28 May, 2007

ছাদের কার্ণিশে কাক - ১৯

বেলা:
আপনাকে শেষ মেইল করেছিলাম আজ থেকে বাইশ দিন আগে।
এরপর আপনার কোন মেইল পেলাম না।
হয়্তো রাগ করে আছেন।
প্লিজ রাগ করবেন না।
আমি আপনাকে অনুরোধ করবো, খুব মন দিয়ে আমার এ মেইল পড়ার জন্য!
আমি কখনো এমন ভেবে চিন্তে মেইল করিনি।
এ মেইল করার আগে অনেক ভেবেছি। গত দু'সপ্তাহ নিজের সাথে অনেক বুঝাপড়া করেছি।
আবারও বলি - অনেক ভেবে এ মেইল করছি।
কোন একদিন চ্যাটে আপনি জিজ্ঞেস করেছিলেন - আমার গার্লফ্রেন্ড নেই কেনো?
আমি বলেছিলাম - কেউ হয়তো পছন্দ করেনি।
আজও বলি - ওটাই খুব সত্যি কথা।
আসলে আমাকে পছন্দ করার মতো কিছু ছিল না।
আমার চলাফেরায় কিংবা কথাবার্তায় মোহনীয় কিছু ছিল না।
আপনাকে বলা হয়নি, ইচ্ছে করেই অনেক ব্যক্তিগত প্রসংগ এড়িয়ে গেছি।
আমার বাবা নেই।
বড় হয়েছি মামার বাসায়।
যখন কলেজে পড়ি তখন থেকে আমি যেন কেমন হয়ে গেছি।
আমার ক্লাসমেটদের সাথে খুব সহজে মিশতে পারিনি।
ওদের ভাবনায় তাল মিলাতে পারিনি।
ভার্সিটিতে এসে আরো একা হয়ে গেলাম।
জীবন আমার কাছে খুব জটিল এক ব্যাপার হয়ে গেলো।
ক্লাস শেষ করে এক মুহুর্তও ক্যাম্পাসে থাকতাম না।
একসাথে চার-পাঁচটা টিউশনি করে নিজের টুকটাক শখগুলো মিটিয়েছি।
আমার মামা তাঁর সীমিত সাধ্যের মধ্যে আমার জন্য অনেক করেছেন।
মামার সৎ ও সংগ্রামী জীবন আমার শ্রেষ্ঠ প্রেরণা।
পড়ালেখার বাইরে আমার ভালো সঙ্গী ছিল বই আর গান।
আপনি নিশ্চয় এর মাঝে জেনে গেছেন - আমি প্রচুর বই পড়ি।
টিএসসির আড্ডা আমাকে কখনো টানেনি।
একা একা হয়তো ঘুরতাম কিছুক্ষণ, ভালো লাগতো না।
কৈশোরের অবসন্নতা আমার মাঝে জেঁকে বসে গেছে।
কেন জানি না - কখনো কোন কারণে উচ্ছ্বসিত হতে পারিনি।
আমার 'অসামাজিক' আচরণগুলো তাই আপনার চোখে ধরা পড়েছে বারবার।
গত দু'বছরেরও বেশী সময় ধরে আপনার সাথে আমার মেইলে যে আলাপ, ওটাই আমার সর্বোচ্চ সামাজিকতা।
বেলা, নিজের কাছে সৎ থেকে বলি - আমার মনে হয়েছে আপনি অসাধারণ এক মেয়ে।
আপনি যখন বিয়ের কথা বললেন - তখন আমার মনে হয়েছে, আমি আপনার যোগ্য নই।
আমার মনে শঙ্কা ভর করেছে - আমার জীবনে এসে আপনার স্বপ্নভঙ্গ হবে।
আমার মনে হয়েছে, আপনি অনেক দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যেটা আমি পারি না, পারিনি কখনো।
গত বাইশ দিনে আপনার কোন মেইল পাইনি, আমিও মেইল করিনি।
বিশ্বাস করবেন? এ কয়দিন নিজেকে ভীষণ একা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার খুব প্রিয় কে যেন পাশে নেই।
আপনি আমার খুব প্রিয় একজন, এটা বলে দিলাম।
ভাবছি প্রিয় মানুষটিকে বাকী জীবনের জন্য নিজের করে নিবো কিনা।
বেলা, আমিও এখন আপনার মতো করে ভাবছি।
আমাকে সময় দিবেন? এক বছর সময়।
ভালো পার্মানেন্ট একটা চাকরী, নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নেয়ার সময়।
আপনিও মাস্টার্স শেষ করে নিতে পারেন।
এ সময়ে আমাদের না হয় আরো জানাজানি হলো!





