মনসুর ভাইয়ের বাসায় আফগানী আখরোট খেতে গিয়ে...
অনেক বছরের সিনিয়র হলেও মনসুর ভাইয়ের সাথে একদিন আলাপটা একটু বেশি হয়ে গেলো। এই বেশি আলাপে আলাপে এও জেনে গেলাম, তার বাসা আমার বাসা থেকে দশ মিনিটের হাটার পথ। উনি ক্যাম্পাসের বড় ভাই পেরিয়ে এবার এলাকার বড় ভাই হয়ে গেলেন। আমিও ছোটোভাই। এই সুত্রে আমাকে দাওয়াত দিলেন যে কোনো দিন তার বাসায় যেতে - 'বাসায় আখরোট আছে, আম্মা আফগানিস্তান থেকে নিয়ে আসছে।'
এদিকে আমিও নানান ঝামেলায় থাকি। চলতি রিক্সায়, জ্যামের মধ্যে পাশাপাশি বাসের জানালায়, মনিরের দোকানের মোড়ে মাঝে মধ্যে দেখা হয়ে যায়। আর দেখা হলেই বলেন - 'কই তুমি, বাসায় তো আসলা না। তোমার জন্য আফগানী আখরোট আছে বাসায়'। আমিও 'হ্যাঁ, যাবো একদিন' বলে পার পাই।
সেবার রোজার মাসে সন্ধ্যার শেষে ক্লাস করে ঘামে ভিজে বাসায় এসে ইফতারের বুট-মুড়ির বাটিতে হাত চালাতে শুনি - মনসুর ভাই আমাদের বাসায় এসেছিলেন, আগামীকাল তার কি জরুরী পরীক্ষা - আমার জন্য দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করে চলে গেছে। বলে গেছে - যেভাবেই হোক আজ যেন তার বাসায় যাই।
জানতাম একটা জুনিয়র লেভেলের কোর্স উনি রি-টেক করছেন, যেটা আমি আগের সেমিস্টারে শেষ করছি; সপ্তাহ খানেক আগে এরকম কিছু আমাকে বলছিলেনও। তাই, মিনিট দশেক পরে তার বাসায় রওনা দিলাম। এবং লোকেশন মতো পানের দোকানে 'মনসুর ভাইদের বাসা কোনটা' জিজ্ঞেসের পরে ঠিকঠাক গেইটে পৌছলাম।
তাড়াতাড়ি বই এনে 'ইম্পর্ট্যান্ট কী কী' আলাপে আমি স্মৃতি হাতড়াই, টিক চিহ্ন মারি। উনি পেন্সিলে ভি-আই, ভি-ভি-আই লিখেন। সব শেষ হলে, আমাকে বলেন - 'আবার চ্যাপ্টারগুলা দেখো, কিছু মনে পড়ে কিনা দেখো'। আমি পাতা উল্টাই, চিন্তা করি, দুই একটা 'মে বি' চিহ্ন মারি। এই ফাঁকে উনি পিরিচে করে চানাচুর আর আখরোট নিয়ে আসছেন।
'তোমাকে বলছিলাম না, আম্মা আফঘানিস্তান থেকে আখরোট নিয়ে আসছে'।
আমি চিমটি দিয়ে আখরোট মুখে দিই, আর ভাবি - 'এইটার নাম আখরোট? এইটা আফগানিস্তানের জিনিশ?'
এর মধ্যে মনসুর ভাইয়ের মা আসলেন, আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমিও স্লামালাইকুম বলে দাড়ালাম কিংবা দাঁড়িয়ে স্লামালাইকুম বললাম। আন্টি কিছু না বলে চলে গেলেন।
আখরোটের পরে চা এলো। আমি চা'য়ে চুমুক দিই। আর মনসুর ভাই বলেন - 'তুমি আরেকটু ভালো করে ভাবো, কোনটা কোনটা পরীক্ষায় আসছিল মনে করো'।
আমি মাথা নাড়ি।
এর মাঝে পাশের রুমে কোলাহল গুঞ্জন বাড়ছে। নারী কন্ঠের গুনগুনানি। ওদিকে আড়চোখে দুয়েকবার তাকালামও।
মনসুর ভাই জানালেন, এলাকার ৩০-৪০ জন মহিলা জামায়াতে তারাবীর নামাজ পড়বেন। উনার মা ইমামতি করবেন। আমি বললাম - 'বাহ! বেশ ভালো'। এর বিশ কি পঁচিশ সেকেন্ডের মধ্যে পাশের রুম থেকে মনসুর ভাইয়ের মা আওয়াজ দিলেন, 'মনসুর, ওকে নামাজ পড়ে যেতে বল'।
আমার কাছে পরিস্থিতিটা খানিক অস্বস্তিকর মনে হলো।
একটু ইতিউতি করে বললাম, 'মনসুর ভাই, আমার মনে হয় সব দাগানো হয়ে গেছে। আমি আসি, আর মোবাইল তো আছে। দরকার হলে ফোন দিয়েন।' মনসুর ভাইও আমাকে বিদায় দেয়ার জন্য রেডি হলেন। পাশের রুমে গিয়ে মা'কে বললেন - 'আম্মা, ও তো এখন চলে যাবে।'
মনসুর ভাইয়ের আম্মা আরো জোর গলায় বললেন - "নাহ, ওকে নামাজ পড়ে যেতে বল"।
আমি পড়লাম মহা ফাঁকড়ায়। আমার মা-খালা-চাচীদের মধ্যে ভয়ংকর রাগীরাও আমাকে এরকম ধমক দিয়ে কোনোদিন কিছু বলেনি। খানিক ভয়ও পেলাম।
মনসুর ভাই মাতৃভক্ত। আমার কাছে এসে মিনমিন করে বললেন - 'বুঝো না, আম্মা তো যেতে দিবে না। আর সমস্যা হলো, তোমাকে এখন যেতে হবে ড্রয়িং-রুমের মাঝ দিয়ে, ওখানে তো এখন সবাই নামাজের জন্য বসে গেছে, তুমি বের হবা কীভাবে?'
