23 July, 2007

এক নি:শব্দ আততায়ী

হাল্কা পাতলা ছিমছিমে গড়ন। মাথায় ছোট চুল, চোখে চশমা। লম্বা লম্বা পা ফেলে ক্যাম্পাসের এপাশ-ওপাশ দুমড়ে বেড়ান সারাদিন। সময়মতো ক্লাসে যান, রাস্তার পাশে খুপড়ি দোকানে চা খান। বিকেলে সাংস্কৃতিক সংগঠনের রিহার্সাল রুমে - 'নী-লা-ঞ্জ-না অই নীল নী-ল চোখে'। তবুও ক্লান্তি নেই কোনো। তার ব্যাক্তিত্বে আমি এবং আমরা অনেকেই ঈর্ষান্বিত।
তিনি আমাদের নাজমুল ভাই।
পড়ালেখায় আমার চেয়ে দু'বছরের সিনিয়র। ভাগ্যফেরে অ্যাপ্লাইড স্টাটিস্টিক কোর্স একসাথে করায় আমার সাথে নাজমুল ভাইয়ের সম্পর্ক খুব ভালো। দূর থেকে দেখলেই ডাক দেন - 'হাই ম্যান, কী অবস্থা?'
আমিও পাল্টা জবাব দিই।

সিনিয়র হলেও নাজমুল ভাইয়ের সাথে আমার খুব মিলে, কেবল একটি বিষয় ছাড়া; নাজমুল ভাই নারীসঙ্গ বিবর্জিত, নারী বিদ্বেষী, এন্টি-ফেমিনিস্ট। আমরা অনেকেই যখন শান্তা-কান্তা, সোনিয়া-তানিয়া, আয়েশা-মাঈশাদের হৃদয়ে অনবরত কড়া নাড়ায় ব্যাকুল, নাজমুল ভাই তখন মেয়েদের যন্ত্রণায় মোবাইল ফোন বন্ধ রাখেন। সিনিয়রদের সাথে কথা বলেও নাজমুল ভাইয়ের সফল কিংবা ব্যর্থ প্রেমের অতীত খুঁজে পেলাম না। বরং জানলাম - নাজমুল ভাই কর্তৃক প্রত্যাখাত এক কণ্যার কানাডায় ক্রেডিট ট্রান্সফারের করুণ কাহিনী। নাজমুল ভাইয়ের মতাদর্শ আমাদের হতাশায় আশার আলো দেখায়। ছাত্রজীবনে প্রেম করার বাইরেও অনেক কিছু করার আছে কিংবা একজন নারী কখনো আলটিমেট ডেসটিনেশন হতে পারে না জাতীয় কথাগুলো আমাদের মনে বাণী চিরন্তনী হয়ে থাকে।

তবুও বয়সের ধাক্কায় পথভ্রষ্ট হই। সেমিস্টারের শুরুতে নতুন নতুন ফারা-সারাহ, নীপা-দীপাদের দেখে বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। ক্লাস-ক্যুইজ-অ্যাসাইনমেন্ট কোনো কিছুতে মন দিতে পারি না। ক্যাফেতে মাথা নিচু করে আড়চোখে তাদের চটপটি-ফুচকা খাওয়া দেখি। টের পাইনা কখন নাজমুল ভাই পাশে এসে বসেন।
- শোনো ছোট ভাই, কিছু কথা বলি। মনে রাখার চেষ্টা করো।
- জ্বী বলেন। আমি জবাব দিই।
- একটা গার্লফ্রেন্ডের চাইতে একটা সাইকেল ভালো, আর একটা বৌয়ের চাইতে এক কাপ কফি ভালো।
- একটু খোলাসা করেন গুরু। নাজমুল ভাইয়ের কথা আমি বুঝতে পারি না।
- অন্তত: উনত্রিশটা কারণে একটা গার্লফ্রেন্ডের চাইতে একটা সাইকেল ভালো। কয়েকটা বলি এখন -

১) সাইকেল কখনো চায়নিজ খেতে চায় না
২) সাইকেল নিয়ে বেড়াতে গেলে কোনো খরচ হবে না
৩) তুমি অন্য কয়টা সাইকেলে দিকে তাকালে তা নিয়ে তোমার সাইকেল কোনো অভিযোগ করবে না
৪) সাইকেলের কোনো বাবা-মা অথবা মাস্তান কাজিন থাকে না, যে কিনা তোমাকে থ্রেট দিবে
৫) বন্ধুর সাইকেল নিয়ে যত বেশী বাইরে ঘুরতে পারো, কেউ কিছু মনে করবে না
৬) যখন খুশি তখন তুমি সাইকেল পাল্টাতে পারো
৭) সাইকেল চালানোর জন্য প্রতিদিন শেভ করা বা পারফিউম দেয়া লাগে না
৮) সাইকেল তোমার নির্দেশমতো সামনে-পেছনে, ডানে-বামে চলবে। উল্টা পাল্টা কিচ্ছু করবে না
৯) এর আগে তোমার কয়টা সাইকেল ছিলো তা নিয়ে বর্তমান সাইকেল কোনো প্রশ্ন করবে না বা সন্দেহ করবে না
১০) দিনরাত ২৪ ঘন্টা সাইকেল তোমার কাছাকাছি রাখতে পারো, নো প্রবলেম!!!

