আনোয়ারা সৈয়দ হকের 'মোবাইল সমাচার'
আনোয়ারা সৈয়দ হক সম্ভবতঃ পেশা পরিচয়ে ‘মনোবিজ্ঞানী’ লেখেন। তাঁর কিছু উপন্যাসকেও ‘মনোবিশ্লেষণধর্মী’ উপন্যাস বলা হয়। আমার কাছে আনোয়ারা সৈয়দ হক অন্য কারণে মনে রাখার মতো নাম। প্রথমতঃ ১৯৯৩/৯৪ সালে ‘শিশু’ পত্রিকায় তাঁর লেখা দূর্দান্ত একটি গল্প পড়ি। গল্পের নাম ঠিক মনে পড়ছে না, তবে কাহিনী এরকম – এক মুক্তিযোদ্ধার ছেলের আত্মকথন। তার বাবার মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আর ফিরেনি। সে যখন বড় হয় তখন এলাকায় স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতাপ। সামাজিকভাবে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারটিকে হেনস্তা করা হয়। জায়গা জমি দখল করে দেয় রাজাকাররা। এরপরে মুক্তিযোদ্ধার কিশোর ছেলেটি ক্রমান্বয়ে পালটে যেতে থাকে। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নদীর ঘাঁটে রাখা নৌকায় শুয়ে মাসুদ রানা পড়ে সে। আই লাভ ইউ লেখা লাল গেঞ্জি পরে; এরকম। গল্পটির প্লট আমাকে আক্রান্ত করেছিলো, বিষণ্নতা জাগিয়েছিলো। তাই মনে পড়ে প্রায়ই।
দ্বিতীয়তঃ আনোয়ারা সৈয়দ হকের একটি বই, ‘তুমি এখন বড় হচ্ছো’ খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছিলাম। কিশোর বয়সের শরীর ও মন নিয়ে জেগে ওঠা রহস্যময়তার সরল বিশ্লেষণ ছিলো সে বই। গল্পে গল্পে জানলাম অনেক কিছু। এরপর থেকে আনোয়ারা সৈয়দ হক নাম দেখলেই আমার এ দুটো ব্যাপার মাথায় আসে। পত্র-পত্রিকায় বিক্ষিপ্তভাবে তাঁর কলাম পড়েছি। তিনি নারী প্রগতির কথা লেখেন, ধর্মীয় গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে লেখেন, মানুষের মন ও মনের ভেতর নিয়ে লেখেন। তবে আজ চমকালাম ‘সাপ্তাহিক২০০০’ চলতি সংখ্যায় তাঁর কলাম ‘মোবাইল সমাচার’ পড়ে।
কলামের একেবারে প্রথম কথাগুলো – ‘মোবাইল ফোন আমাদের দেশে একটি অসভ্য সংস্কৃতির ধারা বহন করে ফিরছে বিগত এক দশক। দিনে দিনে এই অসভ্যতা বাড়ছে, বেড়েই চলেছে, এর যেন কোনও আর থামাথামি নেই। মোবাইল ফোন আমাদের দেশে ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক আব্রম্ন নষ্ট করেছে। এবং করেই চলেছে।’
সাপ্তাহিক২০০০ এর ফন্টে সমস্যা আছে, তাই ‘আব্রম্ন’ কী বোঝলাম না। ধারণা করে নিচ্ছি – তিনি বলতে চেয়েছেন মোবাইল ফোন আমাদের দেশে ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক শৃঙ্ক্ষলা/অবস্থান/ব্যালান্স/আবহ কিংবা এরকমই কিছু একটা নষ্ট করছে। এবং করেই চলেছে।
এরকম অভিযোগ নতুন নয়। মোবাইল ফোনের ব্যবহার এবং নানান দিক নিয়ে সুতর্ক-কুতর্ক পুরনো, যার চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেই। বরং নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবার ব্যাখ্যা আছে। তবে, আনোয়ারা সৈয়দ হক মনোবিজ্ঞানী বলেই তাঁর কথাগুলো গুরুত্ব দিয়ে পড়তে হয়। সাড়ে সাতশ’ শব্দের এ কলামে তার মূল কথা এরকম –
১) মানুষ এখন সময়ে অসময়ে ফোন করে। সময়জ্ঞান কমে যাচ্ছে।
২) ‘মোবাইল ফোন পুরো বাঙালি জাতিকে ইমপাল্সিভ একটি জাতিতে পরিণত করেছে। শুধু ইমপাল্সিভ নয়, প্যারানয়েডও।‘
