03 September, 2006

নাদিয়ার গান

সময়টা 1940 এর মাঝামাঝি। মিশরে তখন বৃটিশ লোকজন চুটিয়ে ব্যবসা করে নিচ্ছে। এরকমই একজন কটন ব্যবসায়ী হেনরী অস্টেন; স্ত্রী ক্যাথেরিন ও একমাত্র কিশোর সন্তান চার্লসকে নিয়ে আলেকজান্ডৃয়ায় রাজত্ব করে চলেছে। প্রভাব প্রতিপত্তি, বিশাল বাগান - ব্যবসা, রাজকীয় বাড়ী, চাকর-বাকরের কমতি নেই।কিশোর চার্লস ছোটবেলার খেলার সাথী কারিমা-র প্রেমে পড়ে যায়। অথচ সামাজিক অগ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারটি তারা দু'জনই বুঝতে পারে । হেনরির অফিসের গাড়ীর ড্রাইভার কারিমার বাবা মোস্তফা। কারিমাও চার্লসদের বাসায় ফুট-ফরমায়েশ খাটা মেয়ে, সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে যার অবস্থান। এরপরও পারষ্পরিক ভালো লাগা বেড়ে চলে।বছর খানেকের মধ্যে দ্্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামাদোল লেগে যায়। বাবা-মা'র ইচ্ছায় চার্লস অ্যামেরিকা চলে যায় পড়ালেখা করতে। বিশ্বযুদ্ধের শেষাশেষি চার্লস ফিরে আসে মিশরে। কৈশোর উত্তীর্ণ যৌবনে চার্লস ও কারিমা পরষ্পরকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করে। লোকচক্ষুর আড়ালে অবিরাম নিশি প্রণয় শেষে চার্লস তার বাবা-মা'র কাছে কারিমার কথা বলে। জগতের স্বাভাবিক নিয়মে হেনরী সন্তানের ইচ্ছার বিরূদ্ধে দাড়ায়। অস্থির আসহায় চার্লস মাতাল অবস্থায় গাড়ী চালাতে গিয়ে কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। শোক কাটিয়ে কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই কারিমা নিজের ভেতর অনুভব করে আরেকজনের অস্তিত্ব, চার্লসের স্মৃতি, অনাগত প্রজন্ম!পারিবারিক নির্যাতন পেরিয়ে সামাজিক অবহেলার আগেই এগিয়ে আসে কারিমার ভাই ওমরের বন্ধু মুনির আহমেদ। স্ত্রী-কণ্যা হারানো নি:সঙ্গ মুনির সব জেনে শুনে কারিমাকে বিয়ে করে। কিছুমাস পর জন্ম নেয়া নাদিয়া-কে নিজের সন্তান বলে মেনে নেয়। অসাধারণ মানুষ মুনিরের সংসারে কারিমা সুখে থাকে - নাদিয়ার মাঝে চার্লসের ছোঁয়া খুঁজে পায়। হঠাৎ একদিন মুনিরের বন্ধু, মিউজিক ব্যবসার সাথে জড়িত, স্পিরস কারিমার টুকটাক গান গাওয়ার ব্যাপারটি জেনে যায়। তারপর ঘটনাক্রমে কারিমা হয়ে উঠে মিশরের আলোচিত সঙ্গীত শিল্পী, নাইটিংগেল, কারাওয়ান। মিশরের এক নম্বর শিল্পী উম্মে-কাথলুম- এর পর কারিমা মানুষের মন জয় করে নেয়। একটানা কনসাটে কনসার্টে কারিমার তখন জয় জয়কার অবস্থা।1952 সালের 26 জানুয়ারীর ঐতিহাসিক "ব্ল্যাক স্যাটার ডে" হামলায় কনসার্ট চলাকালীন সময়ে মানুষের হুড়োহুড়িতে নাদিয়া হারিয়ে যায়। নাদিয়াকে খুঁজে পায় সন্তানহীন দম্পতি মিশরীয় তারিক মিস্ত্রী ও ফরাসী সিলন। তারপর নাদিয়া বড় হতে থাকে ফ্রান্সে, অন্য পরিবেশে, অন্য নামে; গ্যাবি মিস্ত্রী।ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে যায় নিয়ম মতো। সন্তান হারিয়ে কারিমা-মুনিরের বিষন্ন জীবন এগিয়ে চলে। মৃত্যূর আগে মুনিরের শেষ ইচ্ছা মতো কারিমা গান গেয়ে যায়। পুরা আরব দুনিয়ার আলোচিত শিল্পী হয়ে উঠে। গানে গানে প্রকাশ পায় বুকের ভেতর জমে থাকা নাদিয়ার জন্য হাহাকার - "কোথায় গেলি খুকু তুই?তোকে ছাড়া ভীষণ একাকী আমি - চোখ বুঁজলেই তোকে দেখি,কোন গোলাপ সুরভী দেবে না - কোন বাতি আলো দেবে না আমার ঘরেযতদিন তুই দূরে দূরে..."আরো কিছু বছর পর সিলনের মৃত্যূর পর নাটকীয় ভাবে তারিক আবিষ্কার করে গ্যাবির (নাদিয়া) আসল পরিচয়। গ্যাবি ততদিনে নামকরা সাংবাদিক। অবশেষে মায়ের কোলে মেয়ে ফিরে আসে। কাহিনী আরো কিছুটা আগায়। কারিমার অস্বাভাবিক মৃত্যূ, নাদিয়া কিডন্যাপ হওয়া-সহ পর্যায়ক্রমে ধরা পড়ে কারিমার ভাই ওমর। পাপের পতন পূণ্যের জয় হয়। "নাদিয়া'স সং" মিশরীয় লেখিকা সোহেইর খাসোগ্যি-র তৃতীয় উপন্যাস, প্রকাশিত হয়েছিল 1999 সালে। 1995 সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস "মিরাজ" বাজারমাত করেছিল বেস্ট সেলার হয়ে। মাঝে প্রকাশিত হয় 2য় উপন্যাস "মোসাইক"।নাদিয়া'স স ং -এর কাহিনী শুরু হয় 1940 সালে। তারপর নানা ঘটনা প্রবাহ এগিয়ে গেছে ইতিহাসের সাথে সমান তালে। মিশরের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘনঘটার ছোঁয়া লেগেছে কাহিনীর পরতে পরতে। 1990 সালে ইরাকের কুয়েত আক্রমণের শেষে এসে নাদিয়া'স সং শেষ হয়েছে। নাগিব, নাসের, সাদাতসহ বিভিন্ন নেতারা ঘুরে ফিরে কাহিনীতে বিচরণ করেছে নানান প্রেক্ষিতে। কারিমার ভাই ওমরের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি, মুসলিম ব্রাদারহুডের নিষিদ্ধ কর্মকান্ড, কুসংস্কার, মিশরীয় নারী জাগরণের পথিকৃৎ হুদা - আল- শারাবি, সুয়েজ খালের রাজনীতিসহ নাদিয়ার সাংবাদিক জীবনের বিভিন্নদিক উপন্যাসে স্থান পেয়েছে।লেখকরা সাধারণত: ইতিহাসের বৃত্তের বাইরে থেকে সময়কে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু সোহেইর ইতিহাসকে বাদ দিতে চাননি। ইতিহাস বাহুল্যে প্রায় সাড়ে চারশ' পৃষ্ঠার এ উপন্যাস মাঝে মাঝে জোর করে পড়ে যেতে হয়েছে শেষ পরিণতি জানার জন্য। তবুও 1940 থেকে 1990 - এই 50 বছরের মিশরীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার এক অনবদ্য আখ্যান - "নাদিয়া'স সং"।

0 মন্তব্য::

  © Blogger templates The Professional Template by Ourblogtemplates.com 2008

Back to TOP