29 December, 2008

কল্পের নায়কদলঃ এক কোটি তরুণ ভোটার

কখনো কখনো কাটতি বেড়ে যায় কারো। প্রয়োজনের মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ আসে ব্যক্তি-দল কিংবা গোষ্ঠী থেকে। এবার নির্বাচনে যেমন বলা হচ্ছে নবীন এবং তরুণ ভোটাররাই ফলাফল নির্ধারণে মূল ভূমিকা রাখবে। রাজনৈতিক দলগুলোর এমন চিন্তা হুটহাট বা হুজুগে নয়, বরং তাদের থিংকট্যাংকরা বেশ ভেবেই তরুণদের কাছে ভোট চাইছেন।

কেনো চাইছেন, সেটা স্পষ্ট হবে যদি বাংলাদেশের জনসংখ্যার বয়স ভিত্তিক সেগমেন্টে তাকাই। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে - ২০০৬ সালের তথ্য মতে বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যক হচ্ছে ২২.২ বছর। অর্থ্যাৎ ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে এদের সবারই বয়স ছিলো সতেরোর কাছাকাছি। সে সূত্রে একেবারে নতুন ভোটারের এ গোষ্ঠী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে 'মহামূল্যবান'। নানান সূত্র বলছে - এবারের ভোটারদের ৩৩ শতাংশ তরুণ ভোটার, যাদের বয়স ১৮ থেকে ২৪/২৫এর মধ্যে। জনসংখ্যার এ বিশাল এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ কী চায় বা কী ভাবে সেটি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কখনো ভেবেছেন বলে চোখে পড়েনি। ২৫ বছর আগে কিংবা এর কাছাকাছি সময়ে, আমার মতো, যাদের জন্ম তাদের কৈশোরে কিংবা উঠতি যৌবনে পলিটিক্যাল আইকন বলে ছিলেন না কেউ। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়ে মসনদ দখলের জন্য প্রতিহিংসার রাজনীতি ছাড়া তেমন বলার মতো কিছু চোখের সামনে ঘটেনি। এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় - আ'লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহার 'ভিশন ২০২১' নতুন ভোটার হওয়া তরুণ-তরুণীদের উৎসর্গ করেছে। অন্যদিকে বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারের শেষ অংশে জাতীয় উন্নয়নে যুবশক্তিকে কীভাবে সম্পৃক্ত করা হবে সে কথা বলা হয়েছে। এসব কথা শুনতে খুব ভালো লাগে। এতো স্বপ্ন দেখারই বয়স।

আমার যেমন ভালো লেগেছিলো ২০০১ সালে। এরকমই নির্বাচনের একদিন বা দু'দিন আগে হাতে এসেছিলো ৩২ পৃষ্ঠার নিউজ 'পৃন্টে' ছাপানো সাপ্তাহিকটি। মনকাড়া প্রচ্ছদ। চোখে চশমা পরে মোটরবাইক দিয়ে দাঁড়ানো সুদর্শন তরুণ। খানিক তফাতে গেঞ্জি আর জিন্সে মোবাইল হাতে হেটে যাচ্ছে তরুণী। মাঝামাঝি পড়ে আছে একটি বই - 'এ বৃফ হিস্টৃ অফ টাইম', লাল রঙা প্রচ্ছদের ব্যাকগ্রাউন্ডে দালান ছিলো এবং পাশে সূর্য উঠার ছাপ ছিলো বলে মনে পড়ছে। প্রচ্ছদ কাহিনী 'এক কোটি তরুণের কাছে একটি আবেদন'। চৌষট্টি কিংবা পঁয়ষট্টি অথবা সত্তর ছুঁই ছুঁই বয়েসে সে সাপ্তাহিকের স্যুটেড বুটেড এডিটর চমৎকার একটি চিঠি লিখেছিলেন। 'আমার তরুণ বন্ধুরা, আমার তরুণ বান্ধবীরা' ডেকে 'তুমি' সম্বোধনের অনুমতি নিয়েছিলেন। তারপর নানান ছলে চার-দলীয় জোটের জন্য ভোট চেয়েছিলেন। 'অমুক দলকে ভোট দিও' এমন কথা তিনি সরাসরি বলেননি। তিনি তুলনা করেছিলেন, সে সময়কার দুই নেত্রীর, দুই অর্থমন্ত্রীর, দুই দলের ক্ষমতার দুই টার্মের। তারপর সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন তরুণ বন্ধু ও তরুণী বান্ধবীদের উপর। শেষে ছোটো ছোটো বাক্যে বলেছেন - 'কারো কথায় ভয় পেয়ো না', 'সকাল সকাল কেন্দ্রে যেও', 'আগে আগে ভোট দিও'। কিন্তু মাঝে দেখিয়েছেন দূর্দান্ত কিছু স্বপ্ন, প্রচ্ছদের অলংকরণের মডেল তরুণ তরুণী জীবন।

