25 January, 2009

স্লামডগ মিলিওনারঃ দারিদ্র্য বাণিজ্য বিনোদন

আমাদের চারপাশের গল্পে কেবল না পাওয়ার কথা। শন ওয়াইজের সাথে কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা হচ্ছিলো জেনারেশন গ্যাপ নিয়ে। একদিন বললো, আশির দশকে যাদের জন্ম তারা কেবলই না পাওয়ার বেদনায় ভোগে, এরা নিজেদের ক্রমাগতঃ বঞ্চিত ভাবে, সন্তুষ্টির মাপকাঠিতে এদের ইনডেক্স অনেক নিচে। প্রজন্ম ব্যবধানের ব্যবচ্ছেদ নয়, বলিউড-ঢালিউডের সিনেমার কথা ভাবলে কেবল দেখি- পাওয়া না পাওয়ার ব্যবধান। ভিন্নধর্মী যা হচ্ছে সেগুলো চোখে পড়েনা। কিংবা চলচ্চিত্র বোদ্ধা না হলে, সমালোচনার কলম ধরা যায় না।

তবুও দর্শক নমস্য, এরাই কথাচ্ছলে তুচ্ছ করে দেয় জব্বার পাটেল, বিমল রায়কে। রাম গোপাল ভার্মা তো আনন্দবাজারে আগেই ছুরির নিচে। এরকম দর্শক আলোচনায় তুঙ্গে এখন 'স্লামডগ মিলিওনার', নয় দশটি বিভাগে অস্কার নমিনেশনও পেয়েছে। বড়ো পর্দায় বন্ধুসহ দেখার সুযোগ যখন এলো এই ভীনদেশে তখন আরাম করেই বসা যায়।

সন্ধ্যার শো'তে লোক গিজগিজ তাই ফিরে এসেছিলাম। রাত দশটা বিশের শো'ও ফুল। চল্লিশ মিনিট আগে লাইনে দাড়িয়ে পছন্দের সীট পেলাম। কাহিনীতে চমক যতোটা তার চেয়ে বেশী চমক কাহিনী বলার চমক। জামাল মালিক এক বস্তির ছেলে, বাচ্চাদের সাথে খেলছে, পানিতে লাফালাফি করছে। আবার পরের দৃশ্যে পুলিশি রিমান্ডে ইলেকট্রিক শক খাচ্ছে সে। ফিরতি দৃশ্যে 'মিলিওনার কে হতে চায়' অনুষ্ঠানের হট সীটে। একের পর এক উত্তর দিয়ে পুরস্কারের পরিমাণ দ্বিগুণ করছে জামাল। অনিল কাপুর প্রশ্নের পর কম্পিউটার লক করে দিচ্ছে। স্টুডিও কিংবা টিভির সামনের দর্শকের উত্তেজনা বাড়ছে। এটুকু থামিয়ে জামালের ছোটোবেলার গল্পে ফিরে যায় কাহিনী। রায়ট। জামাল-সেলিম-লতিকার গল্প শুরু হয়।