এতটুকু লিখে সরণ আবার পড়ে।
মনে হয় - কী যেন বাদ পড়ে যাচ্ছে। সরণের মনে হয় জীবনের সবচে' গুরুত্বপূর্ণ মেইল করতে যাচ্ছে সে। আপাতত; জিমেইলে ড্রাফট হিসেবে সেভ করে রাখে। রাতে আরো ভেবে কাল সকালে পাঠানো যাবে। রাতে শুয়ে শুয়ে ড্রাফটটা মনে মনে আরো একটু ঘষামাজা করে নেয়।

সকালে অফিসে জিমেইল ওপেন করতেই সরণ দেখে ইনবক্সে বেলার মেইল।

হ্যালো সরণ,
আশা করছি ভালো আছেন। আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করছি, আপনার মতো বন্ধু পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার। আপনার মতো ম্যাচিউরড ফ্রেন্ড ক'জনের আছে জানি না। গত তিন সপ্তায় সাফকাতের সাথে অনেক আলাপ করেছি। প্রতিদিন ফোনে কথা বলেছি প্রায় তিন চার ঘন্টা। মাঝে একদিন আশুলিয়া পার হয়ে দিয়াবাড়ী গিয়েছিলাম। আরেকদিন ডিনার করলাম ইফেসে। আমি সাংঘাতিক ইমপ্রেসড। একজন অপরিচিত মানুষ এতো সহজে অন্যকে আপন করে নিতে পারে জানতাম না। বিভিন্ন কারণে পুরুষ সম্পর্কে আমার খুব ভুল ধারণা ছিল। এখন নিজেকে খুব বোকা মনে হচ্ছে। সাফকাত হলো এমন একজন মানুষ যার সাথে সব ব্যাপারে আলাপ করা যায়। বলা যায় - ও একজন অলরাউন্ডার।
খুব বেশী সমস্যা না হলে নেক্সট নভেম্বরে বিয়ে। হানিমুনের জন্য আপাতত: সিংগাপুর-মালয়েশিয়া-ব্যাংকক ঠিক করে রেখেছি। পরে একবার নেপাল ঘুরে আসবো। আমার নিজের ছেলেমানুষী দিয়ে আপনাকে অনেক বিব্রত করেছি, আবারও বলি - আপনার মতো শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে আমি খুব ভালো একটি ডিসিশন নিতে পেরেছি। আপনার আর খবরাখবর কী? প্লিজ কীপ ইন টাচ!
< বেলা >

মেইল পড়ে সরণের পুরো মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠে। চোখ-কান দিয়ে মনে হয় আগুন বেরুচ্ছে। পা দুটো শিরশির করে উঠে। ধুক করে মোচড় মারে বুকের ভেতর। কম্পিউটারের মনিটর যেন দুলছে সামনে। হঠাৎ মনে হয় মনিটরটা মানুষ হয়ে গেছে। গুগলমেইল মুছে ওখানে রং-বেরঙের এক দৈত্য ভেসে উঠেছে। সরণের দিকে নানান ঢং করে ভেংচী কাটছে। নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে গত রাতে ড্রাফট করা মেইলে 'ডিসকার্ড' ক্লিক করে সরণ।

পরের কয়েকদিন সরণ ইচ্ছে করেই সারারাত ওভারটাইম করেছে। বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করেনা। জিমেইলে বেলার আরো কিছু মেইল এসেছে। কেমন আছেন, কী করেন টাইপের কথা। বেশীরভাগ জুড়ে মেজর সাফকাতের গল্প। সরণ জাস্ট চোখ বুলিয়ে নেয়। রিপ্লাই করে না।

এক ছুটির দিনে বিকেলে সরণ বেলাকে মেইল করে।
বেলা:
হয়তো ভালো আছেন।
কখনো কোন রিকোয়েস্ট করিনি।
আজ একটা রিকোয়েস্ট করি, রাখতেই হবে।
প্লিজ! আমাকে আর কখনোই মেইল করবেন না।
আমিও করবো না।
এটা আপনার জন্য নয়, আমার নিজের জন্য বলছি।
প্লিজ! নেভার কন্টাক্ট মী!
- সরণ

মেইল পাঠিয়ে সরণ বেলার পুরনো সব মেইল কপি করে এমএস ওয়ার্ডে সেভ করে। তারপর একে একে সব মেইল মুছে দেয় ইয়াহু আর জিমেইল একাউন্ট থেকে। ওয়ার্ড ফাইলের পাসওয়ার্ড কী দিবে ঠিক করতে পারে না। সরণ চায় - ইউনিক কিছু হবে। একদম নতুন। অথচ মাথা কাজ করে না। সরণ ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। সামনের বাসার ছাদের উপরে একটি কাক বসে আছে। সরণ অনেকক্ষণ কাকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয় - ভীষণ ক্লান্ত অথবা কোন কারণে অবসন্ন। কেন জানি হঠাৎ কাকটিও সরণের দিকে তাকায়। সরণের মনে হয় - এ কাক এবং সে আজ এই মুহুর্তে আলাদা কিছু নয়। কাক মানুষ কাক। কাক সরণ কাক। দলছুট নি:সঙ্গতা। বেলার মেইলগুলোর ফাইলের পাসওয়ার্ড - ছাদের কার্ণিশে কাক। সরণের স্মৃতি শক্তি ভালো। কঠিন পাসওয়ার্ড, তবে মনে থাকবে অনেকদিন।

সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে সরণ দেখে তার টেবিলের উপর একটি খাম পড়ে আছে। রেজিস্টার্ড চিঠি।


(চলবে...)

0 মন্তব্য::

  © Blogger templates The Professional Template by Ourblogtemplates.com 2008

Back to TOP