সেবার ভোটার হইনি। নইলে ঐ চিঠি পড়ার পরে আমি আমার সিদ্ধান্ত পাল্টাতাম, শুনেছি পালটিয়েছে অনেকে। মূল বক্তব্যে ভোটের আহবান হয়তো ছিলো, কিন্তু অমন চিঠি আমাকে কেউ কখনো লিখেনি। কেউ বলেনি - দেশের তরুণ হিসেবে আমার মোবাইল পাওয়ার অধিকার আছে। বিদেশে তরুণদের গাড়ী আছে- এপার্টমেন্ট আছে- ক্রেডিট কার্ড আছে, চাকরীর নিশ্চয়তা আছে, গার্লফ্রেন্ড আছে। আর বাংলাদেশের তরুণরা বেকার হয়ে হন্য জীবনে কাটাচ্ছে। সে চিঠিতে চিরযৌবনা এডিটর এ'ও লিখেছিলেন- 'বিদেশে তরুণদের গার্লফ্রেন্ড আছে। অথচ চাকরী নেই বলে তোমরা ভরা যৌবনেও (প্রাইম ইয়ুথ) বিয়ে করতে পারছো না'। ওয়াও! তরুণদের অর্থনৈতিক সমস্যার পাশাপাশি জৈবিক চাওয়া নিয়ে এমন করে আর কেউ ভেবেছেন বলে মনে পড়েনি। তাই সে চিঠি আমি বারবার পড়ি। হয়তো দু'পৃষ্ঠার চিঠি, কিন্তু কী দূর্দান্ত তার ভাষা, কী চমৎকার আহবান, লোভনীয় জীবনের ডাক!

দু'দিন পরে নির্বাচনে সেই এডিটরের ঘনিষ্ট দলটি জিতে। ভুমিধ্বস সে জয়ের উন্মাদনায় অনেক কিছুই ঘটে। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় শহরের কাকগুলোও বিষন্ন হয়ে যায়। তারপর ঋতু বদলায়। দেয়ালের পোস্টার খসে পড়ে। কিন্তু আমি যত্ন করে রাখি সে চিঠি, ৩২ পৃষ্ঠার সাপ্তাহিক। তরুণেরা এবার গার্লফ্রেন্ড না হোক, চাকরী অন্ততঃ পাবে সে আশায় চোখ রাখি স্মার্ট এডিটরের লেখায়। কিন্তু এ কী! তিনি আরও তরুণ হয়ে গেলেন। নানান রঙা শার্ট পরে (হয়তো আগেও পরতেন) লাল গোলাপ হাতে পেছনের জুলফি সামনে এনে ট্রেন্ডি করে চটাস চটাস করে বিদেশি ম্যুভির ক্লিপ দেখান। শুনেছি এমন অনুষ্ঠান তিনি আগেও করতেন। কিন্তু এবারও বিটিভির অনুষ্ঠানের চেয়ারটি তিনি নিজেই দখল করেছেন, সেখানে বসানোর মতো আরেকজন তরুণ খুঁজে পাননি। ওদিকে ঢাউস সাইজের বিশেষ সংখ্যায় তরুণরা লিখে যাচ্ছে তাদের প্রাইম ইয়ুথে ঘটে যাওয়া শরীরি সম্পর্কের ফ্রয়েডীয় কিংবা গুপ্তীয় গল্প। বিশেষ সম্পাদকীয়তে এডিটর জানাচ্ছেন - 'এসব গল্প আগামী দিনের সমাজ বিজ্ঞানীদের নীরিক্ষার বিষয় হবে'। কিন্তু, এক কোটি তরুণের কী হবে!

বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি, এক কোটি তরুণের একজন (স্ত্রী সহ) বিটিভি'র প্রাইম টাইমের স্লট দখল করেছিলেন। এই তরুণ পরে প্রবীণ পিতাসহ 'বিকল্প' পথ ধরেছেন। আরেক তরুণ অবশ্য তরুণের পর্যায়ে নেই। সেই এডিটরের ভাষায় বাংলাদেশের মহাথির তিনি। মালয়েশিয়া থেকে শেখার জন্য কিনা জানি না, তবে কতো কোটি টাকা কী জানি কী হয়েছে, আঁটকে গেছে। এই শাহেনশাহ তরুণের কাছাকাছি বন্ধুরা কেউ টিভি চ্যানেল করেছেন, ফোন কোম্পানী এনেছেন। এগুলোর অর্থায়ন সুত্র নিয়েও নানান তর্ক আছে, মামলা আছে। আজ এটিএন বাংলায় রাহুল রাহার সাথে 'লীড নিউজ' অনুষ্ঠানে বিএনপির মিস্টার রিজভী অবশ্য বলছিলেন, "বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের গণতন্ত্রের কৈশোরিক অবস্থায় দূর্নীতি একেবারে না থাকা সম্ভব নয়"। প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বড়ো কথা নয়, 'গণতন্ত্রের কৈশোরিক অবস্থা' কী, সেটা ভাবতেই অনুষ্ঠান শেষ। রাহুল রাহা বুঝেছেন কিনা জানি না। যাক, তরুণের গল্প ছেড়ে কৈশোরে নয়। ক্ষমতাবান তরুণেরা সব মামলা থেকে মুক্ত হবেন, ইতোমধ্যে হতে শুরু করেছেন, আরও হবেন, একেবারে বিশুদ্ধ তরুণ হবেন। বিপরীতে হার্ভাড/ক্যামব্রিজের পেপার নিয়ে আলোচনায় আসছেন আরেক তরুণ। তিঁনি বিদেশীনি গার্লফ্রেন্ডকে বৌ করেছেন, রাণীমা'র উজির নাজিররা লিখছে - সম্ভবনা আছে তিনিই হবেন রাজীব গান্ধী, তাঁর বিদেশীনি স্ত্রীটি সোনিয়া স্টাইলে দেশে আলো দেখাবেন। হয়তো সেসব কেবলই কল্প-গল্প। কিন্তু, শেষতক সে-ই সুদর্শন চির তরুণ সম্পাদকের পরিণতি মইন-মিলার কল্পগল্পের চেয়েও করুণ হয়েছে। লাভ রোডে 'সাদ্দাদের বেহেশতখানা'য় লস দিয়ে 'পালাতে গিয়ে' বিমান বন্দরে আঁটকে গিয়েছিলেন। তখনো আমি সে-ই চিঠিওলা ম্যাগাজিন সাথে নিয়ে ঘুরি। ইরাবতী বা কাওয়াই নদীর ওপাশে গেলেও একান্ত ব্যক্তিগত ডায়েরীর সাথে ভাজ করে রাখি। স্বপ্নগুলো সত্যি হোক না হোক, কল্পগল্প মনে করেই পড়ি সে চিঠি। সময় যায়, পাঁচ বছর, ছয় বছর। কেবল অপেক্ষায় থাকি, একবার যদি দেখা হয় - চিঠিটি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করবো, 'আমাদের কাছে এ চিঠি আপনি লিখেছিলেন, মনে আছে?' দেখা হয়নি। বরং গত মে মাসে আরেক চিঠিতে তিনি বিদায় জানিয়েছেন ২৯ বছরের আজন্ম সংস্পর্শের পত্রিকা থেকে। সে চিঠি পড়ে আমি হতাশ হয়েছি, বিমর্ষ হয়েছি। তরুণদের মিছে স্বপ্ন দেখিয়ে তাঁর কী লাভ হলো, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চিন্তা বাদ দিয়েছি। কেবল, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছি - 'আই ফিল স্যরি ফর ইউ, মিস্টার রেহমান!'