মিউজিকে এবং দৃশ্য ধারণে নতুনত্ব আছে, কিংবা বলা যায় হলিউডের কপিক্যাট চেষ্টা আছে। এবং সে চেষ্টা সফল। ড্যানি বয়লের বাহাদুরিকে চাতুর্য্য মনে হয় যখন দেখা যায় - বাঁশের তৈরি খোলা ল্যাট্রিনে বসে আছে ছোট্ট জামাল। ক্যামেরার চোখ তখন জামালের কচি পা ভেদ করে নিচের হলদেটে মনুষ্য বিষ্ঠা দেখাচ্ছে। ফ্যাক্টসের তর্ক নয়, রুচি বোধ নির্ধারণও নয়; ড্যানি বয়ল সচেতন ভাবেই এ কাজ করেছে। অমিতাভ বচ্চনের হেলিকপ্টার উড়ে আসছে, বস্তির লোক ছুটছে। সালিম ল্যাট্রিনের দরজা আঁটকে চলে গেছে। আর শিশু জামাল নিরুপায় হয়ে নিচে লাফ দিয়ে সারা গায়ে গু মাখা জামায় অমিতাভের ছবি হাতে দৌড়াচ্ছে অটোগ্রাফের জন্য। অটোগ্রাফ পেয়েও যায়। কিন্তু এ দৃশ্য ছবির জন্য কতোটা প্রয়োজন? কিংবা অন্য কিছু করে কি এ বলিউড ক্রেজ প্রকাশ করা যেতো না?
হয়তো যেতো। কিন্তু মুম্বাইয়ের বস্তি জীবন এসব জায়গায় পণ্য হয়ে গেছে। দারিদ্র্য উঠে আসে স্যালুলয়েডের ফিতায়। দারিদ্রের অগমে দূর্গমে শীর্ণ বিশীর্ণ মানুষ। বস্তি নোংরা মানুষ। ক্লেদাত্ব জীবন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দর্শকের চোখে বিমুর্ত হয়ে উঠবে। ক্রিটিক তার কপালে ভাঁজ ফেলে চশমায় ধাক্কা দিবে। একজন শিল্প রসিক বিদগ্ধ ভাষ্য দিবে নির্মাণ মাধুর্য্যে।
এখানে আমি একটু থামি।
নিজেকে বড্ডো দূর্বল দর্শক মনে হয় এবারের দৃশ্যে। এ তো আর নতুন কিছু নয়। এসব কষ্টের জীবনের গল্প আমাদের ঢাকায় বাসে বাসে ঘুরলেই চোখে পড়ে। ভিখারিনী মা তার শিশুর হাত ভেঙে দিয়েছে ছোটোবেলায়; এসব তো কতো চেনা গল্প। ডবল কিংবা ট্রিপল ইনকাম তাই বাংলাদেশী দর্শকের কাছে চমকের মনে হয় না। নিজের সীমাবদ্ধতার, নিজেদের চারপাশের নিরুপায়তার কষ্ট জেঁকে বসে। তাই এ কষ্টকে মনে হয় ব্রিটিশ পরিচালক পণ্য করেছে কৌশলে- দেখা যায়, নানান জায়গা থেকে তুলে আনা শিশুদের ভালো খেতে দেয়া হয়। তারা সারাদিন নানান অভিনয়ে ভিক্ষা করে। ভিক্ষার টাকা আসে মাফিয়া দলের হাতে। গানের জন্য ডেকে শিশুদের পক্কতা চেক করা হয়। শিশু অরবিন্দ আনন্দ নিয়ে গান গায়। সামনে গ্যাং লিডার। গান শুনে মুগ্ধ। অরবিন্দ এবার পাবলিক শো'তে যাবে। অরবিন্দকে নাক চেপে অজ্ঞান করা যায়। পাশে বাতির আগুনে তেল গরম করা হচ্ছে চামচে তুলে। অরবিন্দকে শুইয়ে একচোখে চামচে করে গরম তেল ঢেলে দেয়া হয়। অসহ্য এক দৃশ্য। খানিক তফাতে এ দৃশ্য দেখে সেলিম হরহড় করে বমি করছে। তারপর ডাক আসে জামালের। আরও একটি বিভৎস দৃশ্য দেখার প্রস্তুতি নিই। এবার পালায় তারা। জামাল-সেলিম-লতিকা। লতিকা ট্রেনে উঠতে পারে না। এরপরে তাদের কাহিনী এগোয়। দেখা হয় নানান চক্রে।
কিন্তু, দূর্বল দর্শকের জন্য অস্বস্তি জমে গেছে তখন। দারিদ্র্য নিয়ে কৌশলী দৃশ্য পশ্চিমা বিনোদন। ডলারে বিকোয় এসব...।

জামাল-সেলিম বড়ো হয়ে গেছে ততদিনে।
জামাল রূপী দেব পাটেলকে নিয়ে কিছু বলার নেই। তুমুল ইনোসেন্ট চেহারার ছেলে। বলিউডি হিরোইজম নেই। কিন্তু সংলাপ বলছে সাবলীলভাবে। চোখ বড়ো ছোটো করছে। কিন্তু, চোখ আঁটকালো নায়িকার আগমনে। ট্রেন চলে যাচ্ছে পেছনে, আর সামনে ওড়নাহীন নায়িকা। আরও কয়েক দৃশ্য পরে চিনি - ফ্রেইডা পিন্টো। জিটিভি'তে ট্রাভেল শো 'ফুল সার্কেল' করতো। ঘুরে বেড়াতো নানান দেশে নানান জায়গায়। পাতায়ায় আমার সাপ্তাহিক বিনোদনে পিন্টোর ঘোরাফেরা-গ্ল্যামারহীন উপস্থাপনা অন্যতম ছিলো। বিশেষ করে পিন্টো যে পর্বে আফগানিস্তান গেলো রোজার মাসে, ইফতারের পরে গানের আসর হলো, উটের পিঠে চড়লো তখন থেকে আমি পিন্টোর ফ্যান। কিন্তু এমন করে রুপালী পর্দায় এসে তাও দুমদাম তুলকালাম অভিনয়। আবার মুগ্ধ হলাম, পিন্টো।

