গল্প: শনিবারে নাজ ম্যারেজ মিডিয়ায়
শনিবার সকালে ফারজানা নাজনীনের তেমন কিছু করার ছিলো না। ভারী বাইন্ডিং ফাইল দেখে দরকারী আপডেট শেষে প্রতিদিনের মতো নতুন-পুরনো ক্লায়েন্টের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। দেয়াল ঘড়িতে তখন সকাল দশটা দশ। এমন সময় ম্যানেজার মাসুদ চাচা চলে আসার কথা। অফিসের জানালা খুলে, পর্দা সরিয়ে, বারান্দা থেকে হাঁক দিয়ে ফারজানার জন্য চায়ের অর্ডারও দেয়ার কথা। ফারজানা তাই অপেক্ষা করে। দরজার ওপাশে দেয়ালে বড় করে লেখা 'নাজ ম্যারেজ মিডিয়া - বিয়ের পাত্র পাত্রী অনুসন্ধান'। মাত্র দু'বছরে এ নাম এলাকার চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
কুসুমিয়া উপজেলায় এমন করে বিয়ের ঘটকালীও যে রমরমা ব্যবসা হয়ে উঠবে সেটা কেউ ভাবেনি আগে। ফারজানা নাজনীন নিজেও হয়তো ভাবেনি। কিন্তু, আশেপাশে তখন পালটে যাচ্ছে সব। মাদ্রাসা মার্কেটের নিচ তলায় সিঙ্গার ইলেকট্রনিক্সের শো রুম হয়েছে, সারা দেশে মোবাইল ফোন ৪ টাকা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে অনেকগুলো মোবাইল ফোনের দোকান হয়েছে। তখন ম্যারেজ মিডিয়ার দোকান দেখে অনেকে হেসেছিলো, কেউ কেউ ভেবেছিলো – ফারজানা এমন করবে সেটা আগেই টের পেয়েছে তারা। কুসুমিয়া ডিগ্রি কলেজে বি.কম পাস দিয়েও যে মেয়ে বাজারে বাজারে টো টো করা ছাড়লো না, বিয়ে শাদী করলো না, সে ঘরে বসে না থেকে এরকম কিছু করবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মানুষের এসব কথা ফারজানা মাথায় নেয়নি, বরং নিজেই কিছু একটা করছে এমন ভেবে ভেবে খুশি হয় আনমনে। এই খুশির ভাবনায় বড়ো ধাক্কা লাগে শনিবার সকালে যখন সে মাসুদ চাচার জন্য অপেক্ষা করে, তখন মোবাইল ফোনে রিং হয়। কুসুমিয়া থানার ওসি রওশন আরা ফোনে ফারজানার কাছে পাত্র অনুসন্ধান করে। এমন ফোনে অখুশী হওয়ার কিছু নেই। পাত্র অথবা পাত্রীর বিবরণ নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে কাগজে টুকে রাখে, তারপর সময় করে অফিসে আসতে বলে সব ক্ষেত্রে। কিন্তু রওশন আরার ফোনে ফারজানা একটু ঘাবড়ে গেলো। ছ'মাস আগে কুসুমিয়া থানায় মহিলা ওসি'র আগমন এলাকায় হৈচৈ ফেলেছিলো। সার্কাস অথবা যাত্রাপালার প্রিন্সেসকে দেখার মতো করে দূর দূরান্তের লোকজন থানার আশেপাশে চক্কর মেরেছে। উপজেলা সদরে যারা থাকে, ব্যবসা করে কিংবা নিয়মিত আসে তারা রওশন আরাকে হরহামেশা দেখে। তবে ভয়ে কেউ ইঙ্গিতি কথা বলে