৩) সিনিয়র-জুনিয়রের সম্পর্ক নষ্ট করছে মোবাইল ফোন। ‘একজন চ্যাংড়া মোবাইলধারী এখন বৃদ্ধ একজনকে রাত বারোটায় ঘুম থেকে জাগিয়ে সামান্য একটি সংবাদ জানায়, অর্থাৎ দিন হওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করতে পারে না।‘
৪) কর্মক্ষেত্র এবং অন্যান্য জায়গা অহেতূক ব্যক্তিগত মোবাইল আলাপে ভরে যাচ্ছে।
৫) কিশোর কিশোরীরা ঋণাত্বকভাবে মোবাইল ফোনে বন্ধু-পরিবার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ব্যক্তিগত সময় কিংবা স্বাধীনতা আর থাকছে না।
মোটের ওপর এই হলো আনোয়ারা সৈয়দ হকের অভিযোগের কিংবা সমাচারের সারমর্ম।
অবাক হলাম, মোবাইল ফোন ব্যবহারের এইসব বিপ্রতীপ বিষয়গুলো সমাধান বা নিয়ন্ত্রণের উপায়ে না গিয়ে তিনি দোষটা মোবাইল ফোনের উপরেই চাপিয়েছেন। সেইসব পুরনো অভিযোগ মনে পড়ে যায়, যখন বলা হতো – কম্পিউটারের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে, ১০ জনের কাজ একজন করে ফেলবে, দেশে বেকার সমস্যা দেখা দেবে। কিংবা ইন্টারনেট এলে দেশের সব তথ্য বাইরে পাচার হয়ে যাবে। এসব যুক্তি হাস্যকর হতে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি, আনোয়ারা সৈয়দ হক এগুলো জানেন বলেই অনুমান করছি। অন্ততঃ নিজেকে যতোটা বিজ্ঞানমনষ্ক এবং প্রগতিশীল বলে লেখায় ছাপ ফেলতে চান, তাতে করে তাঁর এসব জানার কথা। এজন্যই বেশি চমকাই, যখন দেখি লেখার উপসংহারে তিনি বলেন -
তবে শেষ কথা হচ্ছে এখন মোবাইলের যুগ। প্রতিটি মানুষের হাতে মোবাইল তুলে দেওয়াই এখন বিশ্ব বাজারের লক্ষ্য। তবে এই যুগ থাকবে না। মানুষ অচিরেই এই মোবাইল সংস্কৃতি পরিত্যাগ করবে। মানুষের মন ও আত্মাকে কোনওদিন কোনও মেশিন সন্তুষ্ট রাখতে পারবে না দীর্ঘদিন। এটা আমার বিশ্বাস।
আনোয়ারা সৈয়দ হকের বিশ্বাস কতোটুকু সত্যি হবে, মানুষ মোবাইল সংস্কৃতি পরিত্যাগ করবে নাকি এ সংস্কৃতির ধারা বিবর্তিত হবে; সেসব সময়ই বলে দেবে। তবে আনোয়ারা সৈয়দ হকের কাছে পাঠক হিসেবে আমার একটি অন্যরকম চাওয়া আছে। তাঁর অবস্থান, বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য এবং যোগ্যতা বলেই তিনি কাজটি করতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস। বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের বুদবুদ যুগে একদল বিভ্রান্ত কিশোর-তরুণদল নষ্ট এক খেলায় মেতে উঠেছে। প্রেমিকা-বান্ধবী অথবা অন্যকারো ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ মুহূর্ত মোবাইলে রেকর্ড করে ছড়িয়ে দিচ্ছে নানা মাধ্যমে। আমাদের সামাজিক কাঠামোতে এর প্রধান ভিক্টিম হচ্ছে কিশোরী কিংবা তরুণীটি। ক্ষেত্র বিশেষে পুরুষটিও। আনোয়ারা সৈয়দ হক কি এই প্রবণতা কিংবা চর্চাটি নিয়ে লিখবেন? এসব ঘটনায় আক্রান্ত কিংবা সম্ভাব্য আক্রান্তদের মানসিক বিপর্যয়ের ব্যাপারটি নিয়ে তিনি কি কলাম কিংবা গল্প অথবা উপন্যাস লিখবেন, আক্রান্তদের পাশে দাঁড়াবেন?
খ্যাতনামা মনোবিশ্লেষক আনোয়ারা সৈয়দ হকের কাছে এ চাওয়াটি খুব বেশি হবে কি!
.
.
. Read more...