নির্বাচনের এ ডামাঢোলে, নবীন/তরুণদের জপাজপিতে আজ খুব মনে পড়ছে মিস্টার রেহমানের সে চিঠির কথা। প্রথম কৈশোরে প্রেমিকার লেখা চিঠির অনুভব যেমন প্রায়ই নস্টালজিক করে তোলে, ঠিক তেমন করে মনে পড়ছে। বাসায় কোথাও কোনো ফাঁকে আছে হয়তো এখনো। আজ বাদে কাল নির্বাচন। বিশাল তরুণ গোষ্ঠী ভোট দিবে। এক কোটি তরুণের একজন হয়ে, খুব আশার কিছু দেখতে পাচ্ছি না। বেকারত্ব বাড়ছে, চাকরীর বাজার সংকোচিত হচ্ছে, ধনী-গরীবের আয় বৈষম্য বাড়ছে দিনদিন। বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দা ২০০৮এ গেলো এবং এখনো চলছে তার ধাক্কা বাংলাদেশে বিন্দুমাত্র গেলেও নতুন সরকার কীভাবে সামলাবে। জনসংখ্যার বিকাশমান বা বিস্ফোরন্মুখ যুব অংশের কর্মসংস্থান কোথায় কীভাবে করা হবে সেটা হয়তো দেখার বিষয় হবে। কে জানে, হয়তো আরো একজন শাহাবুদ্দিন প্লেনের চাকায় চড়ে বিদেশ যেতে চাইবে, অবৈধ পথে ইউরোপ পাড়ি দিয়ে গিয়ে মাঝ সমুদ্রে পথ হারাবে মুন্সীগঞ্জের সোলায়মান, স্বপ্নভূক হয়ে মারা যাবে তারা, এবং আরও অনেকে। কুয়েতে ন্যুনতম মজুরী চাওয়া শতশত শ্রমিককে আধা রুটি খেতে দিয়ে রোদের মধ্যে পাথরে দাঁড় করিয়ে রাখবে, প্লেন ভর্তি করে রক্তাক্ত জামায় এসব মিসকিনদের ফেরত পাঠানো হবে স্বদেশে। এসব দেখে আমাদের নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র পুরনোর মতোই নির্বিকার থাকবে। পাঁচতারার বলরুমে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে প্রকাশিত প্রচারিত হবে - এবারও জিডিপি গ্রোথ সেভেন পার্সেন্ট। ধুমপান ও রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গণ বাড়বে। এক কিশোরী তার ফেসবুক প্রোফাইলে পলিটিক্যাল ভিউ লিখবেঃ All Sux। তখন বিভিন্ন চ্যানেলে তরুণদের আইকন সাজবেন একজন ভুঁড়িওলা বিগত বিতার্কিক। চল্লিশ ছোঁয়া হাল্কা সাদা হওয়া চুলে কলপ লাগিয়ে তরুণদের জায়গাটি তিনি দখল করে নিবেন। পরিপাটি গোঁফে, মেক-আপে স্যুটে বুটে, তিনি বলবেন, 'প্রিয় তরুণ বন্ধুরা, তোমরা হয়তো জানো, এডমান্ড বার্ক বলেছিলেন...'।

.
.
.

3 মন্তব্য::

আরিফ জেবতিক 31 December, 2008  

কী আর বলব , কী বলা যায় ?
৯১-৯৬-০১ এর পথ ধরে ০৮ও ইতিহাসের পাতায় আরেক প্রজন্মের ব্যর্থতার দিনপঞ্জি না হোক , এই প্রার্থনা ছাড়া আর কীই বা করতে পারি ?

নিঘাত সুলতানা তিথি 01 January, 2009  

পড়লাম আজ।
নির্বাচনের ঠিক আগের মুহুর্তের লেখা। ইন্টারেস্টিং লাগছে তাই নির্বাচনের ফলাফল জানার পর পড়তে।
এই এক কোটি তরুণ ভোটার আর কিছু না হোক, মৌলবাদ আর যুদ্ধাপরাধীদের "না" বলতে শিখেছে। তাদের সেই স্বপ্নের প্রতিদান তারা পাবে কি না, সেটা দেখার জন্য আপাতত শুধু প্রার্থনা আর অপেক্ষাই করতে পারি। আর যারা সত্যিকার কিছু করতে পারেন ক্ষমতায় বসে তারা কি করেন সেটাই দেখার বিষয়।

. 02 January, 2009  

আরিফ ভাই এবং তিথির প্রার্থনায় আমিও সমবেত হই।

অনেক অনেক ধন্যবাদ।

  © Blogger templates The Professional Template by Ourblogtemplates.com 2008

Back to TOP