শুরুতে বলছিলাম পাওয়া না পাওয়ার ব্যবধানের কথা। স্লামডগ মিলিওনারও এ চক্করে বন্দী। জামাল পেতে চায় লতিকাকে। ওদিকে শত্রু সেলিম যে কিনা আবার গডফাদারের ফাঁদে বন্দী। তাহলে চমকটা কোথায়? হ্যাঁ, দর্শক বসে থাকে কেনো জামাল পুলিসের হাতে সে প্রশ্নের উত্তরে। একেবারে শুরু থেকে এভাবে আঁটকে দেয়া হয়েছে। তিন পর্যায়ের গল্পে টানটান দৃশ্য আছে। আছে শেষ মুহুর্তের অপেক্ষা। এসব মিলিয়েই স্লামডগ মিলিওনার সাদামাটা বলিউডি ছবি থেকে আলাদা হয়ে উঠে। চরম দারিদ্র্যের বিনোদনীকরণ কিংবা বাণিজ্যের অভিযোগ জানিয়েও বলি - অনেকদিন মনে রাখার মতো একটা ছবি দেখলাম আজ।

তিনটি লিংকঃ
আমেরিকার কোনো টিভিতে দেব আর পিন্টোর প্রথম লাইভ ইন্টারভিউ
লেটারম্যানের সাথে ইন্টারভিউতে দেব প্যাটেল।
ছবির একটা ট্রেলার

মনে দাগকাটার মতো অভিনয় করেছে বাচ্চা দুটি। আয়ুশ আর তনয়কে স্যালুট। একটু আগে আঙুল তুলছিলাম, ছবিতে দারিদ্র্যের
বাণিজ্যিকিকরণ নিয়ে। অথচ সিএনএন'এর রিপোর্টে বলা হচ্ছে- ঐ দৃশ্যই এ ছবির সেরা দৃশ্য। ইউটিউবের কল্যাণে আরও একটু বিস্তারিত আছে এখানে -



শেষে কথা থাকে - ড্যানি বয়ল তো ছবি বানিয়েছেন বাণিজ্যের জন্যই, নাকি?
তাহলে তার হাতে অস্কার আসুক। এটুকু শুভকামনা জানাই আপাততঃ।

.
.
.

3 মন্তব্য::

রাশেদ 26 January, 2009  

কালকে দেখলাম। আমার খুবই ভালো লাগছে। তবে এন্ডিংটা টিপিক্যাল লাগছে। পুরো ছবিটা যত ভালো লাগছে, এন্ডিং এ কেনো জানি মনে হইছে তত যত্ন নেয় নাই। সেইম জিনিসটাই আরো একটু ভিন্ন রকম করে দেখালে (এন্ডিং) মনে হয় আরো ভালো লাগতো।

নিঘাত সুলতানা তিথি 26 January, 2009  

আমার কাছে সহজভাবে এই কথাটাই মনে হয়েছে যে অনেক দিন মনে রাখার মত একটা সিনেমা দেখলাম। কোন জায়গায়, কোন অংশে, কোন কিছু আমার খারাপ লাগে নি। Awsome.

ভাঙ্গা পেন্সিল 28 January, 2009  

ব্রিটিশ পরিচালকের বানানো দেখেই এতো সমালোচনা, অথচ কাহিনী ইন্ডিয়ান রাইটারের। বাংলাদেশী হয়ে বলতে লজ্জা নাই, আমাদের দেশের দৃশ্য এর ব্যতিক্রম নয়। ভারতীয়রা একথা বলতে লজ্জা পেলে তা হাস্যকর হবে। খুবই দারুণ একটা সিনেমা, দর্শক হিসাবে বলছি।

  © Blogger templates The Professional Template by Ourblogtemplates.com 2008

Back to TOP