আমি তখন, ছাইড়া দে মা কাইন্দা বাঁচি। বললাম, 'ভাই দেখেন না, আমি জাস্ট বেরিয়ে যাবো; একটু ব্যবস্থা করেন'।
মনসুর ভাই অপারগ। এবার উনি আমার উপর আক্রমণাত্বক হলেন এই বলে "তুমি রোজা রাখো না? রোজা রাখলে তারাবীর নামাজ পড়তে হবে না?"
আমি গাঁইগুই করি, বলি, "হ্যাঁ তা তো অবশ্যই, আসলে আমার রেস্টের দরকার। এই বাসায় এসে শুনলাম আপনি আসতে বলছেন, তাই দৌড়ে চলে এলাম। ফ্রেশ হওয়াও দরকার।" আর মুখ দিয়ে এমন ভাব দেখালাম, আমার এই নাপাক-অপবিত্র শরীর দিয়ে নামাজের নামও নেয়া যাবে না।
এইবার মনসুর ভাই আরেক সমাধান নিয়ে এলেন। বললেন, "তুমি আমার বাসায় এক্ষুনি শাওয়ার নিয়ে ফেলো, আমার লুঙ্গি পরো। তারপরে চলো দুইজনে এই রুমে জামা'ত করি। একত্রে নামাজে দাড়াই।"
আমিও ওঁ-আঁ করি। বলি, ক্ষিদাও লাগছে। বাসায় খিচুড়ী রান্না করছে। মেহমানও আসবে। এই মেহমানের কারণে বাসায় ফেরাটা দরকার বেশি। (ছুতা বানাইতে দেরি হয় না।)
আমাদের এসব আলাপ মনে হয় পাশের রুম থেকে মনসুর ভাইয়ের বড় ভাবী শুনছিলেন। আচমকা মনসুর ভাইয়ের রুমে এসে আমাকে ডাক দিলেন, বললেন - 'আসেন আপনি এদিকে আসেন। কোনোদিকে তাকাবেন না, সোজা বের হয়ে যাবেন'।
আমি বললাম - 'আইচ্ছা'।
ড্রয়িং রুমে জামায়াতে নামাজের সব আয়োজনের শুরুতে লাইট নেভানো হলো, যাতে আমি কাউকে না দেখি।
বিশ পঁচিশ কিংবা তারও বেশি বোরখাময় সারি সারি নারীর মাঝখান দিয়ে আমি দমবন্ধ করে হাটা শুরু করলাম, মনে হলো কয়েক সেকেন্ডে আমি ড্রয়িং রুম পেরিয়ে এলাম।
বাইরে এসে আরেক সমস্যা। ঐ জমায়াতে শরীক অন্ততঃ ৩০ নারীর ৬০টা স্যান্ডেলের মাঝে আমার স্যান্ডেলও মিশে গেছে।
লাইট নেভানোয় এদিকটা অন্ধকার। মাথা নিঁচু করে চোখ বুলাই। আমার স্যান্ডেল খুঁজে পাই না। এরমাঝে ভাবী আবার তেড়ে এলো - 'আপনি এখনো কী করেন?'
'আমার স্যান্ডেল পাচ্ছি না।'
ভাবী এবার টর্চ লাইট নিয়ে এলেন। খুঁজে পেলাম দু'শ উনপঞ্চাশ টাকা আশি পয়সা দামের আমার বাটা স্যান্ডেল।
ভাবীকে থ্যাংক ইউ বলে গেটের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। আর তখনি মনসুর ভাইদের শেফার্ড কুত্তাটা আমার পিছনে ঘেউ ঘেউ ঘেউ...। আমি এবার দৌড়। জানপ্রাণ নিয়ে দৌড়...।
দশ কদমের গেইট পেরুতে মনে হলো দশ কিলোমিটার দৌড়ালাম।
.
-
.