না। কলেজের উঠতি ছেলেরা হয়তো নিজেদের মাঝে টিপ্পনী কাটে। বুড়োদের কেউ জগত সংসার গেলো বলে পিঠ ঘুরায়। কেউ কেউ অকারণেই হাসে নিজেদের মাঝে, যার অনেকগুলো অর্থ হতে পারে। তবে সব মিলিয়ে ঐ এক কথা – থানায় মহিলা ওসি এসেছে, পুলিশের ইউনিফরম গায়ে নানান দিকে গাড়ী নিয়ে যায়, এটাই এলাকায় অভূতপূর্ব ঘটনা। এত কিছুর মাঝে মাস কয়েক আগে সে যখন রাত দুইটায় অপারেশন চালিয়ে ইন্ডিয়ান শাড়ী চালানকারী দলকে ধরে ফেললো, অনেক রাউন্ড গোলাগুলিও হলো, তখন জাতীয় পত্রিকা এবং স্যাটেলাইট টিভিতে রওশন আরাকে নিয়ে সাড়া পড়ে গেলো। কুসুমিয়া উপজেলা সদরের পাকা সড়ক পেরিয়ে দত্তপাড়া, ছাতিমপুর, মুন্সীতলা এরকম নানান গ্রামে রওশন আরার নানান গল্প ছড়িয়ে গেলো। এমন জাঁদরেল ওসি এলাকার চোর ডাকাত সব জেলে দিচ্ছে, নিজেই রাত বিরাতে চোরাকারবারী ধরছে এ প্রশংসায় সবাই আপ্লুত হয়। অনেকে তাকে নিজের চোখে না দেখলেও তার সাহসের সুত্র ধরে নানান গল্প ফাঁদে। বলে, এমন লোকই দরকার। দুষ্ট বাচ্চাদের ভয় দেখাতে স্কুলের হেড মাস্টারের বদলে রওশন আরার নাম নিতে শুরু করেছে বাবা মায়েরা এমন খুচরা গাল-গল্পও ফারজানার কানে এসেছে। কিন্তু, শনিবার সকাল দশটা পনেরো অথবা বিশ মিনিটের সময় রওশন আরা ফোন করে ফারজানাকে বলে,
'হাতে ভালো পাত্র আছে নাকি?'
ফারজানা ভেবেছিলো রওশন আরা তার পরিচিত কারো জন্য পাত্র খোঁজ করছে। কুসুমিয়ায় পাত্রের অভাব নেই। গ্রামের ঘরে ঘরে মিডল ইস্ট ফেরতা যুবক। ডিগ্রি পাস, ডিগ্রি ফেইল, ইন্টার-মেট্রিক পাস অথবা ফেইল, অথবা পড়ালেখা নাই – বংশ আছে, এরকম নানান ভেদের পাত্র ফারজানার হাতের নাগালে। সামনে ডিসেম্বর মাসে ঈদ উপলক্ষ্যে ছুটিতে গ্রামে গ্রামে বিদেশবাসী যুবক। এদের মোটামুটি সবাই বিবাহযোগ্য এবং বিবাহউন্মুখ। কসমেটিকসের পাশাপাশি সৌদি আরব, ওমান, কুয়েত কিংবা দুবাই, বাহারাইন থেকে গহনাপাতি কিনে এনেছে হবু বৌয়ের জন্য। তাই কুসুমিয়া ডিগ্রি কলেজের বি.কম, বি.এ পড়ুয়া মেয়েদের বাবার পাশাপাশি একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর অনেক মেয়ের মামা চাচারা ভীড় জমায় নাজ ম্যারেজ মিডিয়ায়। আগামী তিন মাসের তেরো শুক্রবারে কম করে হলেও বিশটা বিয়ে হবে ফারজানার ঘটকালীতে। এমন জমজমাট সময়ে থানার ওসি রওশন আরা ফোনে জিজ্ঞেস করে ফারজানার হাতে ভালো পাত্র আছে কিনা। কোন ধরনের পাত্র, বয়স কতো জানতে চাইলে রওশন আরা বলে, রওশন আরার বয়স তিরিশের কাছাকাছি তাই বত্রিশ কিংবা চৌত্রিশ অথবা আরেকটু বেশি বয়সী পাত্রই চলবে। ব্যবসায়ীতে আপত্তি নেই, গভমেন্ট অফিসার হলে সবচে' ভালো হয়। এমন বয়স্ক পাত্র পাত্রীর ক্ষেত্রে ফারজানা শুরুতেই জিজ্ঞেস করে দ্বিতীয় বিয়ে কিংবা বৈধব্যে আপত্তি আছে কিনা। কিন্তু, রওশন আরাকে এ প্রশ্ন করার সাহস ফারজানা পেলো না। 