এটুকি বলে নাজমুল ভাই থামেন। আমি সাগ্রহে জিজ্ঞেস করি - তারপরে?
- নাহ বাকীগুলো তোমাকে বলা যাবে না। ইন্টারনেট থেকে পড়ে নিও। এই নাও টাকা, দু'কাপ কফি নিয়ে এসো।
আমি কফি নিয়ে আসি।
কফিতে চুমুক দিয়ে নাজমুল ভাই শুরু করেন, কেনো বৌয়ের চেয়ে কফি ভালো -
১) তুমি দোকান থেকে প্রতিদিন ফ্রেশ কফি কিনতে পারো
২) কফি আর সিগারেট একসাথে খাওয়া যায়
৩) দাঁত ব্রাশ না করেও কফিতে চুমুক দেয়া যায়
৪) কফি ঠান্ডা হয়ে গেলে নিজের পছন্দমতো রাত-বিরাতে গরম করা যায়
৫) কফি কখনো ইমোশনাল আচরণ করে না

নাজমুল ভাই কফিতে শেষ চুমুক দেন। বলেন -এখন ক্লাসে যাই। এই নাও ওয়েব সাইটের ঠিকানা, বাকীগুলো পড়ে নিও। আরেকটা কথা - শুক্রবারে পত্রিকায় তোমার লেখা গল্প পড়লাম।
- থ্যাংকস।
- কিন্তু ঐসব প্রেমের গল্প বাদ দিয়ে দেশের ব্যবসা-অর্থনীতি নিয়ে কিছু লিখো। ইকনোমিকসে তোমার মাথা ভালো।
- মানলাম, কিন্তু সবাই যদি আপনার মতো প্রেম-ডেটিং বন্ধ করে দেয় তাহলে ইকোনমির কি হবে ভেবেছেন?
- শোনো, ডেটিং হলো অপচয়মুলক ব্যয়। অর্থনীতির প্রয়োজন উন্নয়নমূলক ব্যয়। বোঝতে পারছো? বলে নাজমুল ভাই গটাগট বেরিয়ে যান।

সেদিন বিকেলে গিয়ে সাইকেল কফি বিষয়ক বাকী কারণগুলো পড়ে আমার চোখ-কান লাল হয়ে উঠে। নাজমুল ভাইকে গুরু মানি আর একটা সাইকেল কেনার প্ল্যান করি মনে মনে।

দিন বয়ে যায়। নাজমুল ভাই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে একটি বিদেশী ব্যাংকে জয়েন করেন। ক্যাম্পাসে আমি তার জায়গা দখলের চেষ্টা করি। তার মতো কর কথা বলি, লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটি। কাউকে কেয়ার করি না। অবিশ্বাস্যভাবে এই আমি পরপর তিনটা প্রেমের অফার প্রত্যাখান করি। খবর রাখি না - কেউ ক্ষোভে ক্রেডিট ট্রান্সফার করলো কিনা। তবে বুঝতে পারি - নাজমুল ভাইয়ের মতাদর্শের কারিশমা। সাইকেল কফি থিয়রী আমার জীবন পাল্টে দেয়। তারপর আর অনেকদিন আমাদের দেখা হয় না। প্রায়ই ভাবি তার বাসায় গিয়ে দেখা করে আসি। যাওয়া হয় না।

হঠাৎ একদিন মৌরি মেডিসিনে নাজমুল ভাইয়ের সাথে দেখা। অনেকগুলো মেডিসিন কিনছেন তিনি।
- কার অসুখ, ভাই?
- আর বলো না, তোমার ভাবীর শরীরটা ভালো না।
ভাবী! আমি অবাক হই।
- আপনার না পার্মান্যান্ট ব্যাচেলর থাকার প্রমিজ ছিলো?
- অইসব তো ইমোশনের কথা। বাস্তব জীবন অন্যরকম। বুঝলে -ভালোবাসা এক নি:শব্দ আততায়ী, বলে নাজমুল ভাই চশমায় ধাক্কা দেন।
- চিন্তা ভাবনা পাল্টালেন কবে? কীভাবে?
- না-মানে-আসলে কীভাবে কী-ভা-বে কী হয়ে গেলো বুঝতে পারলাম না।
নাজমুল ভাই আমতা আমতা করে মোটরসাইকেলে স্টার্ট দেন।
আমার মাথায় দুষ্টামি চাপে। জিজ্ঞেস করি
- এখনো কফি খান?
নাজমুল ভাই মুচকি হাসেন। বলেন
- বাসায় এসো, তোমার ভাবী খুব ভালো কফি বানায়।

নাজমুল ভাইয়ের মোটর সাইকেল আমার চোখের আড়াল হয়। কানের কাছে বাজতে থাকে - 'কীভাবে কী-ভা-বে কী হয়ে গেলো - - -'
আসলেই বোঝা যায় না!
ভালোবাসা এক নি:শব্দ আততায়ী।

3 মন্তব্য::

শফিকুল ইসলাম 'টুটুল' 24 July, 2007  

এরম একখান লেখা লেইক্যা আবার নারীর স্বপ্ন দেখেন? সাহস তো কমনা আপনার?

একাধিক পাইলে আমারে জানাইয়েন... :P

শফিকুল ইসলাম 'টুটুল' 24 July, 2007  

ডেটিং হলো অপচয়মুলক ব্যয়। অর্থনীতির প্রয়োজন উন্নয়নমূলক ব্যয়।

দোয়া করি ভাই.. সাবধানে থাইক্যেন...
কখন কি হয়ে যায়..সে আশায় ভাবিত

হা.. হা.. হা..
জট্টিলস

আবদুল্লাহ আল মাহবুব 01 August, 2007  

আমারো মুগ্ধ, বোঝা যায় খুব যত্ন করে লেখেন দারুন সব গপ্প ।

  © Blogger templates The Professional Template by Ourblogtemplates.com 2008

Back to TOP