো একবার আমাকে বলেছিলো – দলবদ্ধ জীবনে তোমাকে মানুষ বরাবরই একটি ‘শো-কজ’ লেটার ধরিয়ে দেবে। মনে পড়ছে না – কে বলেছিলো, কিংবা কোথায় পড়েছিলাম। তবে, সংঘবদ্ধতার কারণ-দর্শানো নোটিসে ইদানিং জীবন ভরপুর। পরামর্শের কমতি নেই – একজন বারটেন্ডার বলছে – ‘এমবিএ করেছো মার্কেটিং এ? ভুল করেছো – ফাইন্যান্স ভালো হতো’। একজন গবেষক পরামর্শ দিচ্ছে, ‘এমবিএ কেনো, এমএস করলেই পারতে’। একজন যশোপ্রার্থী লিটল ম্যাগ কর্মী বলছে – ‘ব্লগে লিখো? বাদ দাও ওসব, সিরিয়াস কিছু লিখো’। এখন সমালোচক জ্ঞান দিচ্ছে – ‘আগে ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক্স শেষ করো, তারপরে লিখো’। একজন প্রবাসী ধিক্কার দিচ্ছে – ‘এখনো পিআর নাওনি? থেকে যাও এখানে - কী করবে আর? অথবা, ওয়ার্ক পারমিট নিচ্ছো না কেনো?’ নিজের ইচ্ছে মতো জীবন সাজানোর উপায় আর নেই – নষ্টদের অধিকারে চলে গেছে অনেক কিছু – একজন বিকম ফেল গার্মেন্টস ব্যবসায়ী একাধিক ব্যক্তিগত বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হয়ে গেছে, কিছু অধ্যাপক তার হারেমের সেবাদাস হয়ে আছে, নিত্যনতুন বানর নাচ চলছে সেখানে। আর এখানে স্বপ্নেরা সব ধুসর হয়ে আছে।
‘তোমার মুক্তি নেই, তোমাকে র্যাটরেসে আসতেই হবে’।
মূলত এসব কারণেই ‘মৃত্যুর তারিখসমূহ জেনে যাওয়ার পর’ নামের গল্পটি মারা যায়।
থেকে যায় এলিজি - গল্পের জন্য এবং স্বপ্নের জন্য।
Read more...