'একটু খোঁজ খবর নিতে হবে' – বিনয়ের সাথে এ কথা জানালে ফোন রাখার আগে রওশন আরা বলে,
'খুব নামডাক শুনি আপনার, দেখি কেমন আপনার দক্ষতা, সময় কিন্তু একমাস।' নামডাকের প্রশংসায় খুশি হলেও শেষে 'সময় কিন্তু একমাস' শুনে ফারজানা ঘাবড়ে যায়। সাহস করে জিজ্ঞেস করে,
'একমাস কেনো?'
এবার রওশন আরা গলা গম্ভীর করে –
'একমাসের মধ্যে কিছু না পারলে আপনার সাথে আমার বোঝাপড়া আছে'।
একথা বলেই ওসি রওশন আরা ফোনের লাইন কেটে দেয়। আবার কল ব্যাক করার সাহস পায় না ফারজানা।
গত দু'বছরে ফারজানাকে এমন করে ধমক দিয়ে কথা বলার সাহস করেনি কেউ। বরং পাত্র-পাত্রী পক্ষের লোকজন বিনয় করে কথা বলেছে, সফল বিয়ের আসরে ঘটকের সম্মান পেয়েছে, নির্ধারিত ফি'র উপরি হিসেবে নানান রকম উপহার দিয়েছে কেউ কেউ। দত্তপাড়ার সালাম মাস্টার নাতির জন্মের সংবাদ আর মিষ্টি নিয়ে নাজ ম্যারেজ মিডিয়ায় এসেছিলো গত সপ্তায়। সালাম মাস্টারের মেজো ছেলের সাথে চৌধুরিহাটা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান রফিকুল্লার মেয়ের বিয়ে ফারজানার ঘটকালীতেই হয়েছে। ফারজানা মাঝে মাঝে ভাবে, কতো দ্রুতই জীবনের সময় চলে যায়...। কিন্তু, সেই শনিবারে ওসি রওশন আরার ফোনের পর মনটা ভার হয়ে থাকে। বাইন্ডিং খাতায় পনেরোই নভেম্বর তারিখের নিচে সে লিখে পাত্রী – রওশন আরা, বয়স – তিরিশ, পেশা – পুলিশ, ঠিকানা – কুসুমিয়া থানা সদর, চাহিদা – সরকারী চাকুরীজীবি/ব্যবসায়ী, বয়স ৩০+। এর মাঝে পাত্রীর বিবরণের একঘর খালি থাকে। ফারজানা ভাবে, সেখানে লেখা যায় পাত্রী কালো, লম্বা, সুস্বাস্থ্য। কিন্তু, কী জানি ভেবে লিখে না। মনের ভেতর কেবল ফোনের ধমক সুরের কথাটা ঘুরপাক খায়। সময় মাত্র একমাস।
ফারজানা নাজনীন বুঝে – এমন পাত্রীর জন্য পাত্র পাওয়া সহজ কাজ নয়। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, লম্বা-খাটো বিভিন্ন রকম পাত্র পাওয়া যায় সহজে, সাথে জাত-বংশ মিলানোও যায়। কিন্তু, এমন জাঁদরেল মেয়ে যাকে অনেকেই মহিলা ওসি বলে জানে, তার জন্য পাত্র পাওয়া বেশ কঠিন। এলাকায় বেড়ে উঠা, বিশেষ করে কুসুমিয়া কলেজে পড়া ও ছাত্র সংসদের মহিলা সম্পাদিকা হওয়ার কারণে ফারজানার জানাশোনার অভাব নেই। আশেপাশের কোন গ্রামে বিবাহযোগ্য পাত্র-পাত্রী খবর তার মাথার ভেতর ভর্তি। মাঝে মাঝে মাসুদ চাচাও সংবাদ দেয়, 'ছাতিমপুরের নজু ভুইয়ার সেজো ছেলের পাত্রী দরকার'। অনেক ভেবে চিন্তেও ফারজানা কিছু মিলাতে পারে না। এলাকায় ত্রিশোর্ধ্ব সরকারী চাকরীজীবি বা ব্যবসায়ী এবং তা'ও অবিবাহিত এমন মিলের পাত্র চোখে পড়ে না। ফারজানা যখন এসব ভাবছে তখন মাসুদ চাচা অফিসে এসেছে, চা সিংগাড়া এনে টেবিলে রেখেছে। এবার ফারজানার খানিক রাগ জমে। থানার ওসি হয়েছে বলে এমন ধমক দেয়ার অধিকার রওশন আরা কোথায় পেলো? নাজ ম্যারেজ মিডিয়া তো আর সরকারী অফিস নয় যে পুলিশের হুকুম পালন করতে হবে। অন্য কেউ হলে ফারজানা মুখের উপর কড়া কথা বলতে পারতো। প্রয়োজনে হাত চালাচালিতেও তার দক্ষতা কম নেই, সেটা কুসুমিয়া ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীর পাশাপাশি এলাকার লোকজনও জানে। এখন যেমন উপজেলা মোড়ের টি-স্টলগুলি বা মাদ্রাসা মার্কেটের মেরিনা কুলিং কর্ণারে বসে লোকজন থানার ওসি রওশন আরাকে নিয়ে গল্পে গল্পে চায়ে চুমুক দেয়, তেমনি বছর পাঁচেক আগে এসব আলাপের কেন্দ্রে ছিলো ফারজানা নাজনীন। ছাত্রদল ছাত্রলীগকে টেক্কা দিয়ে সেবার ছাত্রফ্রন্টের পরিষদ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জিতেছিলো। সবাই জানে, কী করে ফারজানা সবার নজর কেড়েছিলো নানান সময়ে। বার্ষিক পিকনিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আন্তঃকলেজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ফারজানাকে দেখা যেতো সামনের সারিতে। কলেজের গেটে দাঁড়ানো সেকেন্ড ইয়ারের সিটি বাজানো ছেলেগুলোকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে কলেজ ছাড়া করেছে ফারজানা। পাশে দাঁড়িয়েছে সাধারণ ছাত্রছাত্রী, নীরব সম্মতি দিয়েছে শিক্ষকেরা। নিয়ম ভাঙ্গা সেই ফারজানা নাজনীন সকালে হিসাববিজ্ঞান, দুপুরে ব্যবস্থাপনা ক্লাস শেষে কমন রুমে আড্ডা দিতো, তারপর আশেপাশে যাকে পাওয়া যেতো তাকে নিয়ে সামনের কলেজ ক্যান্টিনে ডালপুরি খেতো, লিপস্টিক না মাখা ঠোট চুবাতো চায়ের কাপে। ফারজানা কখনো লিপস্টিক মাখেনি এটি প্রথম খেয়াল করেছিল রাজন। হয়তো আরো অনেকেই খেয়াল করেছিলো কিন্তু বলেনি। সাহস করে রাজনই প্রথম ফারজানাকে জিজ্ঞেস করেছিলো,
'তুমি কখনো লিপস্টিক দাও না কেনো?'
(চলবে?)
.
.
.
0 মন্তব্য::
Post a Comment